সর্বজ্ঞ লুক্রিশাস ও তাঁর ‘দে রেরাম নাতুরা’

জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জীবন উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জি এইচ হাবীব -এর নিয়মিত পাক্ষিক— মৃদুল মধুর সন্তরণ

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

গর্বভরে নিজেকে পজিয়াস ফ্লোরেনটিনাস বা ফ্লোরেন্সের পজো বলে পরিচয় দিতেন তিনি। পুরো নাম জাম ফ্রানচেস্কো পজো ব্রাচ্চলিনি (১৩৮০-১৪৫৯)। ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে এই ভদ্রলোকের হাতে এসে পড়ে ‘দে রেরাম নাতুরা’ (De rerum natura) নামের প্রাচীন ও অত্যন্ত বিখ্যাত লাতিন গ্রন্থের একটি কপি; লেখক তাইতাস লুক্রিশাস কারুস (আনুমানিক ৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে অক্টোবর ১৫, ৫৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। তবে সারা দুনিয়ায় তিনি স্রেফ লুক্রিশাস নামেই মশহুর। 

বইটির বিষয়ে বিশদে যাওয়ার আগে ফ্লোরেন্সের পজো সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। বহু গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ ছিলেন তিনি: পর্যটক, রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদী, প্রায় জাদুকরি ক্ষমতাসম্পন্ন একজন ক্যালিগ্রাফার, রেনেসাঁ যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত কৌতুকগ্রন্থ ‘ফেসিশিয়ে’র (Facetiae) রচয়িতা। এ ছাড়া তিনি ছিলেন পরপর কয়েকজন পোপের স্ক্রিপটর। মানে, তাঁর কাজ ছিল পোপীয় আমলাতন্ত্রের দাপ্তরিক নথিপত্র লেখা। পেশাগত কাজে বিচক্ষণতা ও চাতুর্যের পরিচয় দিয়ে তিনি লোভনীয় অ্যাপস্টলিক সেক্রেটারি পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এটা বাহ্য। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন পাকা গ্রন্থশিকারি। সম্ভবত, এ-কাজে তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো আর কাউকে পাওয়া যাবে না। 

কবি ও পণ্ডিত পেত্রার্ক ১৩৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে লিভির ‘রোমের ইতিহাস’ (Ab Urbe Condita) নামক মহাগ্রন্থের প্রায় দেড় শত খণ্ডের মধ্যে টিকে থাকা ৩৫ খণ্ড সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেন। সেই সঙ্গে তিনি সিসেরো ও প্রপারতিয়াসের বিস্মৃত মাস্টারপিসগুলো উদ্ধার করেন। তাঁর এসব গৌরবজনক কাজের পর থেকে ইতালীয়রা যেন গ্রন্থশিকার নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তারা পেত্রার্কের ওই কীর্তির পর থেকে, লুপ্ত সব ধ্রুপদি গ্রন্থ খুঁজে বের করায় অনুপ্রাণিত হয়—উদ্ধারের আগে যেসব বইয়ের কয়েকটি এমনকি বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে অপঠিত ছিল। অতঃপর, পুনরুদ্ধার করা বইগুলো নকল করা হলো, সম্পাদনা করা হলো, তাতে টীকা-টিপ্পনীও যুক্ত হলো এবং সেসব বই যাঁরা পুনরুদ্ধার করেছিলেন, তাঁদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করা হলো। এভাবেই পরবর্তীকালে জ্ঞানের যে শাখা ‘মানববিদ্যা’ নামে অভিহিত হবে, তার ভিত্তি রচিত হলো এবং মানবতাবাদী বা মানবহিতৈষীরা (humanists) অর্থাৎ যাঁরা এই বিদ্যার চর্চায় নিজেদের নিবেদিত করেছিলেন, তাঁরা ক্ল্যাসিক্যাল রোমক যুগে রচিত হওয়া টেক্সটগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়নের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে একসময়ের বহু বিখ্যাত গ্রন্থ বা গ্রন্থের অংশবিশেষ তখনো বেপাত্তা হয়ে আছে।

