আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক আলেক্সান্দার পুশকিনের কাছে একটা উড়ো খবর আসে। তাঁর অসামান্য সুন্দরী স্ত্রী নাতালিয়া পরকিয়ায় লিপ্ত নিজ বোনের বর জর্জ দিএন্থের সঙ্গে। ক্ষুব্ধ, ঈর্ষান্বিত পুশকিন তা সহ্য করতে পারলেন না। মনে মনে দিএন্থে বা দেন্থেকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। মুখোমুখি বন্দুকযুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। এ যুদ্ধকে বলা হয় ডুয়েল। প্রথমে একজন স্বল্প দূরত্বে থেকে গুলি ছুড়বে এবং স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে অপরজন যতক্ষণ না গুলি ছোড়ে। আত্মঘাতী এই খেলার এই চ্যালেঞ্জ দেন্থে গ্রহণ করেন। ১৮৩৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সেন্ট পিটার্সবার্গের বাইরে একটা খোলা জায়গায় হিমশীতল দিনে, বরফে ভরা ময়দানে তাঁরা বন্দুকযুদ্ধের জন্য মিলিত হন। কিন্তু নিয়মমতো বন্দুকযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই দেন্থে পুশকিনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি বুক বরাবর না লেগে পেটে বিদ্ধ হয়। পুশকিন মাটিতে পড়ে যেতে যেতে একটি গুলি ছোড়েন, কিন্তু তা দেন্থের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি।
গুলিবিদ্ধ পুশকিনকে সেন্ট পিটার্সবার্গে তাঁর ভাড়া করা বাড়িতে আনা হয়। চিকিৎসক অনেক চেষ্টায় রক্তপাত থামাতে পারলেন না। অবশেষে গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুই দিন পর ১৮৩৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি অসামান্য প্রতিভাবান, বোকা, আবেগী সাহিত্যিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কবিরা তো বোকাই হয়।
আমি এখন এই বোকা কবির বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি। ময়কা নদীর ক্যানাল বয়ে গিয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের রাজপ্রাসাদের আশপাশের গলি দিয়ে। ক্যানালগুলোর দুই পাশের পথকে সংযুক্ত করেছে ছোট ছোট সেতু।
পুশকিনের জন্ম ১৭৯৯ সালে মস্কো শহরে। রাশিয়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম পুশকিনের। ১০–১১ বছর বয়স অবধি তিনি রুশ ভাষা ঠিকমতো জানতেন না। কথা বলতেন ফরাসি ভাষায়। বাড়িতে রুশ ভাষার চর্চা প্রায় ছিল না বললেই চলে। তখনকার দিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে ফরাসি ভাষায় কথা বলার রেওয়াজ ছিল।
শিল্পসাহিত্যের শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ। অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিক শুধু শিল্পসাহিত্যচর্চা করার জন্যই এ শহরে থিতু হয়েছিলেন। খোদ সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের আর্ট মিউজিয়ামে বিশ্বের যত চিত্রকলা আছে, তা রাশিয়ার অন্য কোনো শহরে নেই। এমনকি ইউরোপের কোনো শহরেও নেই।
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়। হাতে একদম সময় নেই, ম্যাপ দেখে খুঁজে খুঁজে আলেক্সান্দার পুশকিনের বাড়িতে যেতে হবে। আসলে তা বাড়ি নয়, আর্মিতাশ রাজপ্রাসাদের বর্ধিত অংশ। এখানে পুশকিন কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ কয়েকটি বছর।
