জন্মশতবর্ষে ফ্রানৎস ফানোঁ ও তাঁর বহমান উত্তরাধিকার (২)

জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জীবন উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জি এইচ হাবীব -এর নিয়মিত পাক্ষিক— মৃদুল মধুর সন্তরণ

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

উপনিবেশবাদ একটি নগ্ন সন্ত্রাস, যা কেবল তখনই নতি স্বীকার করে, যখন তা আরও বড় সন্ত্রাসের সম্মুখীন হয়। ফ্রাৎনস ফানোঁ এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে যেখানেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে, সেখানেই তাঁর এই ধারণা অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছে। ১৯৫৯ সালে গিনিতে পর্তুগিজ ধর্মঘটী শ্রমিকদের হত্যা কবি ও অ্যাকটিভিস্ট আমিলকার কাব্রালকে কূটনৈতিক আপস-আলোচনা পরিত্যাগ করে গেরিলাযুদ্ধে নামতে উদ্বুদ্ধ করে। তার এক বছর পর, ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলে পুলিশ বর্ণবাদবিরোধী শ খানেক কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে হত্যা করে, অনেকটা জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো। তারই প্রতিবাদে গান্ধীর এক শিষ্য নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে একটি সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘সরকারের সহিংসতা কেবল একটাই কাজ করে, আর তা হলো প্রতি-সহিংসতার জন্ম দেওয়া।’ প্রতি-সহিংসতাকে ফানোঁ অমানবিককৃত স্বদেশি মানুষদের জন্য বিশেষ একধরনের চিকিৎসা বা থেরাপি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মানুষকে এবং তার স্বজনদের যখন কুকুরের মতো নিধন করা হয়, তখন মানুষ হিসেবে তার গুরুত্ব পুনঃ স্থাপন করার জন্য হাতের কাছের প্রতিটি উপায় ব্যবহার করা ছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তর থাকে না।

ফানোঁর চোখে পশ্চিমা বুর্জোয়া মুখ্যত জাতিবিদ্বেষী। আর সেটার যে দুই বুর্জোয়া মতবাদ—‘সাম্য’ ও ‘মর্যাদা’, তা হচ্ছে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতার একটা মুখোশ মাত্র। তিনি যেন আগেভাগেই উপলব্ধি করছিলেন যে পশ্চিমের বস্তুগত ও মতবাদগত ভিত্তি হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁর অভিযোগ: ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য নির্বাসন বা দ্বীপান্তর, গণহত্যাকাণ্ড, জোরজবরদস্তিমূলক শ্রম, আর দাসব্যবস্থা জারি করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অনুন্নত দেশগুলোতে একেবারে সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের মতো আচরণ করেছে। তাদের জঘন্যতম অপরাধগুলো হচ্ছে এই যে তারা কৃষ্ণাঙ্গদের আত্মপরিচয়কে বিদীর্ণ করে দিয়েছে, আর তাদের অন্তর্জগতে হীনম্মন্যতার একটা বোধ চারিয়ে দিয়ে সেটাকে বিষময় করে ফেলেছে। ফানোঁ লিখছেন যে ইউরোপীয় চিন্তার জগতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেটি একান্তভাবেই ক্রমবর্ধমানভাবে ঘৃণ্য আত্মরতিমূলক, যেখানে নিরন্তরভাবে কেবল নিজের সঙ্গেই সংলাপ চলে।

আরও পড়ুন

একই সঙ্গে ফানোঁ উপনিবেশিতকে তাদের শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের দোষারোপ করতে নিষেধ করেন। বরং ঠিক তাই করতে সনির্বন্ধভাবে অনুরোধ করেন, যা সেই শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেটা হচ্ছে ‘মানুষের এক নতুন ইতিহাস’ গড়তে শুরু করা, যা শাশ্বত মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর দৃষ্টিতে, উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদ ‘ইউরোপ, আমাদের এবং মানবজাতির জন্য’ আমূল পরিবর্তনকামী মানবতাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।