মানবতাবাদী হিসেবে পজোর কিছু বড় কীর্তি রয়েছে। তিনি রোম আর কার্থেজের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে রচিত একটি মহাকাব্য (সিলিয়ুস ইতালিকুস রচিত ‘পিউনিকা’) আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সঙ্গে সম্রাট নিরোর শাসনামলের এক প্রাচীন সাহিত্য সমালোচকের কিছু কাজ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ধ্রুপদি যুগের লেখকদের রচনার টীকা-টিপ্পনী রচনা করেছিলেন। হোমারের অনুকরণে লেখা একটি মহাকাব্য থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি লিপিবদ্ধকারী এক লেখককে আবিষ্কার করেছিলেন। রোমক সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ এক সামরিক কর্মকর্তা আমিয়ানুস মার্সেলিনাসের লেখা রোমক সাম্রাজ্যের একটি ইতিহাস গ্রন্থের বড়সড় একটা অংশ দিনের আলোয় ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি, যে বইয়ের কথা সে সময় কারোরই জানা ছিল না। তা ছাড়া, ১৪১৬ খ্রিষ্টাব্দে সন্ত গল মঠে পজো আবিষ্কৃত কাব্যশাস্ত্রবিদ কুইন্টিলিয়ানের একটি পূর্ণাঙ্গ টেক্সট (১২ খণ্ডবিশিষ্ট ‘ইনস্তিতিউতো ওরাতোরিয়া’) সারা ইউরোপের আইনশাস্ত্রের বিদ্যায়তন স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম বদলে দিয়েছিল। এ ছাড়া ১৪১৪ সালে সুইজারল্যান্ডের এক মঠে পজোর আবিষ্কার করা স্থাপত্য নিয়ে লেখা ‘দে আর্কিতেক্তুরা’ প্রবন্ধগ্রন্থটি (De Architectura) ভবন নির্মাণের কৌশলই পাল্টে দিয়েছিল। কিন্তু ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পজো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি করেন: টি লুক্রেতি কারি বা লুক্রিশাস রচিত ‘দে রেরাম নাতুরা’। এবারও একটি মঠের গ্রন্থাগারে তিনি পেয়ে যান এই দীর্ঘ গ্রন্থ, যেটার নামের উল্লেখ পজো অন্য কিছু প্রাচীন বইপত্রে পেয়েছিলেন বলে আবছাভাবে তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল। 

সত্যি বলতে, লাতিনে লেখা এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক রচনাটি ‘দে রেরাম নাতুরা’, বা, ‘বস্তুর প্রকৃতি প্রসঙ্গে’ কাব্যিক ধারা বা ঐতিহ্যেরও অন্তর্ভুক্ত, কারণ এটি একটি দীর্ঘ ষটপদী উপদেশাত্মক কবিতা; ভার্জিল তাঁর ‘ইনিড’ মহাকাব্যেও একই মাত্রা ব্যবহার করেছিলেন। লুক্রিশাস গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাসের (৩৪১-২৭০ খ্রিষ্টর্পূবাব্দ) প্রবল অনুরাগী ছিলেন। আজ মানুষ এপিকিউরাস বলতে ‘আনন্দই পরম মঙ্গল বা শুভ’ নীতির প্রবক্তাকে বোঝে; আর তাই আনন্দপ্রেমী মানুষকে কখনো কখনো এপিকিউরীয় বলেও অভিহিত করা হয়। কিন্তু তাঁর দর্শনের এই দিক নিয়ে লুক্রিশাসের মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর দৃষ্টিতে এপিকিউরাস ছিলেন সেই মানুষ যাঁর ক্ষমতা ছিল ডিমোক্রিটাসের পরমাণুবাদী তত্ত্বের খানিকটা সংশোধিত রূপ ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তিসিদ্ধভাবে অর্থাৎ দেবকুল ও নানা অজ্ঞাত শক্তি সম্পর্কে যাবতীয় ভীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে—গোটা জগৎকে ব্যাখ্যা করার। কবিতার প্রায় শুরুতে একটি চরণ দেখতে পাই আমরা: religio potuit suadere malorum, মানে, ‘তো, ধর্ম এই পরিমাণ অমঙ্গল ঘটাতে পেরেছে’। লাতিন শব্দবিন্যাস অনুযায়ী কথাটা হবে, ‘ধর্ম-এই-পরিমাণ-করতে-পেরেছে-অমঙ্গল’।