বাইরের ফটক দেখে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে এত বড় একটি ভবন রয়েছে। কাঠের ফটকটি অন্যান্য সাধারণ বাড়ির ফটকের মতোই। ভেতরে চতুর্ভুজাকার হলুদ রঙের প্রাসাদ আর মাঝখানে সবুজ লন, লনের মাঝখানে কালো পাথরে গড়া পুশকিনের ভাস্কর্য। আমার ইচ্ছা করছিল এই লনের সামনের বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে থাকি।
দেরি হবে ভেবে এদিক–ওদিকে না ঘুরে টিকিট অফিসে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। আমার পালা আসতেই কাচের ওপাশে বসে থাকা নারী বললেন, ‘এখন আর স্লট নেই। পরে যেদিন খুলবে, সেদিন এসো।’ দুই দিন পর যখন পুশকিনের বাড়ির দুয়ার খুলবে, তখন আমি সেন্ট পিটার্সবার্গে থাকব না।
আমি কাতর নয়নে তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি আমার টলটলে চোখ দেখে কাকে যেন ফোন করলেন৷ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি একা?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই টিকিট দিলেন আর অডিও গাইডের সাহায্য নিতে বললেন। কারণ, এখানে সবকিছু রুশ ভাষায় লেখা।
আমি একলাফে রাজ্যজয় করার আনন্দ নিয়ে পুশকিন প্রাসাদের যে অংশে বসবাস করতেন, সেখানে চলে গেলাম।
এ ভবনের বেজমেন্ট দিয়ে ভেতরে যেতে হয়। বেজমেন্টে আমাকে অডিও গাইড প্লেয়ার দেওয়া হলো। এখন বেজমেন্ট বা নিচতলা থেকে আমার পুশকিন গৃহভ্রমণ শুরু হবে।
আলেক্সান্দার সের্গেয়েভিচ পুশকিনের জন্ম ১৭৯৯ সালে মস্কো শহরে। রাশিয়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম পুশকিনের। ১০–১১ বছর বয়স অবধি তিনি রুশ ভাষা ঠিকমতো জানতেন না। কথা বলতেন ফরাসি ভাষায়। বাড়িতে রুশ ভাষার চর্চা প্রায় ছিল না বললেই চলে। তখনকার দিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে ফরাসি ভাষায় কথা বলার রেওয়াজ ছিল। অন্যান্য ধনী পরিবারের সন্তানের মতোই পুশকিন গৃহশিক্ষকের কাছে ফরাসি ভাষায় প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন। ন্যানি ও বাড়ির কাজের লোকদের কাছ থেকে পুশকিন রুশ ভাষা শেখেন। খুব অল্প বয়স থেকে পুশকিন কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। একই বছর সেন্ট পিটার্সবার্গে পড়াশোনা করার সময় লাইসিয়াম অডিটোরিয়ামের গুণীজনদের সামনে তিনি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। দ্রুত বিখ্যাত হন তাঁর কাব্যের সাবলীলতার কারণে। রুশ ভাষা সাহিত্যে তিনি এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। আর এ কারণে পুশকিনকে বলা হয় আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক।
জার সম্রাটের সমালোচনা করার জন্য ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সাল অবধি মায়ের এস্টেট মিখাইলোভোস্কোয়ি নামের জায়গায় তাঁকে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল। এ সময় তাঁর সাহিত্যকর্মে এক নতুন ধারা যোগ হয়। তিনি প্রেমময় কবিতা, উচ্চবিত্তদের আখ্যান ছেড়ে সাধারণ মানুষ নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে থাকেন।