তত দিনে তিনি জাতিগতভাবে নিরূপিত (আত্ম) পরিচয় এবং সংস্কৃতির দাবি থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, জাতিগত ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক ‘বিরাট শ্বেত বিভ্রান্তি’কে ‘বিরাট কৃষ্ণ মরীচিকা’ দিয়ে পুনঃ স্থাপন করা মোটেই উচিত হবে না। ফানোঁ বিশেষ করে তাঁর ‘ব্ল্যাক স্কিন, হো্য়াট মাস্কস’ গ্রন্থে ‘বিরাট শ্বেত বিভ্রান্তি’ বলতে উপনিবেশিত কিছু মানুষের এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের কথা বুঝিয়েছেন যে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের সঙ্গে, বিশেষ করে শ্বেত ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার মধ্যেই মুক্তি এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা নিহিত আছে; এই ভ্রান্ত বিশ্বাস অনুযায়ী, উপনিবেশ স্থাপনকারীদের মত-পথ-চলন-বলন অনুসরণ ও আত্মস্থ করার মধ্য দিয়েই উপনিবেশিত হওয়া সংশ্লিষ্ট নেতিবাচক ধ্যানধারণা আর অ-মানবিকায়নের হাত থেকে নিস্তার লাভ করা যাবে। তিনি এই ধারণার সমালোচনা করে বলেন যে এটি সেই ‘বিরাট কৃষ্ণ মরীচিকা’র জন্ম দেয়, যা একটি কালো আত্মপরিচয় বা সংস্কৃতিকে অতি রোমান্টিক চোখে দেখে বা সেটার সঙ্গে অতিরিক্ত রকমের একাত্মতা বোধ করে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে। উপনিবেশিতার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে প্রাক্‌-উপনিবেশ যুগে অতিসরলীকৃত প্রত্যাবর্তনের ওপর বিশেষ মনোযোগ ন্যস্ত করলে তা একটি বিভ্রান্তকারী বা অর্জন-অযোগ্য লক্ষ্যতে পর্যবসিত হতে পারে। একটি ‘মরীচিকা’য় পরিণত হতে পারে, যা একটি সত্যিকারের মুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জটিলতা থেকে দূরে সরে যায়।

তিনি তাঁর প্রথম বই ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’-এ (১৯৫২) লিখলেন, আমি কোনোভাবেই নিজেকে অন্যায়ভাবে উপেক্ষিত একটি কালো সভ্যতার প্রতি নিবেদিত হতে দেব না। আমি আমাকে কোনো অতীতের মানুষ হতে দেব না। মানুষের কাছে দাসব্যবস্থা আর সাম্রাজ্যবাদের ভয়াবহ সব তথ্য উন্মোচিত করে মানুষের মর্যাদাহানি করার চেষ্টারও কোনো অর্থ খুঁজে পাননি তিনি। তিনি বললেন, আমি কি আজকের শ্বেতাঙ্গ লোকজনকে সপ্তদশ শতকের দাস ব্যবসায়ীদের হয়ে জবাবদিহি করতে বলব? ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’-এ (১৯৬১) তিনি অতিরঞ্জিত স্পর্শকাতরতা, সংবেদনশীলতা ও সন্দেহপ্রবণতা নিয়ন্ত্রিত কোনো মনস্তত্ত্ব অবলম্বন করার ব্যাপারে অধিকারবঞ্চিতদের সতর্ক করে দিয়েছেন।