মহাবিশ্বের অসীমসংখ্যক পরমাণুর দিকে লুক্রিশাসের অঙ্গুলি নির্দেশ

‘দে রেরাম নাতুরা’ খুব সহজপাচ্য জিনিস নয়। বস্তুর প্রকৃতিবিষয়ক এই রচনা ছয়টি খণ্ড বা পর্বে বিভক্ত, প্রতিটিতেই রয়েছে সহস্রাধিক চরণ। প্রথম দুই পর্ব পরমাণু এবং কী করে জগতের সবকিছু তা দিয়ে গড়ে উঠল আর কী করেই বা শেষ অবধি সবকিছু ভেঙেচুরে সেই পরমাণুতেই ফিরে যায়, তা নিয়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব আত্মা, ইচ্ছা ও সংবেদন বা বোধ নিয়ে; আর সেখানে, আমাদের যেসব অভিজ্ঞতা হয়, আমরা যা অনুভব করি, সে সম্পর্কে বস্তুগত ও যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্ব মহাজগৎ আর মানুষের ওপর যেসব বাহ্যিক শক্তি কাজ করে, যেমন খারাপ আবহাওয়া ও অসুস্থতা, এসব নিয়ে। এখানে প্লেগ বা মহামারিকে মন্দ বায়ু ও সংক্রমণের পরিবহন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যার সঙ্গে মানুষকে দেবতাদের দেওয়া শাস্তির কোনো সম্পর্ক নেই। 

মাঝেমধ্যে লুক্রিশাস গ্রিক বৈজ্ঞানিক পরিভাষাকে লাতিনে স্থানান্তর করার সমস্যায় পড়ে যান, আর তা নিয়ে আসলে অভিযোগও করেন। একপর্যায়ে তিনি patrii sermonis egestas বা ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভাষার দারিদ্র্য’ নিয়ে কথা বলেন। বইটির কিছু কিছু অংশ—যেমন ভূমিকাটি—লাতিনে যা কিছু রচিত হয়েছে, তার মধ্যে সেরা এবং লাতিন কাব্যের মহান শিল্পী ভার্জিল লুক্রিশাসের লেখা পড়ে অনেক কিছু শিখেছেন বলে স্বীকার করেছেন। 

লুক্রিশাস বলেন, মহাবিশ্ব অসীমসংখ্যক পরমাণু দিয়ে তৈরি। আর এসব পরমাণু মহাশূন্যজুড়ে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে; সূর্যের আলোকরশ্মিতে এসব ধূলিকণাকে আমরা যে রকম যথেচ্ছভাবে চলেফিরে বেড়াতে দেখি, সেভাবে সৃষ্টি আর ধংসের এক অন্তহীন প্রক্রিয়ায় পরমাণুগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে, আটকে যাচ্ছে, আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া থেকে কোনো নিস্তার নেই। তিনি আরও বলেন, রাতের আকাশের দিকে মুখ তুলে এন্তার নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আমরা যখন অবাক হয়ে যাই, তখন কিন্তু আমরা দেবতাদের কোনো হাতের কাজ বা স্ফটিকনির্মিত গোলক দেখি না। বরং ঠিক সেই বস্তুজগৎকে দেখি যার অংশ আমরা এবং এই বস্তুজগতের মৌলকণাগুলো দিয়েই আমরা তৈরি। এখানো কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই, নেই কোনো ঐশী স্থপতি। লুক্রিশাস বলেন, প্রকৃতি নিরন্তর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যায় এবং আমরা হচ্ছি সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অগুনতি ফলাফলের অংশ। আমরা যে প্রজাতির সদস্য, সেটাসহ সবকিছুই দীর্ঘ সময় ধরে বিবর্তিত হয়েছে। যদৃচ্ছভাবে ঘটে, তবে সপ্রাণ জীবসত্তা বা লিভিং অরগানিজমের ক্ষেত্রে এই বিবর্তনের সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়া জড়িত থাকে। যেসব প্রজাতি বেঁচে থাকার উপযোগী এবং সাফল্যের সঙ্গে বংশবৃদ্ধি করতে পারে সেগুলেই টিকে থাকে, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। যেগুলো ততটা উপযোগী নয়, সেগুলো দ্রুত ঝরে যায়। আমরা দৃশ্যপটে আসার আগে অন্য অনেক প্রজাতি বিদ্যমান ছিল, সেগুলো বিদায়ও নিয়েছে; আমাদেরটিও একদিন অন্তর্হিত হবে। আমাদের প্রজাতি থেকে শুরু করে সূর্য অবধি কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কেবল পরমাণুই চিরজীবী।

