নজরুল ও সেলবর্সী
বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ
পশ্চিমা ভাবাদর্শে বামপন্থী ও ডানপন্থী যে মেরুকরণ, বাঙালি মুসলমান সমাজে তার উন্মেষ ১৯২০-এর দশকে। তারই উত্তরাধিকার নানা রঙে ও প্রতাপে পরে প্রবাহিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম ও ফযলুল হক সেলবর্সীর সূত্র ধরে এই লেখা সেই ভাবাদর্শিক মেরুকরণের অনুসন্ধান। পাঁচ কিস্তির এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এটি শেষ কিস্তি।
কিস্তি: ১
কিস্তি: ২
কিস্তি: ৩
কিস্তি: ৪
কিস্তি: ৫
খেলাফত, আকিদা, দাড়ি, নারী, হিন্দু-মুসলমান মৈত্রী ইত্যাদি প্রশ্নে মেরুকরণ যত ঘনিয়ে উঠল, সেই মেরুকরণেরই একধরনের প্রজেকশন/প্রক্ষেপণ ঘটল আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিকে নিয়ে। এই সময়েই ইউরোপে নতুন ধরনের গণ–আন্দোলনের দ্বারা বিশ শতকী ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রগুলো গঠিত হচ্ছে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পরে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তি মাথা তুলেছে ইতালিতে, আর তার আদলে জার্মানিতে তৈরি হচ্ছে নাৎসিরা।
ফ্যাসিস্ট বনাম কমিউনিস্ট
রুশ বিপ্লবের অনতিপরেই বাঙালি মুসলমান তরুণেরা প্রমুখ আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলশেভিক চিন্তার প্রতি। মুজফ্ফর হয়ে উঠলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। নজরুল তাঁর কমরেড হলেন। মজুর স্বরাজ পার্টি, শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দল, বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল করলেন। ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা করলেন। আবুল হুসেন বাংলার বলশী বই লিখলেন কৃষক শ্রেণির দুর্দশা নিয়ে। গোলাম আম্বিয়া খান লোহানীর কাহিনি অনেকেই জানেন।
অন্যদিকে ইউরোপে যাঁর প্রতি সেলবর্সীর প্রাণ আকৃষ্ট হয়েছিল, তিনি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি। সেলবর্সীর পত্রিকায় লেখা হলো, ম্যাজিনার পরে ইউরোপে কোনো ‘স্বভাব-নেতা’, মহাপুরুষ বা দেশনায়ক আসেনি। তারপর এলেন ‘অত্যদ্ভুত মানব’ বেনিতো মুসোলিনি, যার ‘ছয় বৎসর শাসনামলে উক্ত দেশ সকল দিক দিয়া কিরূপ শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছে, তাহা ভাবিলে বিস্ময়ে হৃদয় পূর্ণ হইয়া যায়।’ এই মুসোলিনি নাকি স্বভাব-নেতা ও ‘খোদা-ভক্ত লোক’। কী রকম? ‘তিনি তাঁর স্বদেশ হইতে বেতমিজী ও বেপর্দ্দাকে নির্ব্বাসিত করিয়াছেন।’ মদ্যালয় বন্ধ করেছেন। থিয়েটার বায়োস্কোপ বন্ধ করেছেন। এ কারণেই ইতালির ‘সর্ব্বময় কর্ত্তা’ বর্তমান জগতের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ’। তাঁর গুণ হলো ‘অসামান্য স্বদেশ-ভক্তি, শ্রম, সাহসিকতা, ত্যাগ, অদৃষ্টবাদিতা এবং সর্ব্বোপরি খোদার উপর অচল বিশ্বাস।’ তিনিই ‘রুসের কম্যুনিজম বা নাস্তিক্য-পূর্ণ জঘন্য মতবাদ’ ঠেকাতে ‘জগতের ত্রাণ-কর্ত্তা’ হিসেবে হাজির। ‘তিনি বলশেভিজম এর অস্বাভাবিকতা ও অনিষ্টকারিতা উপলব্ধি করিয়া সেস্থলে “ফেসিজম” নামে এক নূতন মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন’ ও ইতালীয় নব্যরা তাঁকে ‘পীর মুর্শিদের মত শ্রদ্ধা করে ও তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে দলে দলে জীবন দান করিতে প্রস্তুত থাকে।’