এশিয়া ও আফ্রিকাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দীর্ঘদিনের ভোগদখল শেষ হয়ে আসতে ফানোঁ একটি বিষয় নিয়ে বিশেষ চিন্তিত হলেন, আর তা হচ্ছে ‘স্বাধীনতার অভিশাপ’: এই আশঙ্কা যে দক্ষিণ গোলার্ধে জাতিত্ব (নেশনহুড) একটি শূন্য খোলসে পরিণত হতে পারে, যে খোলস হবে জাতিগত ও উপজাতীয় বৈরিতা, অতিজাতীয়তাবাদ, উগ্র দেশপ্রেম ও জাতিবিদ্বেষের আধার। নিশ্চিতভাবেই, দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ পড়ে প্রভাবিত ১৯৬০-এর দশকের লেখকেরা—যেমন আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী নাদিনে গর্ডিমার, আই কিউ আরমাহ এবং নগুগি ওয়া থিয়োংও, ক্যারিবীয় কবি এডুয়ার্ড গিসান্ট, গায়ানার সমালোচক ওয়াল্টার রডনি—বইটির মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের হত্যা করার কোনো প্ররোচনা দেখতে পাননি; বরং আবিষ্কার করেছিলেন উপনিবেশ-উত্তর দশার এক প্রবল অস্বস্তিকর নিদান: ফানোঁ যেন দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন পশ্চিমকে যে প্রবঞ্চনামূলক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ধনী ও ক্ষমতাবান বানিয়েছে, সেটা তারা কী করে বজায় রাখবে এবং উপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোতে নব্য শাসক শ্রেণিগুলো কী করে নিজেদের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হবে। ফানোঁর এই অলোকদৃষ্টি আর অবস্থার অগ্রগতির নিতান্তই শম্বুক গতির একটি প্রমাণ হচ্ছে প্রকাশের ৬০তম বছরেও দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ পশ্চিমে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের গোঁ আর অপেক্ষাকৃত ‘কৃষ্ণতর দেশগুলো’র নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা, এই দুইয়েরই একটি অত্যাবশ্যক নির্দেশিকা হয়ে আছে।

তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের ওপরতলার লোকজন সম্পর্কে ফানোঁর সন্দিগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে মূলত একজন পশ্চিমায়িত কালো মানুষ হিসেবে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই, যে কিনা বেড়ে ওঠার সময় তার নিজের কৃষ্ণত্বের কথা বিস্মৃত হয়েছিল। ১৯২৫ সালে মার্টিনিকের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ফানোঁ ফরাসি রিপাবলিকের গর্বিত নাগরিক ছিলেন। মঁতেস্কু আর ভলতেয়ার পড়ে বড় হয়েছেন তিনি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি উপনিবেশের অনেকের মতো মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আহত হয়েছিলেন অ্যালস্যাস-এ এবং যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য লাভ করেছিলেন কোয়া ডু গের (croix de guerre) পুরস্কার।

কিন্তু ১৯৪৬ সালে যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে মনোবিদ্যা পড়তে গিয়েই কেবল তিনি আবিষ্কার করেন যে শ্বেতাঙ্গদের চোখে তিনি একটা ‘নোংরা কালো মানুষ’ ছাড়া কিছু নন—একটা বর্বর, যে ধরনের বর্বর আফ্রিকায় বাস করে বলে তিনি ভাবতেন। ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস-এ তিনি  গোড়ার দিককার একটি মর্মাঘাত বা ট্রমার কথা উল্লেখ করেছেন; অসংখ্য উপনিবেশবিরোধী নেতা ও চিন্তকও একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন: তার ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তা এই: লিয়ঁতে একটি বাচ্চা মেয়ে তাঁকে দেখে বলে উঠেছিল, ‘মাম্মান, দেখো, একটা নিগ্রো; আমার ভয় লাগছে!’ ফানোঁ লিখছেন, আমি স্রেফ একজন মানুষ হতে চেয়েছিলাম, অন্য অনেক মানুষের মধ্যে। কিন্তু শ্বেতদৃষ্টি, যা কিনা একমাত্র বৈধ দৃষ্টি তাঁকে ‘নির্দিষ্ট’ করে দিয়েছিল, তাঁর কালো শরীর সম্পর্কে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে সচেতন করে দিয়ে, সেই সঙ্গে তার ইতিহাসকে নরমাংস ভক্ষণ, পশ্চাৎপদতা, বস্তুকাম (ফেটিশিজম) জাতিগত কালিমা, দাস ব্যবসায়ী’ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে।