আরও পড়ুন

এই কথার খেই ধরে লুক্রিশাস বলেন, যে মহাবিশ্ব এভাবে গঠিত, সেখানে এমনটা ভাবা বাতুলতা যে পৃথিবী আর তার অধিবাসীরা সবকিছুর কেন্দ্রে অবস্থিত বা মানুষকে ঠাঁই করে দেওয়ার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে জগৎসংসারটা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে ভাবার কোনো যুক্তি নেই; কোনো দেব-দেবীকে ‘ঘুষ’ দেওয়া বা তুষ্ট করার কিছু নেই; ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো অবকাশ নেই, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কারণে জাগতিক আরাম-আয়েশ, আনন্দ পরিহারের কৃচ্ছতাসাধনকারী কোনো আহ্বান নেই; নেই সীমাহীন ক্ষমতা, নিখুঁত নিরাপত্তার স্বপ্ন দেখার যৌক্তিক কোনো কারণ; বিজয় অর্জনের জন্য কোনো যুদ্ধ বা আত্মগরিমার সঙ্গত কোনো কারণ নেই; প্রকৃতিকে টেক্কা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি লিখেছেন, তার বদলে মানুষের উচিত হবে নিজের ভয়কে জয় করা, এটা মেনে নেওয়া যে তারা নিজেরা এবং তারা যত কিছুর মুখোমুখি হয়, সবই ক্ষণস্থায়ী; উচিত জগতের সৌন্দর্য ও আনন্দকে আলিঙ্গন করা। 

অতএব, ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন লুক্রিশাসের সেই দীর্ঘ কবিতা পাঠকের কাছ ফিরে এল, তখন বিশেষ করে খ্রিষ্টমতাবলম্বী পাঠককুল বড়সড় একটা ধাক্কা খেল: রক্তস্নাত যিশুর প্রতিচ্ছবিতাড়িত, নরকের আতঙ্কে জবুথবু এবং মৃত্যুপরবর্তী পার্গেটরির আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চিন্তায় আচ্ছন্ন লোকজনের কাছে লুক্রিশাস এক ভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিলেন: মৃত্যুপরবর্তী জীবন বলে কিছু নেই, ওপর থেকে পুরস্কার আর তিরস্কার ও শাস্তি প্রদানের কোনো বালাই নেই। দেবতারা, কেবল দেবতা হওয়ার কারণেই, মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ে একেবারেই নিস্পৃহ।

তরে ইয়নসন (জন্ম: ১৯৩৬)—সুইডিশ ভাষাতাত্ত্বিক।
ছবি: উইকিপিডিয়া

কিন্তু ফ্লোরেন্সের পজো ‘দে রেরাম নাতুরা’ জনসমক্ষে ফিরিয়ে আনার ছয় কি সাত দশকের মধ্যে লুক্রিশাসের এই পরমাণুবাদকে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা শুরু হলো। পরমাণুবাদী বইপত্র পোড়ানো হতে লাগল, ফ্লোরেন্সের যাজকগোষ্ঠী বিদ্যায়তনে লুক্রিশাস পড়ানো নিষিদ্ধ করল। প্রটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিক মতবাদের ওপর আক্রমণ শানানো শুরু করলে এই হুমকির বোধটা তীব্র হয়ে ওঠে। প্রটেস্ট্যান্টদের আক্রমণটা অবশ্য পরমাণুবাদভিত্তিক ছিল না; লুথার, জুইংলি ও কেলভিন মোটেই এপিকিউরীয় ছিলেন না; কিন্তু রিফরমেশন-বিরোধী যুদ্ধংদেহি শক্তির কাছে মনে হলো যে প্রাচীন পরমাণুবাদ যেন একটা বিপজ্জনক দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলেছে। ফলে এক হিংস্র সংকল্পবদ্ধতা নিয়ে চার্চ এই পরমাণুবাদের বিপক্ষে দাঁড়াল এবং তার মতাদর্শভিত্তিক বাহু ইনকুইজিশনকে লেলিয়ে দিল পরমাণুবাদের যেকোনো ধরনের বাড়বাড়ন্তের নিশানা শনাক্তকরণের কাজে। 