কবিতার সঙ্গে সঙ্গে পুশকিন গল্প, উপন্যাস, নাটক, রূপকথাও লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘রুসলান ও লুদমিলা’ ১৮২০ সালে প্রকাশিত হয়। জার সম্রাটের সমালোচনা করার জন্য ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সাল অবধি মায়ের এস্টেট মিখাইলোভোস্কোয়ি নামের জায়গায় তাঁকে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল। এ সময় তাঁর সাহিত্যকর্মে এক নতুন ধারা যোগ হয়। তিনি প্রেমময় কবিতা, উচ্চবিত্তদের আখ্যান ছেড়ে সাধারণ মানুষ নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে থাকেন। একই সময়ে ১৮২৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে গণ–অভ্যুত্থান ঘটে। তিনি নির্বাসনে থাকার কারণে যোগদান করতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
১৮২৮ সালে পুশকিনের সঙ্গে মস্কোর বিখ্যাত সুন্দরী নাতালিয়ার দেখা হয়। দুই বছর লাগে পুশকিনের নাতালিয়াকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে। অবশেষে তাঁরা ১৮৩১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৮২৮ থেকে ১৮৩১ অবধি পুশকিন প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন রোমান্টিক কবিতার মাধ্যমে। তাঁর একটি—
‘তোমাকে বেসেছি ভালো,
হয়তো এখনো সে আগুন
এ বুকে নেভেনি একেবারে;
তা যেন উদ্বেগ না ঘটায় কোনো,
কিছুতেই কষ্ট দিতে চাই না তোমায়।
নীরব সে ভালোবাসা
আশা না রেখে
ভুগেছি ভীরুতা, কখনো ঈর্ষায়
এত অকপট, এত প্রেম দিয়ে
অন্য কেউ ভালোবাসুক তোমায়।’
বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে পুশকিন ভয়াবহ রকমের ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই বলেন, ঋণের অন্যতম কারণ তাঁর জুয়া খেলার নেশা। তবে এ সময়ও তাঁর সাহিত্যচর্চা থেমে থাকেনি। ১৮৩৭ সালে দেন্থের সঙ্গে ডুয়েল হওয়ার দুই দিন পর আমরা হারাই বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এই সাহিত্যিককে। তাঁর মৃতদেহ সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সভিয়াতোগোরস্কি বা বর্তমানে পুস্কিনস্কিয়ে নামের স্থানে নিয়ে গিয়ে মায়ের পাশে সমাহিত করা হয়।
পুশকিনের শেষের দিকের একটি কবিতার অংশ—
‘আমার অনুরাগী রবে বহুকাল
জাগিয়েছি মূল্যবোধ
গেয়েছি মুক্তির গান নিষ্ঠুর শতকে
অদৃশ্য করতে চেয়েছি যন্ত্রণা।
শিল্পের দেবী,
শোনো আজ্ঞা দেবতার
সর্বনাশে নেই ভয়,
সাফল্য যে সাথে।
ছুটো না,
নিন্দা, খ্যাতিতে থেকো নির্বিকার
নির্বোধের সাথে তর্ক নিষ্ফল।’
প্রাসাদের যে অংশে পুশকিন বসবাস করতেন, সে অংশকে ‘পুশকিন মিউজিয়াম’ করা হয়েছে। পুশকিন এ পাশের ১১টি কক্ষ ভাড়া করে স্ত্রী, সন্তান ও গৃহকর্মীদের নিয়ে বসবাস করতেন।
আমি কালবিলম্ব না করে দরজার দিকে এগোলাম। সাধারণত মিউজিয়াম থেকে ১০ জনের একটা গ্রুপ করে দেওয়া হয়। তবে আমার বেলায় ব্যতিক্রম হলো। আমার আগের গ্রুপ আমার সামনে দল বেঁধে চলে গেল। আমি অডিও গাইড প্লেয়ারের হেডফোন কানে দিয়ে চললাম পুশকিনের বাড়ির আনাচকানাচ দেখতে।
নিচতলা বা বেজমেন্টের কক্ষগুলোতে খুব বেশি আলো নেই। আর এখানে পুশকিনের লেখার খাতা, চিঠি ইত্যাদি রাখা আছে। সারি সারি কাচের শোকেসে পুশকিনের হাতে লেখা চিঠি, পাণ্ডুলিপির খসড়া রাখা আছে। কয়েকটা শোকেসে পুশকিনের লেখা বইয়ের পাতা খুলে রাখা আছে।