কেবল সেলবর্সীর ‘আল মুসলিম’ নয়, আরও নানা রক্ষণশীল পত্রিকায় মুসোলিনির প্রতি অনুরাগ প্রদর্শিত হয়। ‘হানাফী’ নামক পত্রিকায় ১৯২৭ সালে মুসোলিনির প্রশংসা করে লেখা হয় যে তিনি একটা কৌমার্য ট্যাক্স বসিয়েছেন। ‘অবাধ নর-নারী সম্মিলন ও অসংযত স্ত্রী-স্বাধীনতার ফলে ইউরোপের এক একটি দেশে যে কত নর-নারী অবিবাহিত থাকিয়া বিলাস-লালসা-পূর্ণ আয়েশ-আরামের জীবন কাটাইয়া জাতির অকল্যাণ ও পাপভার বৃদ্ধি করে, এই ঘটনায় তাঁহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়। কামালী তুরস্কে ইউরোপীয় হাওয়া লাগিবার সঙ্গে-সঙ্গেই তথায় বাধ্যতামূলক বিবাহের আইন করা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে।’
ইউরোপে যাঁর প্রতি সেলবর্সীর প্রাণ আকৃষ্ট হয়েছিল, তিনি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি। সেলবর্সীর পত্রিকায় লেখা হলো, ম্যাজিনার পরে ইউরোপে কোনো ‘স্বভাব-নেতা’, মহাপুরুষ বা দেশনায়ক আসেনি। তারপর এলেন ‘অত্যদ্ভুত মানব’ বেনিতো মুসোলিনি। এই মুসোলিনি নাকি স্বভাব-নেতা ও ‘খোদা-ভক্ত লোক’। কী রকম?
সেলবর্সীর মতো মুষ্টিমেয় বাঙালি মুসলমান রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীর পক্ষে মুসোলিনির ভক্ত হলেও প্রায়োগিক দিক দিয়ে ফ্যাসিবাদী আন্দোলন করা ছিল অসম্ভব। আসলে ফ্যাসিবাদে যা তাঁদের আকৃষ্ট করেছিল, তা ব্যক্তির বাসনার ওপর নতুন ধরনের অণু-শাসন।
ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিজম নিয়ে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের মেরুকরণ বুঝতে মাথায় রাখা দরকার যে বাসনা আর রাজনীতি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সেলবর্সী আজীবন চিরকুমার ছিলেন, আর নজরুল ছিলেন প্রেমিক। কিন্তু এই ব্যক্তিজীবনীর বাইরেও রাজনীতির সঙ্গে বাসনানীতির গহিন সম্পর্ক কীভাবে তাঁদের রাজনীতি গঠন করেছে, সেটা স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয়।
আপাতত এটুকু বলা যায়, যে জীবন মানুষের কাছে স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত, সেই জীবনধারার পুনরুৎপাদন যখন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সম্ভব হয় না, তখন সেই বিহ্বলতাকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট বায়োপলিটিকস ও সার্বভৌম বলিতন্ত্রের গঠনই ফ্যাসিবাদের চিন্তাগত শর্ত। তা প্রায়ই ঘনীভূত হয় লিডার বা এক জাতি-এক নেতার প্রতি অচলা ভক্তিতে।
উগ্র জাতীয়তাবাদীদের এই লিডার-পূজার ব্যাপারে নজরুল শুরু থেকে শেষতক ক্রিটিক্যাল ছিলেন। ‘আমরা ভেঙেছি রাজার সিংহাসন, করিয়াছি নরে আমরা গো নারায়ণ।’ নিজেও তিনি নেতা হতে চাননি। ‘আমার সুন্দর’ লেখায় বলছেন, ‘আমি...ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা ও নেত্রীদের আহ্বানে বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেছি; আমি তরুণদের সাথে মিশেছি—বন্ধু বলে, আত্মার আত্মীয় মনে করে। তারাও আমায় আলিঙ্গন করেছে বন্ধু বলে, ভাই বলে—কিন্তু কোনো দিন আমার নেতা হবার লোভ হয়নি, আজো সে লোভ হয় না। আমার কেবলই যেন মনে হতো, আমি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি। জাতি-ধর্ম-ভেদ আমার কোনো দিন ছিল না, আজো নেই।’