কিন্তু কবিতার কণ্ঠকে কি আর এত সহজে রুদ্ধ করা যায়? চার্চ যখন সেটাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় রত, এক তরুণ ফ্লোরেন্সবাসী তখন নিজের জন্য পুরো ‘অন দ্য নেচার অব থিংস’ নকল করছেন বসে বসে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তিনি যেসব বিখ্যাত বই রচনা করবেন, সেখানে সরাসরি এই বইয়ের নাম উল্লেখ না করার মতো যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞান তাঁর ছিল। কিন্তু তাঁর হাতের লেখা ১৯৬১ সালে সন্দেহাতীতভাবে শনাক্ত করা গেছে। ‘অন দ্য নেচার অব থিংস’ নিজের হাতে লিখে নকল করা মানুষটি আর কেউ নন, ‘দ্য প্রিন্স’ নামের ভুবনবিখ্যাত বইয়ের লেখক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। টমাস মোর তাঁর ‘ইউটোপিয়া’য় আরও খোলাখুলিভাবে এপিকিউরীয়বাদ নিয়ে কাজ করেছেন। সেই কাল্পনিক জগতের বাসিন্দারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ‘মানুষের সুখের পুরোপুরি বা অনেকাংশই’ নিহিত রয়েছে আনন্দ অন্বেষণের মধ্যে, আর সেটাই ‘ইউটোপিয়া’। এই অচিন দ্বীপের মানুষদের ক্ষেত্রে দর্শনটির ব্যবহার বুঝিয়ে দিল যে মানবতাবাদীদের হাতে পুনরুদ্ধার হওয়া ধারণাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তখনো পুরোপুরি উদ্ভট। ইউরোপের শোণিতপ্রবাহে বহু শতাব্দী পর আবারও প্রবিষ্ট হওয়া সেই সব ধারণা ছিল আসলে আরেক জগৎ থেকে আসা কণ্ঠস্বর, যে জগৎ ঠিক ততটাই ভিন্ন, যতটা ভিন্ন ভেসপুচ্চির ব্রাজিল থেকে ইংল্যান্ডের জগৎ। 

সে যা-ই হোক, কবিতাটি ছড়িয়ে গেল ‘সবখানে’ না হলেও, বহু স্থানে এবং সেই সঙ্গে সেটার অন্তর্হিত ধারণাগুলোও ছড়িয়ে গেল জনসংস্কৃতির ভেতরে, ষোড়শ শতকের শেষ দশকে লন্ডনের মঞ্চে, শেক্‌সপিয়ারের ‘রোমিও এবং জুলিয়েট’ নাটকে, কুইন ম্যাব সম্পর্কে রোমিওকে দেওয়া মারকুশিওর বর্ণনায়—

‘She is the fairies’ midwife, and she comes

In shape no bigger than an agate stone

On the forefinger of an alderman,

Drawn with a team of little atomi

Athwart men’s noses as they lie asleep.’

আরও পড়ুন

লুক্রিশাসের বস্তুবাদ সম্পর্কে নিজের আগ্রহের কথা ‘রোমিও এবং জুলিয়েট’-এর রচয়িতা অনেককেই বলেছিলেন; তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এডমান্ড স্পেনসার, জন ডান ও ফ্রান্সিস বেকন। বিষয়টি নিয়ে নাট্যকার বেন জনসনের সঙ্গেও তাঁর আলাপ হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়, কারণ বেন জনসন স্বাক্ষরিত ‘অন দ্য নেচার অব থিংস’-এর একটি কপি কালের দংশন উপেক্ষা করে টিকে গেছে এবং বর্তমানে সেটা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাফটন গ্রন্থাগারে শোভা পচ্ছে। তা ছাড়া, শেক্‌সপিয়ার নিশ্চিতভাবেই তাঁর অন্যতম প্রিয় বই ‘মঁতেনের প্রবন্ধাবলি’তে লুক্রিশাসের মুখোমুখি হয়েছিলেন। 

১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত মতেঁর সেই বইতে ‘অন দ্য নেচার অব থিংস’ থেকে সরাসরি নেওয়া শ খানেক উদ্ধৃতি আছে। সেসব উদ্ধৃতি বাদ দিলেও মঁতে ও লুক্রিশাসের মধ্যে একটি গভীর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। লুক্রিশাসের মতো মতেঁরও পরকালের দুঃস্বপ্নতাড়িত নৈতিকতার ব্যাপারে একধরনের বিতৃষ্ণা ছিল; নিজের ইন্দ্রিয় আর বস্তুজগতের সাক্ষ্যপ্রমাণের গুরুত্বই বেশি ছিল তাঁর কাছে। কৃচ্ছসাধনকারী আত্মনিগ্রহ এবং রক্ত-মাংসের দেহের প্রতি সহিংসতা তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন। মানসিক মুক্তি ও তৃপ্তিকে খুব মূল্যবান জ্ঞান করতেন ভদ্রলোক। বিশেষ করে, মৃত্যুভয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে লুক্রিশাসের বস্তুবাদ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, শক্তি জুগিয়েছিল। একবার তিনি মুমূর্ষু এক লেখককে দেখেছিলেন যিনি তাঁর শেষ করে উঠতে না পারা বইটি নিয়ে ভীষণ আফসোস করছিলেন। মঁতের দৃষ্টিতে, এহেন আক্ষেপের যে কোনো মানে নেই, তা ফুটে উঠেছে লুক্রিশাসের এই কথাগুলোর মধ্যে—

‘But this they fail to add: that after you expire / Not one of all these things will fill you with desire.’