কক্ষের মাঝখানের শোকেসে পুশকিনের ব্যবহৃত শটগান বাক্সসমেত রাখা। বাক্সের ভেতরে দুটি বন্দুক ও তা মেরামতের যন্ত্রপাতি রাখা। প্যারিস থেকে আনা বন্দুকটি পুশকিন ১৮৩৬ সালে কিনেছিলেন এবং এই বন্দুক নিয়েই ডুয়েলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একই শোকেসের আরেকটি ভাগে পুশকিনের নাটকের পাণ্ডুলিপির একটি পাতা ঝুলিয়ে রাখা আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো পুশকিন নাটকের চরিত্রগুলোর ছবি এঁকে লেখার পাশে বসিয়ে দিয়েছেন। অন্য একটি উপন্যাস লেখার খাতায়ও তিনি একইভাবে চরিত্রের ছবি এঁকেছেন।
নিচতলার কক্ষ দেখা হয়ে গেলে আমি সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় চলে এলাম। রাজকীয় দরজা দিয়ে ঢুকতে প্রথমেই একটা লম্বা প্যাসেজ। পুশকিনের মৃত্যুর পর তাঁকে এই প্যাসেজে রাখা হয়েছিল। এখানে পুশকিনের মৃত্যুশয্যার একটি ছবি দেয়ালে ঝোলানো আছে। প্যাসেজে কোনো আসবাব নেই।
পরের কক্ষটি পুশকিনের খাবার ঘর। এই কক্ষে একটি গোলাকার খাবার টেবিল, চারটি চেয়ার, একটি বড় কাবার্ড, একটি ছোট আকারের সোফা আর মেঝে থেকে সিলিংয়ের কাছাকাছি অবধি একটি সরু কাঠের বাক্সে রাখা ঘড়ি আছে। এ রকম ঘড়ি ঊনবিংশ শতকে সম্ভ্রান্ত বাড়িতে থাকত। একই কক্ষে আরেকটু ভেতরের দিকে কাঠের কারুকাজের ফোল্ডিং পার্টিশন দিয়ে অন্য পাশে আরেকটা ছোট টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা। একপাশে দেয়ালজোড়া জানালা। একই কক্ষের আরেক পাশের শোকেসে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লাল ক্রিস্টালের পানীয় রাখার বোতল, দুটি গ্লাস আর ট্রে। সবই লাল ক্রিস্টালের তৈরি। শোকেসের নিচের তাকে একটা ট্রের ওপর রুপার তৈরি একটি স্যুপ পরিবেশন করার চামচ ও একটি ডাইনিং চামচ রাখা। এই পানীয় সেট ও চামচের বয়স ৩০০ বছরের অধিক হবে। কারণ, এগুলো তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।
একই শোকেসের আরেকটি ভাগে পুশকিনের নাটকের পাণ্ডুলিপির একটি পাতা ঝুলিয়ে রাখা আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো পুশকিন নাটকের চরিত্রগুলোর ছবি এঁকে লেখার পাশে বসিয়ে দিয়েছেন। অন্য একটি উপন্যাস লেখার খাতায়ও তিনি একইভাবে চরিত্রের ছবি এঁকেছেন।
পুশকিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রথমে তাঁকে এই কক্ষে এনে রাখা হয়েছিল। তাঁর আহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা শহর থেকে সাধারণ জনগণ এসে এই বাড়িতে ভিড় জমায়। একসময় ভিড় সামলাতে না পেরে বাড়ির বাইরের ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরের কক্ষটি পুশকিনের বসার ঘর। এ কক্ষ অত্যাধুনিক আসবাবে সুসজ্জিত। কক্ষের এক কোনায় একটি কর্নার টেবিলে দেবশিশুর শোপিস রাখা, দেবশিশু সিংহ টানা গাড়িতে চড়ে ঘুরছে। দেয়ালে ঝুলছে পুশকিনের পোর্ট্রেট। এ কক্ষেও একপাশের দেয়ালজুড়ে জানালা। প্রতিটি জানালায় ডবল লেয়ারের পর্দা ঝুলছে। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালের রং হালকা নীল। পর্দার রং দেয়াল আর সিলিংয়ের বর্ডারের সঙ্গে মিলিয়ে গাঢ় নীল, হালকা নীল আর সাদা। বসার ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা সোফা, গোল সেন্টার টেবিল রাখা। সেন্টার টেবিলে তখনকার দিনের একটি টেবিল ল্যাম্প শোভা পাচ্ছে, সোনালি বর্ডার দেওয়া ল্যাম্পের রং নীল, পাশে একটা বই খুলে রাখা। পুশকিন কি বই পড়তে পড়তে কোথাও চলে গিয়েছেন!