দুশমনির চূড়ান্ত
১৯২০ সালে মুজফ্ফর, নজরুল ও সেলবর্সী একসঙ্গে ‘নবযুগ’–এ কাজ শুরু করেছিলেন। এক দশক না যেতেই বাঙালি মুসলমান সমাজের নানামাত্রিক ভাবাদর্শিক মেরুকরণের ফলে সেলবর্সী তাঁর দুই সাবেক সহকর্মীর প্রতি চরম বৈরী হয়ে পড়লেন, আর তা প্রকাশ পেল নিদারুণ দুশমনিতে। কমিউনিস্টরা ইসলামবিদ্বেষী তথা ‘একমাত্র সাম্যধর্ম্ম ইসলামের প্রকাশ্য পরমারি’ বলে লেখে সেলবর্সীর পত্রিকা। কিন্তু বিরোধিতাটা কেবল ভাবাদর্শের মোটাদাগে নিবদ্ধ ছিল না; বরং ব্যক্তি আকারে নজরুল ও মুজফ্ফরকে নিশানা করলেন সেলবর্সী। সেলবর্সীর আল মুসলিম ও আকরম খাঁর মোহাম্মদী পত্রিকা নজরুলের তীব্র বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। অন্যদিকে নজরুলের পাশে দাঁড়ায় ‘সওগাত’। ইসমাইল হোসেন সিরাজী ১৩৩৫ ৩০শে কার্ত্তিক [অক্টোবর-নভেম্বর ১৯২৮] ‘সওগাতে’ নজরুলের সাফাইয়ে লেখেন:
‘মিলাদ মহফিলে যে গান লইয়া কবি নজরুল ইসলামকে অতীব জঘন্য ভাষায় জঘন্যভাবে গালাগালি দিয়া সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ইসলামি ভদ্রতার (আদবের) মাথায় পাদুকাঘাত করা হইতেছে, আবার মাসিক মোহাম্মদীতে জোরেসোরে সেই গান বাজনা জায়েজ বলিয়া ফতোয়া দেওয়া হইতেছে। এ-সমস্তই চমৎকার কাণ্ড। আমার মনে হয়, বন্ধুবর মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের তওবা করিয়া প্রায়শ্চিত্ত করা কর্তব্য। হয় তিনি ভদ্রলোকের মত মোহাম্মদী পরিচালিত করুন, না হয় তিনি বন্ধ করিয়া দিন। এইরূপ ব্যবহারের দ্বারা তিনি সর্বত্রই প্রায় সর্বজন কর্তৃক তিরস্কৃত ও নিন্দিত হইতেছেন। লজ্জায় আমাদের মাথা অবনত হইয়া যাইতেছে। পয়সার জন্য যদি এরূপ করিতে হয় তবে চুরি-ডাকাতি বা জাল জুয়াচরি করিলে ইহা অপেক্ষা বেশি রোজগার হইতে পারে।’
বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের মেরুকরণ বুঝতে মাথায় রাখা দরকার যে বাসনা আর রাজনীতি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সেলবর্সী আজীবন চিরকুমার ছিলেন, আর নজরুল ছিলেন প্রেমিক। কিন্তু এই ব্যক্তিজীবনীর বাইরেও রাজনীতির সঙ্গে বাসনানীতির গহিন সম্পর্ক কীভাবে তাঁদের রাজনীতি গঠন করেছে, সেটা স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয়।
১৯২৯ সালে নজরুলকে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ঢাকার ‘জাগরণ-গোষ্ঠী’ ও কলকাতার ‘সওগাত-গোষ্ঠী’ উদ্যোগ নেয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদ, হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল ফজল, আনোয়ার হুসেন, আবদুল কাদির প্রমুখ।
সংবর্ধনার দিন যতই কাছিয়ে এল, নজরুলবিরোধীরা ততই জিব শানাতে লাগলেন। অক্টোবর মাসে সেলবর্সীর আল মুসলিম পত্রিকায় লেখা হলো যে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা মৌলবি মাহমুদর রহমানের সভাপতিত্বে এক সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে নজরুল যেহেতু ‘তাহার বিভিন্ন কবিতায় ইসলামের মূল শিক্ষার উপর অতি জঘন্য ভাষায় ও কঠোরভাবে আক্রমণ করেছেন… প্রতিমা পূজা প্রভৃতি ইসলামবিরোধী অনাচারের প্রশ্রয় দিয়াছেন, সেইজন্য মাদ্রাসায়ে আলীয়ার ছাত্র-বৃন্দের এই সভা তাঁহার সম্বর্ধনা প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ’ করে।