আর নিজের বেলায় তিনি বলছেন:

‘I want death to find me planting my cabbages, but careless of death and still more of my unfinished garden.’

স্টিফেন গ্রিনব্লাট (জন্ম: ৭ নভেম্বর ১৯৪৩)—মার্কিন ঐতিহাসিক ও লেখক
ছবি: উইকিপিডিয়া

সপ্তদশ শতকের মধ্যে এই কাব্যগ্রন্থের আকর্ষণ যেন তুঙ্গে ওঠে। মনীষাদীপ্ত জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক ও যাজক পিয়ের গ্যাসেন্দি এপিকিউরীয়বাদের সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মের সমন্বয় ঘটানোর এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রচেষ্টায় নিজেকে নিবেদিত করেন এবং তাঁর অনন্যসাধারণ ছাত্র নাট্যকার মলিয়ের ‘অন দ্য নেচার অব থিংস’-এর একটি কাব্য অনুবাদে হাত দেন (দুর্ভাগ্যবশত, সেটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি)। ইংল্যান্ডে একজন অর্থবান দিনলিপিকার জন ইভলিন লুক্রিশাসের কবিতাটির প্রথম অংশ অনুবাদ করেন এবং আইজ্যাক নিউটন নিজেকে পরমাণুবাদী বলে ঘোষণা দেন। পরের শতকে টমাস জেফারসনের কাছে ‘দে রেরাম নাতুরা’র অন্তত পাঁচটি লাতিন সংস্করণ ছিল, সঙ্গে সেগুলোর ইংরেজি, ইতালীয় আর ফরাসি তর্জমা। একজন সাংবাদিক তাঁকে তাঁর জীবনদর্শনের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন: ‘আমিও একজন এপিকিউরিয়ান।’ 

তবে ঊনবিংশ শতকে চার্লস ডারউইন যখন ‘অরিজিন অব স্পিসিস’-এর রহস্য উদ্‌ঘাটনে পা বাড়ান, তখন তাঁকে লুক্রিশাসের গভীর অন্তর্দৃষ্টিসঞ্জাত সৃষ্টি ও ধ্বংসের সেই একান্তই প্রাকৃতিক ও অপরিকল্পিত প্রক্রিয়া থেকে সাহায্য নিতে হয়নি, যা সেক্সুয়াল রিপ্রডাকশনের মাধ্যমে নবায়িত হয়। তবে সেই গভীর অন্তর্দৃষ্টি সরাসরি প্রভাবিত করেছিল চার্লস ডারউইনের পিতামহ ইরাজমাস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বগুলোকে; যদিও চার্লস ডারউইন তাঁর নিজের যুক্তিগুলো দাঁড় করিয়েছিলেন গ্যালাপেগস দ্বীপপুঞ্জ ও অন্যান স্থানে চালানো তাঁর অনুসন্ধান ও কাজের ওপর ভিত্তি করে। আইনস্টাইনও যখন পরমাণু বিষয়ে লিখছেন, তখন তিনি তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গাণিতিক বিজ্ঞানের ওপর ভর করেই লিখেছেন, প্রাচীন দার্শনিক অনুমান বা দূরকল্পনার ওপর ভিত্তি করে লেখেননি। তবে আইনস্টাইন এ কথা স্বীকার করেছেন যে সেই দূরকল্পনা সেই সব প্রমাণের দিকে নিয়ে গেছে যার ওপর আধুনিক পরমাণুবাদ দাঁড়িয়ে আছে। সেই প্রাচীন কবিতা যে এখন নিরাপদে বা নির্ভয়ে ভুলে যাওয়া যেতে পারে, সেটার হারানো ও পুনরাবিষ্কারের নাটক যে আজ বিস্মৃত হওয়া যেতে পারে, সেটাই আধুনিক চিন্তার ভেতর লুক্রিশাসের আত্মীভূত হওয়ার সবচেয়ে বড় চিহ্ন। 

(সূত্র: স্টিফেন গ্রিনব্লাটের ‘দ্য আনসারম্যান’ ও তরে ইয়নসনের ‘আ ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব ল্যাটিন’ অবলম্বনে।)