আরও পড়ুন

যেসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা কালো মানুষকে ‘বিপর্যয়কারী বস্তু’তে নামিয়ে এনেছে, সে সম্পর্কে ফানোঁর ভালো ধারণা থাকলেও, তিনি নিজে মনোরাগ বিষয়ে প্রশিক্ষিত হওয়াতে ক্রীতদাসে পরিণতকারীরা ক্রীতদাসদের ওপর যেসব প্রতিচ্ছবি দেগে দেয়, সেসবের মনস্তত্ত্বগত শক্তি সম্পর্কে তিনি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। ফানোঁ জানতেন, যেসব কালো মানুষের মনের মধ্যে এসব প্রতিচ্ছবি আসন গেড়ে বসে আছে, সাদা মানুষদের হাতে সাদা মানুষদেরই জন্য তৈরি বিশ্বে সেই কালো মানুষেরা তাদের উপনিবেশিত সত্তা থেকে পালাতে পারবে না। সমাজ সংসারের আমূল পুনর্বিন্যাস করে এবং সেখানের মানুষজনকে শোষণ করে সাদা মানুষেরা কেবল অগাধ অঞ্চল জয় করেনি। সেই সঙ্গে এই দাবিও করেছে যে তারা একটি মানবিক সভ্যতার প্রতিনিধি, যা ব্যক্তির মুক্তির প্রতি নিবেদিত এবং বিজ্ঞান, যু্ক্তি-বুদ্ধি ও বিশিষ্ট কর্মদ্যোগের মতো উচ্চতর হাতিয়ারে সজ্জিত। ভি এস নাইপলের উপন্যাস ‘আ বেন্ড ইন দ্য রিভার’-এর আফ্রিকি বর্ণনাকারী মন্তব্য করে, ‘ইউরোপীয়রা অন্যদের মতোই সোনাদানা আর দাস চেয়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা দাসদের মঙ্গলের জন্য ভালো ভালো কাজ করা মানুষ হিসেবে নিজেদের মূর্তিও নির্মাণ করতে চেয়েছিল। স্বভাবতই ‘তারা দাস আর মূর্তি, দুটোই পেয়েছিল।’

উপনিবেশ স্থাপনকারীদের লোভ, ন্যায়পরায়ণতা ও সামরিক দক্ষতার এক অভূতপূর্ব মিশ্রণের দ্বারা আতঙ্কিত হয়ে কালো মানুষেরা কীভাবে ‘শ্বেতদৃষ্টি’ তাদের প্রতি যে ডিমোরালাইিজং জাজমেন্ট প্রদান করে, তা আত্মস্থ করে নেওয়ার প্রবণতা দেখায়, তার বিবরণ ফানোঁর লেখায় রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার যন্ত্রণার শুরু শ্বেতাঙ্গ না হওয়ার কারণে। কাজেই আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে শ্বেতাঙ্গ হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করব। কিন্তু অনুকরণ (মিমিক্রি) কখনো কখনো রোগটির চাইতেও খারাপ হতে পারে, যেহেতু তা বিদ্যমান জাতিগত শ্রেণিক্রমকে (হায়ারার্কি) আরও শক্তিমান করার মধ্য দিয়ে কালো মানুষের আত্মমর্যাদাকে আরও বিধ্বস্ত করে। সার্ত্রে বলেছিলেন, ইহুদিবিদ্বেষীর দৃষ্টিই ইহুদিকে তৈরি করেছে। তাঁর এই কথার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফানোঁ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে কৃষ্ণত্ব আরেকটি তৈরি করা এবং আরোপিত পরিচয়। ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস-এর শেষ অংশে তিনি লিখেছেন, ‘কালো মানুষ বলতে কিছু নেই। যেমন নেই সাদা মানুষও।’