মোহাম্মদী পত্রিকাও নজরুলের সংবর্ধনার বিরুদ্ধে তোপ দাগাতে থাকে। লেখে, ‘নজরুল খোদার বিরুদ্ধে এবং শরিয়তের বিরুদ্ধে অতি ধৃষ্টতার সহিত বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছেন।’ নজরুলের ব্যক্তিক ও পারিবারিক জীবনকে নিশানা করে লেখে যে ‘ব্যক্তিগত জীবনের হিসাবে তাঁহার আদর্শ সমাজের পক্ষে অতিশয় ক্ষতিজনক।’ এমনকি নজরুলের প্রস্তাবিত সংবর্ধনায় কেউ আয়োজন বা যোগদান করলেও তারা ‘ধর্ম্মদ্রোহিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতায় সমর্থন করিতেছেন’ বলে ধরা হবে। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার সে বয়ান নিজ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রণ করেন সেলবর্সী। ধর্মচ্যুত করার হুমকিটা এসব বয়ানে প্রকাশ্য।
তবে সেসব হুমকি গায়ে না মেখে সংবর্ধনা হলো। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও সুভাষচন্দ্র বসু বক্তব্য দেন। সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি হিসেবে অভিনন্দনপত্র পড়েন শেখ ওয়াজেদ আলী।
নজরুলের সংবর্ধনার বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হলেন না সেলবর্সী। ভাবাদর্শিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি বহুদূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন। একদা সেলবর্সী নিজে ইংরেজের কারাগারে কারাবরণ করেছেন। কিন্তু এবার তিনি কলোনিয়াল রাষ্ট্রের হয়ে দুশমন-দমনে রত হলেন। নজরুল ও মুজফ্ফর এমনিই সরকারের নিশানায় ছিলেন। জেলখাটা নজরুল ১৯২৫ সালেও লিখেছেন, ‘শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?’ মুজফ্ফরও ১৯২৪ সালে জেল খেটেছেন। মুজফ্ফরের সংগ্রামী সত্তা সম্পর্কে নজরুল ১৩৩৩ সনে (১৯২৬ সালে) লিখেছেন:
‘আমি হলফ করে বলতে পারি মুজফ্ফরকে দেখলে লোকের শুষ্ক চক্ষু ফেটেও জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী আত্মভোলা মৌন কর্মী, এমন সুন্দর প্রাণ, এমন ধ্যানীর দূরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা—সবচেয়ে এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কি করে জন্মাল গোঁড়া মৌলবির দেশে নোয়াখালিতে, এই মোল্লা-মৌলবির দেশ বাংলায়, তা ভেবে পাইনে।...এই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার দিনে যদি কারুর মাথা ঠিক থাকে, তা মুজফ্ফরের।...যারা তাদের ত্যাগের মহিমাকে মলিন করল না আত্মবিক্রয়ের অর্থ দিয়ে—তাদের অন্যতম হচ্ছে মুজফ্ফর। মুজফ্ফর কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র কেসের দণ্ডভোগী অন্যতম আসামি এবং বাংলার সর্বপ্রথম মুসলমান স্টেট প্রিজনার।’ (‘“গণবাণী” ও মুজফ্ফর আহমদ’)
এবার উপনিবেশি সরকার ও সেলবর্সী উভয়ের যুগপৎ নিশানা হলেন মুজফ্ফর। সে সময় ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট দমনে উঠেপড়ে লেগেছে। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে অনেক বামপন্থী শ্রমিক সংঘের নেতাদের আসামি করে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়। মুজফ্ফরও সে মামলায় আসামি সাব্যস্ত। একদিন মুজফ্ফর দেখলেন, আদালতে হাজির আর কেউ নয়, তাঁরই পুরাতন সহকর্মী সেলবর্সী। আদালতে সেলবর্সীকে দেখে তিনি অবাক। তিনি মুজফ্ফরের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের হয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন। মুজফ্ফরের লেখা আদালতে চিনিয়ে দেবেন সেলবর্সী। ‘অবলীলাক্রমে আমার সব লেখা চিনিয়ে দিয়ে তিনি মোটা রাহা খরচ নিয়ে চলে গেলেন।’ মুজফ্ফর লিখেছেন সেলবর্সীর ‘চালচলন ভাল’ ছিল না এবং ‘রাজনীতিতে তাঁর পতন ঘটেছিল’।