এর পাশে একটি ডিভান রাখা, দেয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে ডিভানের কভারের রং হালকা নীল। কক্ষের আরেক পাশে একটি পিয়ানো আছে। পিয়ানোর ওপরে পিয়ানোর নোট সাজানো আর পুশকিন রচিত কয়েকটি বই রাখা। পুশকিনের এই বসার ঘরে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও কবি-সাহিত্যিকদের আসা-যাওয়া ছিল। তখনকার উদীয়মান কবি নিকোলাই গোগল পুশকিনের বন্ধু ও অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন।
এরপরের কক্ষটি পুশকিনের অসামান্য সুন্দরী স্ত্রী নাতালিয়ার কক্ষ। এ কক্ষের এক কোনায় নাতালিয়ার ব্যবহৃত একটি বড় ড্রেসিং টেবিল রাখা। টেবিলটির ওপর আসল ক্রিস্টালে খাঁজকাটা কাজ করা সুগন্ধির শিশি রাখা। ড্রয়ারে দুটি হাতের কাজ করা বটুয়া। একটি পুশকিন ও অন্যটি নাতালিয়ার। পুশকিনের বটুয়াটি নাতালিয়া নিজ হাতে এমব্রয়ডারি করেছিলেন। জানালার দিকে ছোট কর্নার টেবিলের ওপর নাতালিয়ার বাঁধানো ছবি রাখা আর পাশে কাঠের বাক্সে নাতালিয়াকে লেখা পুশকিনের কিছু চিঠি রাখা। এর মধ্যে একটি চিঠিতে পুশকিন লিখেছিলেন—
‘প্রিয়তমা, তুমি কি নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছ? পৃথিবীর কোনো কিছুই তোমার চেয়ে সুন্দর নয়। তবে আমি তোমার সৌন্দর্যকে নয়, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।’
নাতালিয়ার ড্রেসিং টেবিলের অপর পাশে আরেকটি সাইড টেবিলে কিছু শোপিস রাখা। এই কক্ষের দেয়ালের রং অফ হোয়াইট আর ডবল লেয়ারের পর্দার রং সাদা আর খয়েরি।
পরের কক্ষটি অতিথিদের থাকার জন্য রাখা হয়েছিল। নাতালিয়ার বোন কিছুদিন এই কক্ষে ছিলেন। এই কক্ষে ছবি আঁকার ইজেলের মতো ফ্রেমে কাপড় আটকানো। এমব্রয়ডারি করার জন্য এভাবে রাখা হয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র কেউ এই ফ্রেমের সামনে ছিল, এমব্রয়ডারির কাজ খানিকটা করে অন্য কাজে গিয়েছে।
কাঠের বাক্সে নাতালিয়াকে লেখা পুশকিনের কিছু চিঠি রাখা। এর মধ্যে একটি চিঠিতে পুশকিন লিখেছিলেন— ‘প্রিয়তমা, তুমি কি নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছ? পৃথিবীর কোনো কিছুই তোমার চেয়ে সুন্দর নয়। তবে আমি তোমার সৌন্দর্যকে নয়, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।’
এই কক্ষ পার হওয়ার আগে জানালায় চোখ পড়ল। জানালা দিয়ে ময়কা নদীর ক্যানাল জানান দিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো বাড়ির পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেলে সে বাড়ির সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। আর তখন বাড়ির বাসিন্দাদের চেয়ে সুখী বোধ করি আর কেউ হয় না।
পরের কক্ষটি পুশকিনের সন্তানদের কক্ষ। বড় এই কক্ষে খুব বেশি আসবাব নেই। কক্ষের এক পাশে একটা ডিভান। ডিভানের সামনে অনুচ্চ টুলের ওপর ছোট বাচ্চার সাদা রঙের একজোড়া জুতা রাখা। জুতাজোড়া এমনভাবে রাখা, যেন মনে হচ্ছে দেড় বা দুই বছর বয়সী শিশু জুতা খুলে রেখে এখান থেকে দৌড়ে অন্য কক্ষে গিয়েছে।