এই যুক্তিটি দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ-এ ফানোঁ যে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রস্তাব করেছেন, সেটাকেও সমর্থন করে। ফানোঁর যুক্তি হলো, উপনিবেশবাদ যেহেতু ‘অপরকে পদ্ধতিগত খারিজ করা’, সেটা ‘উপনিবেশিতকে অনবরত এই প্রশ্ন করতে বাধ্য করে: আসলে আমি কে?’ তবে তিনি যখন বইটি লিখেছেন, তত দিনে তাঁর মূল লক্ষ্য বদলে গেছে। তিনি লিখলেন, ‘শোষিত, পরাধীন উপনিবেশিত আফ্রিকি জনসাধারণের দুর্ভাগ্যটি প্রথমত অত্যন্ত আবশ্যিকভাবেই বস্তুগত।’ যদিও তার মতো শিক্ষিত কালো মানুষদের কাছে সে প্রশ্নটি ততটা জরুরি ছিল না। রিচার্ড রাইটের হোয়াইটম্যান, লিসেন (১৯৫৭) বইটির ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত একটি কড়া সমালোচনায় ফানোঁ লিখলেন, ‘তার শ্বেত সংস্কৃতি এবং তার নেগ্রিটিউডের মধ্যে দ্বিধাদীর্ণ পশ্চিমায়িত এক কালো মানুষের চেতনার নাটক,’ যন্ত্রণাদায়ক হলেও, ‘কাউকে মেরে ফেলে না’।

দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ-এর একটা বড় পরিসর জুড়ে ফানোঁ একটি সমস্যা তুলে ধরেছেন, যে সমস্যাটি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্বগত সংকট নিয়ে আচ্ছন্ন রিচার্ড রাইট উপেক্ষা করে গেছেন বলে তিনি মনে করেছেন: আফ্রিকার জাতিগুলোকে তাদের ইতিহাসের সূত্রপাতটা ফিরিয়ে দেওয়া এবং তা কীভাবে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত পশ্চিমিকৃত বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং শহুরে শ্রমিক শ্রেণির প্রতি সন্দিহান ফানোঁ, আফ্রিকার শ্রমিক শ্রেণিকেই সত্যিকার অর্থে জগতের লাঞ্ছিত এবং বিউপনিবেশায়ন নাটকের প্রধান অভিনেতা হিসেবে দেখতে পেলেন। ফানোঁর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘উপনিবেশিক দেশগুলোতে একমাত্র কৃষক শ্রেণিই বিপ্লবী’, কারণ ‘তার হারাবার কিছু নেই, বরং অর্জন করার আছে সবকিছু’ এবং বুর্জোয়া নেতাদের মতো ‘কোনো আপস, ছাড় দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা’ বরদাশত করে না।

ফানোঁ সম্ভবত এটা উপলব্ধি করেননি যে বহু উপনিবেশবিরোধী নেতা ও চিন্তাবিদও কত বিচিত্রভাবে তাঁরই মতো জাতিগত অবমাননা ও এবং তাঁরই মতন স্বনির্ধারিত কাজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন এবং তাঁরা সেগুলোকে ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে মোকাবিলা করেছেন। শত হলেও, গান্ধী এক কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ততটাই বিশ্বস্ত ছিলেন, ফানোঁ যতটা ফরাসিদের প্রতি ছিলেন। এবং ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে আইনজ্ঞ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় জাতিগতভাবে অবমাননার শিকার হয়ে শ্বেতত্বের পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি চিরতরে আস্থা হারিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে, রাজনৈতিক আত্মসংকল্প নিয়ে গান্ধীর দিব্যদৃষ্টিও শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্ববাদী ঔদ্ধত্যর তৈরি ক্ষত সেরে ওঠার প্রয়োজনীয়তাকে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাঁর অহিংসার ধারণা এক নতুন ধরনের চিন্তা ও অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, যে চিন্তা ও অনুভূতিতে মানুষের জন্য যা কিছূ মঙ্গলকর, তা কেবল পশ্চিমা পুরুষদের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হবে না। আরও অসংখ্য এশীয় ও আফ্রিকি উপনিবেশবিরোধী নেতারও একই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক জাগরণ ঘটেছে।