এমনকি নজরুলের প্রস্তাবিত সংবর্ধনায় কেউ আয়োজন বা যোগদান করলেও তারা ‘ধর্ম্মদ্রোহিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতায় সমর্থন করিতেছেন’ বলে ধরা হবে। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার সে বয়ান নিজ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রণ করেন সেলবর্সী। ধর্মচ্যুত করার হুমকিটা এসব বয়ানে প্রকাশ্য। তবে সেসব হুমকি গায়ে না মেখে সংবর্ধনা হলো।
সাক্ষ্য দিয়েই থামেননি সেলবর্সী, বরং নিজ সম্পাদিত আল মুসলিম পত্রিকায় সাবেক সহকর্মী মুজফ্ফরের আমল-আকিদা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুণ্ডপাত করে লিখলেন:
‘বাংলার কম্যুনিষ্ট দলের নেতা মিঃ মুজাফফর [হুবহু] মীরাট ষড়যন্ত্রের মামলার আসামীরূপে সেদিন বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে যাহা বলিয়াছেন, তাহা শুনিয়া আমরা দেশের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া শঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছি। সেদিন স্থানীয় আদালৎ গৃহে দাঁড়াইয়া তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন, “আমার জাতি কি, তাহা আমি জানি না, আমার ধর্ম্মমত নাই, ধর্ম্মে বিশ্বাসও আমার নাই” ইত্যাদি।’
এই লেখায় সেলবর্সী আরও বলেছেন, মুজফ্ফরকে যেদিন তিনি সহকর্মী রূপে পেয়েছিলেন, তখন ‘তাঁর ভাব-গতিক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল।’ সে সময় তিনি একজন ‘খাঁটি ইমানদার নামাজী মুসলমান’ ছিলেন। তারপর ‘রুসের কতিপয় ভ্রান্ত লেখকের নাস্তিক্য-পূর্ণ’ ও গোমরাহী ‘পুস্তক-পুস্তিকা’ পড়ে তিনি ‘গণবাণী’ পত্রিকায় ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড’ শুরু করেন। সেলবর্সী আফসোস করলেন যে এই রুসের বইপত্র ‘মুজাফফরের মত জগতের কোটি কোটি তরুণের মস্তক চর্বণ’ করছে। সেলবর্সী কমিউনিস্ট মতবাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা আকারে দেখেছেন নারী প্রশ্নকে। তাঁর মতে কমিউনিজম ‘মাতৃ-জাতিকে তার অমূল্য সতীত্ব ও মাতৃত্ব হইতে বঞ্চিতা’ করছে ও ‘তাঁহাদের নিকৃষ্ট হায়ওয়ানে’র জীবন যাপন করাচ্ছে। এভাবে যে ব্রিটিশ তাঁকে আফগানিস্তানে হিজরতের কালে জেল খাটিয়েছিল সেই সরকারের হয়েই মুজফ্ফরকে জেলে দিতে সহায়তা করলেন সেলবর্সী।
উপসংহার-চিহ্ন ও জমায়েত
বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিক জনপরিসরের শরিকানায় কীভাবে ভাবাদর্শিক মেরুকরণ স্পষ্ট হলো, তা নিয়ে এই লেখা একটা অণু-রেখাচিত্রস্বরূপ। নজরুল ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী। আর সেলবর্সী চেয়েছিলেন মুসলমান সমাজকে আকিদা-আমলের দ্বারা একধরনের নিখিল-খেলাফতি পরিচয়বাদে বাঁধতে। কেউ কেউ বলেন, নজরুল নাকি সেলবর্সীকে প্রিয় বন্ধু হিসেবে জগলুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। জানি না তা সত্য কি না। আমি শেষ সওগাত কাব্যে সংকলিত “নবযুগ” কবিতায় দেখছি সেলবর্সী নয়, বরং এ কে ফজলুল হককে নজরুল জগলুল বলেছেন। ‘সে যুগের ওগো জগলুল! আমি ভুলি নি তোমার স্নেহ!/ স্মরণে আসিত তোমার বিরাট হৃদয়, বিশাল দেহ!’ ফজলুল হকের বিপদের দিনেই তিনি তাঁকে প্রবীণ বনস্পতি বলে অভিহিত করে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন।