আরেক পাশে ছোট একটা শেলফ, যার তাকে ছোট ছোট খেলনা আর চিনামাটির পুতুল রাখা। এর পাশে দুটো চেয়ার, আরেক দিকে কর্নার টেবিল রাখা। মেঝের কার্পেটের ওপর পুশকিনের সন্তানদের খেলনা ছড়ানো আছে। এর মধ্যে একটি খেলনা হলো, কাঠের তৈরি ঘোড়ার গাড়ি। একদম কোনায় একটা বেশ বড় পাখির খাঁচা দেখলাম। এই কক্ষের দেয়ালের রং হালকা গোলাপি। পর্দার রং হালকা হলুদ, পর্দার বর্ডারে ঘন করে এমব্রয়ডারি করা।
পরের কক্ষটি আলেক্সান্দার পুশকিনের পড়া ও লেখার ঘর। এই কক্ষে প্রবেশ করে এক রাজকীয় অনুভূতি হলো। কারণ, পুশকিনের সংগ্রহের ১৪ হাজার বই, বইয়ের শেলফে সারি সারি শোভা পাচ্ছে। ৫টি ভাষার বিভিন্ন বিষয়ের বই রাখা আছে এই শেলফগুলোতে। একে তো রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়ি, তার ওপর এত সমৃদ্ধ সংগ্রহ দেখে সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
এই কক্ষে বইয়ের শেলফ ছাড়াও পুশকিনের লেখার টেবিল আছে। টেবিলের ওপর পুশকিনের হাতে লেখা বেশ কিছু কাগজ রাখা। ছোট একটা কাচের বাক্সে পুশকিনের কলম আর সেই কলম দিয়ে লেখা শেষ শব্দমালা। অন্যান্য রাজকীয় আসবাবের সামনে টেবিলটি দেখতে খুব সাধারণ লাগল। টেবিলের সামনে বসার চেয়ারটি সোফার মতো গদি দেওয়া। সেখানে হেলান দিয়ে ইজি চেয়ারের মতো বসা যায়।
কক্ষের একপাশে পুশকিনের পোশাক রাখা।
দেয়ালজুড়ে বইয়ের শেলফ আর শেলফের সামনে একটা সোফা। বইয়ের শেলফগুলো দেখতে একদম লাইব্রেরির মতো, মাঝখানে পার্টিশনের মতো করে আরেকটি শেলফ করে দেওয়া আছে। যিনি এই কক্ষের ডিজাইন করেছেন, তাঁর রুচির তারিফ করতে হয়।
পুশকিনের লেখার টেবিলের আরেক পাশের চেয়ারের পাশে তাঁর ছড়ি ও ধূমপান করার পাইপ রাখা।
নিয়মমতো বন্দুকযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই দেন্থে পুশকিনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি বুক বরাবর না লেগে পেটে বিদ্ধ হয়। পুশকিন মাটিতে পড়ে যেতে যেতে একটি গুলি ছোড়েন, কিন্তু তা দেন্থের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। চিকিৎসক অনেক চেষ্টায় রক্তপাত থামাতে পারলেন না।
পুশকিনের পড়ালেখার ঘর থেকে বেরিয়ে শুনি আমার অডিও গাইড বলছে, ‘পুশকিনের বাড়ি প্রদর্শন এখানেই শেষ হলো।’ আমি শেষ স্লটের পর একা একা, কোনো ভিড় ছাড়া কক্ষগুলো দেখেছি আর দেখতে অনেক সময় নিয়েছি। কিন্তু এখন যদি বিভোর হয়ে পুশকিনের বাড়িতে হারিয়ে যাওয়া হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায়, তাহলে মন একটু খারাপ তো হয়ই। পুশকিনের বাড়ির প্যাসেজ হয়ে আবার কক্ষগুলোতে যাওয়ার উপায় নেই। আমার জন্য মিউজিয়ামের কর্মীরা ধৈর্য ধরে তাঁদের কাজ শেষ হওয়ার পরের অতিরিক্ত কিছু সময় অপেক্ষা করেছেন। তাই তাঁদের সময় নষ্ট না করে নিচতলায় ফিরে এলাম।
পুশকিনের বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনের লনে পুশকিনের ভাস্কর্যের সামনের বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। এখন বাজে মোটে ছয়টা। এ শহরে সূর্য ঢলে পড়ে ১০টার পর।
পুশকিনের ভাস্কর্যের সামনে বসে থাকতে থাকতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সামনের লনের ঘাস, আলেক্সান্দার পুশকিনের ভাস্কর্য সব সজীব হয়ে উঠল। যে কথা পুশকিন বলে বা লিখে যেতে পারেননি, তা কি বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে ঝরে পড়ল!