ঔপনিবেশিত জগতে ১৯৫০-এর দশকে ফানোঁর বৃহত্তর অভিজ্ঞতা তার রাজনৈতিক চেতনাকে শাণিত করেছে। ১৯৫৪ সালে, একটি মনোচিকিৎসাগত বৃত্তি গ্রহণ করে আলজেরিয়ায় পাড়ি দেওয়ার এক বছর পর, তিনি আলজেরীয় বিপ্লবের প্রারম্ভ প্রত্যক্ষ করেন। এবং ঔপনিবেশিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদ করায় কয়েক বছরের মধ্যে, ১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে দেশটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি ‘দ্য ফ্রন্ট ডি লিবারেশন ন্যাশনালে’ নামের বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন এবং তিউনিসে একটি নতুন ঘাঁটি থেকে এফএলএন এবং তার প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের এর প্রতিনিধি  হিসেবে আফ্রিকার নানা দেশে ভ্রমণ শুরু করেন: ঘানা, ইথিওপিয়া, গিনি, কঙ্গো।

আরও পড়ুন

তত দিনে জাতিগত পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প হিসেবে বেশ কিছু মতবাদগত বিকল্প আফ্রিকা ও এশিয়ায় আবির্ভূত হয়েছে: চীনে মাও সে–তুংয়ের কৃষক সাম্যবাদ; ইন্দোনেশিয়ায় সুকার্নো প্রবর্তিত ইসলামঘেঁষা সমাজবাদ পঞ্চশিলা; ঘানায় কোয়ামে নক্রুমার ইতিবাচক কর্মকাণ্ডমূলক প্রতিবাদ। ইতিমধ্যে ঠান্ডাযুদ্ধ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন কঠোরভাবে খর্ব করছিল। নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় পশ্চিমা শক্তিগুলো উচ্চ খরচ সাপেক্ষ সেসব পেশা রয়েছে, যেখানে বেশি শারীরিক পরিশ্রম এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে ও বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি লাগে, সেসবের জায়গায় সামরিক ও অর্থনৈতিক জোরজবরদস্তি দেশগুলোকে বশে রাখার চেষ্টা করছিল। তারা সমাজের উচ্চতর শ্রেণির মধ্যে সহযোগী বা দালালের সন্ধান করছিল এবং মাঝেমধ্যেই অপেক্ষাকৃত জেদি বা আপসহীন নেতাদের উৎখাত বা হত্যা করছিল। পশ্চিমা হত্যা ষড়যত্রের অন্যতম বিখ্যাত শিকার ছিলেন ফানোঁর একজন বন্ধু ও সাক্ষাৎ সমসাময়িক প্যাট্রিস লুমুম্বা, কঙ্গোর প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, যাঁকে ১৯৬১ সালে হত্যা করা হয়। বহু অনভিজ্ঞ জাতি-রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসামর্থ্য তাদের নেতাদের বাধ্য করেছে তাদের সাবেক প্রভুদের কাছে সাহায্য চাইতে। ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার কয়েক মাস পর কেনিয়া, উগান্ডা ও তানজানিয়ার নেতার কম বেতনের কারণে সৃষ্ট বিদ্রোহ ঠেকাতে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করেছিল।

বিষয়টি একটু অদ্ভুত যে শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে কালো বা বাদামি মানুষগুলোর কাছে এই আংশিক ক্ষমতা হস্তান্তরের কালে প্রকাশিত হওয়া দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ–এ এশিয়ার উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে বা আফ্রিকার কথাও নেই তেমন, আর মধ্যপ্রাচ্য তো একেবারেই অনুপস্থিত। মনে হয়, ফানোঁ যেসব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন, সেসব দেশের সমাজের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত ছিলেন না, এমনকি আলজেরিয়ার সমাজও নয়। কিন্তু তারপরও, একজন নির্বাসিত ক্ষমতাহীন কালো মানুষ হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিন্তা করেছিলেন তিনি। তার ফলে ঠান্ডাযুদ্ধের নীতিগিরি ফলানো ও বাগাড়ম্বর ভরা সামাজিক এবং রাজনৈতিক জুলুমের কপট ধরন তাঁর কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিল।