তবে মোল্লাপন্থী বনাম মোল্লাবিরোধী কিংবা আধুনিক বনাম প্রাচীনপন্থী, এমন কোনো দ্বিভাজনকে স্থির-নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তার কারণ, এখানে নানা দ্বন্দ্ব, নানা ভেদ, নানা কালিকতা পরস্পর এক মোহনায় মিশেছে। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের পথে মনসুর, শামসুদ্দীন ও সেলবর্সী গিয়েছেন, নজরুল যাননি। বিশ থেকে চল্লিশের দশকে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সঞ্চারপথের নানা ফিরিস্তি কষাই যায়। কাউকেই কোনো তকমা বা তালিকায় শতভাগ অবসিত করা সম্ভব নয়।
একদিন মুজফ্ফর দেখলেন, আদালতে হাজির আর কেউ নয়, তাঁরই পুরাতন সহকর্মী সেলবর্সী। তিনি মুজফ্ফরের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের হয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন। মুজফ্ফরের লেখা আদালতে চিনিয়ে দেবেন সেলবর্সী। ‘অবলীলাক্রমে আমার সব লেখা চিনিয়ে দিয়ে তিনি মোটা রাহা খরচ নিয়ে চলে গেলেন।’
পরিচয়বাদী চিহ্নতন্ত্রের প্রশ্নে মতের বৈচিত্র্য ছিল চওড়া পাল্লার। ভাষারীতির প্রশ্নে ছিল নানা পথ। কেউ আরবি-ফারসি শব্দ বর্জন করে লিখতেন। কেউ, যেমন আবুল মনসুর আহমদ ভাষা ও শব্দে ভৌগোলিক-সাম্প্রদায়িক একধরনের বিভাজনের রূপকায়ন করতেন সচেতন সিদ্ধান্তেই। চিহ্নকেন্দ্রিক ‘স্কিজমোজেনেসিস’ বা বিভেদ-বিস্তার অনিবার্য হয়ে উঠছিল ক্রমেই। নজরুলের অবস্থান ছিল চিহ্নতান্ত্রিক গণ্ডিকে, উপচে ওঠা লক্ষণা দিয়ে উজিয়ে যাওয়া।
নজরুল বদ্ধ-জমায়েতের মানুষ ছিলেন না, ছিলেন মুক্ত-জমায়েতের মানুষ। জাত ও ধাতের নিকুচি করা মানুষ। কবীর বা লালন ফকিরের যুগে জাত হাজির ছিল একপ্রকারের ব্রাহ্মণ্যবাদী জৈব অণু-শাসন আকারে, আর নজরুলের যুগে তা হাজির হয়েছিল রাষ্ট্রনৈতিক জমায়েত-বন্দীর যুক্তি রূপে। জাতের নামে বজ্জাতিকে তিনি নাকচ করতে চেয়েছেন। তিনি জমায়েত থেকে জমায়েতে ছুটে বেড়াতেন, গণ্ডি ভাঙতেন, বিরোধকে একঠাঁই করতেন অট্টহাসিতে।
আধুনিক প্রযুক্তি, পত্রিকা, আন্দোলন নতুন যে জনতাকে কিউরেট/সঞ্চয়ন করেছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা ও মফস্সলে তা রূপ নিল জমায়েত বা ভিড়ে। অসহযোগ বা তর্কে মোয়ালাত ও খেলাফতের আন্দোলন সেই জমায়েতকে পরিণত করল জঙ্গম এক বিপ্লবী জনতায়। বিদেশি পণ্য বিক্রির পিকেটিংয়ে, অহিংস অসহযোগে, সালিস বিচারের দ্বারা কায়েমি শাসনের অস্বীকৃতিতে, কৃষক প্রজার উত্থানে ছিল সেই জনতার স্ফূর্তি। নজরুল ছিলেন এই সচল উদ্দামমুক্ত জমায়েতের সাধক। তিনি এর গঠনকর্তা নন, নিয়ন্তা নন, নেতা নন। তিনি এর প্রাণের কণ্ঠ। নজরুলের বাসনার যে মেটোনিমিক চলন, তা বদ্ধ-জমায়েতের বিধিবদ্ধতাকে অর্গলমুক্ত করত। বিশের দশকের শেষ নাগাদ যখন রাজনৈতিকভাবে বদ্ধ-জমায়েতের বিজয় হচ্ছে, তারপর থেকে নজরুলকে অনেকটা গুটিয়ে যেতে হলো।