সম্ভবত এই সময়েই, নক্রুমার ঘানায় একদলীয় শাসনের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ণতর হয়ে ওঠে: তার চোখে সেটা হচ্ছে বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রের আধুনিক রূপ, যা তার মুখোশ মেকআপ এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলেছে, হয়ে উঠেছে সর্ব ক্ষেত্রে মানবসমাজে প্রচলিত মূল্যবোধে অবিশ্বাসী। এই দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের মধ্যে গত বেশ কিছু দশকে কেনিয়া, তানজানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং আরও অনেক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঠিক বর্ণনা পাওয়া।

শহুরে সমৃদ্ধি এবং গ্রামীণ দারিদ্র্যের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক ফারাক এবং অন্যায্য উন্নয়নের বিষময় ফলের কথাও ফানোঁ দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে বর্ণনা করেছেন, এমনকি যেসব দেশে তিনি যাননি, সেসব দেশের ক্ষেত্রেও। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ভারতের অতি ডানপন্থী স্বৈরাচারী শাসক নরেন্দ্র মোদির প্রতি নিবেদিত একটি বিশ্বায়িত ব্যবসাকেন্দ্রিক অভিজাত শ্রেণি দেখে যাঁদের মাথা ঘুরে গেছে, তাঁরা দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ-এ এই পরিস্থিতির একটি সাধারণ রূপরেখা পেতে পারেন। 

ভারতীয় কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক পংকজ মিশ্র (জন্ম: ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯)
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় বুর্জোয়া ক্রমেই আরও বেশি করে অভ্যন্তরের দিকে, উচ্ছন্নে যাওয়া একটি দেশের বাস্তবতার দিকে পিঠ ফেরাতে থাকে এবং সাবেক মহানগর ও ভিনদেশি পুঁজিপতিদের দিকে তাকায়, যারা তার সেবা গ্রহণ করে। যেহেতু জনগণের সঙ্গে তার মুনাফা ভাগ করে নেওয়ার কোনো বাসনাই এ–জাতীয় বুর্জোয়ার নেই, সেটা তখন একজন জনপ্রিয় নেতার প্রয়োজন অনুভব করে, যার দ্বিমুখী ভূমিকা হবে শাসনামলটাকে স্থিতিশীল রাখা এবং বুর্জোয়া আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী করা।

ফানোঁর গ্রন্থে যেসব ত্রুটি লক্ষ করা যায় এবং সেখানে যেসব জিনিস বাদ পড়েছে, সেসবও  আমাদের অনেক কথা বলে। তাঁর অক্লান্ত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীনতা বা মুক্তিকে তাঁর মতো মানুষের হতাশা আর আকাঙ্ক্ষায় নামিয়ে এনেছে। স্বদেশীর পৌরুষ এবং  আত্মপ্রভুত্ব অর্জনের মাধ্যমে উপনিবেশ স্থাপনকারীর সহিংসতার জবাব দেওয়া সম্ভব—এই প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে ফানোঁ আধিপত্যের একটি অতিপুরুষবাচক বয়ানকে আরও পরিপুষ্ট করেছেন। ফলে এত বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে ফরাসিরা আলজেরিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার কয়েক দশক পরেও দেশটিতে রাজনীতি কদর্য বিষয় হয়ে ছিল।   

সেক্যুলার ফরাসি আলোকায়নের (এনলাইটেনমেন্ট) একজন উত্তরাধিকারী হিসেবে এবং দৃশ্যত, অ-ফরাসিভাষী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অনবহিত বা অসচেতন ফানোঁ দেখতে পাননি কীভাবে অতীতে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী লোকজন নির্বিচার বনের গাছ কাটা আর মাইনিং করপোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আবার উল্টো দিকে, আফ্রিকার কৃষক শ্রেণির বিপ্লবী সম্ভাবনা সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বকে স্পষ্টতই কষ্ট কল্পনা বলেই মনে হয়, কারণ আফ্রিকায় শহুরে শ্রমিক শ্রেণি বিউপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে কৃষকদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

জাতীয় মুক্তির ক্ষেত্রে যেসব দেশে কৃষকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, যেমন চীন ও ভিয়েতনাম, তারা মানুষের একটি নতুন ইতিহাস তৈরির ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। ফানোঁ যা আশা করেছিলেন, তার উল্টোটাই ঘটেছে বরং। এমনকি উপনিবেশ–পরবর্তী সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো, যেমন ভারত ও চীন, তাদের ঐতিহাসিক পীড়নকারীদের নাগাল ধরার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে; আর এই অনুকরণ করতে গিয়ে ঘৃণ্য আত্মরতি বা নার্সিসিজম সম্পর্কে তাদের নিজেদের অসার বাগাড়ম্বরের জন্ম দিয়েছে।

এত কিছুর পরেও, বিউপনিবেশায়ন নিয়ে ফ্রানৎস ফানোঁর সংশয় এবং মানসিক ও সমাজ-আর্থনীতিক পরিবর্তনের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি বর্তমান যুগের জাতিগত চার্জড প্রতিবেশে যতটা ভবিষ্যদ্বাণীসূচক ও কল্যাণকর তার চেয়ে বেশি বোধ হয় আর কখনোই ছিল না। মর্যাদার জন্য অ-শ্বেতাঙ্গ মানুষের ক্রমবর্ধমান দাবি, আর সেই সঙ্গে চীনের উত্থান পশ্চিমা আত্মপ্রতিচ্ছবিকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। এই প্রতিচ্ছবি সেই সব দশকগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছিল, যখন মনে হয়েছিল শ্বেতাঙ্গরা একাই আধুনিক জগৎ তৈরি করেছে।

সাম্রাজ্যবাদী যুগের কর্তৃত্বের এই শক্তি হ্রাসের কারণে একধরনের অনিশ্চয়তার বোধ তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে বজায় থাকা কাঠামো আর রীতিনীতি অবসানে অস্তিত্বগত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বৃদ্ধি ঘটতে পারে। সেখানে দেখা দিতে পারে নতুন পরিচয় আর নতুন মূল্যবোধ। রাজনীতিকেরা এবং মিডিয়া আউটলেটগুলো (অতিসরলীকৃত আর আবেগসর্বস্ব ভাষা ব্যবহার করে) এই শূন্যতাকে তাদের নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে।

একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি এসে চারদিকে তাকিয়ে আমাদের পক্ষে এ কথা বলা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে উপনিবেশবাদীরা পরাস্ত হয়েছে। সে রকম জোরালো কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাই না, যদিও তাদের দখলদারত্ব আগের মতো প্রত্যক্ষ নেই। আর তাই ফ্রানৎস ফানোঁর প্রাসঙ্গিকতা ও তাঁর রচনা পাঠ ও মূল্যায়ন এখনো অত্যন্ত জরুরি, সাদা মানুষের তৈরি দুনিয়ার নাগপাশ থেকে বের হওয়ার জন্য। দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ-এর শেষ বাক্যটি তাই অনিঃশেষ প্রেরণা হয়ে থাকবে বহুদিন:

ফর ইউরোপ, ফর আওয়ারসেলভস, অ্যান্ড ফর হিউম্যানিটি, কমরেডস, উই মাস্ট মেক আ নিউ স্টার্ট, ডেভেলপ আ নিউ ওয়ে অব থিঙ্কিং, অন্ডৈ এন্ডেভার টু ক্রিয়েট আ নিউ ম্যান। (রিচার্ড ফিলকক্সের ইংরেজি অনুবাদ)

সেই ‘নতুন মানুষ’ তৈরির কাজ হুবহু ফানোঁর সূত্র অনুযায়ী হয়তো হবে না হয়তো, কিন্তু তা তৈরি না হলে ‘জগতের লাঞ্ছিত’র যে মুক্তি নেই, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না।

(পংকজ মিশ্রের ‘ফ্রানৎস ফানোঁ’স এন্ডিউরিং লেগাসি’ শীর্ষক প্রবন্ধ অবলম্বনে)