মিজান ভাই: সেই গলা সেই হাসি

তাঁকে সবাই চেনেন সাংবাদিক, আইনবিশারদ বা সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে। কিন্তু মানুষ হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে কেমন ছিলেন সদ্য প্রয়াত মিজানুর রহমান খান? এই লেখায় ধরা পড়েছে তাঁর সেই অন্তরঙ্গ অবয়ব।

মিজানুর রহমান খানের ছবি অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

চট্টগ্রাম থেকে ফোন করে আমার বড় ভাই, মিজান ভাইয়ের লেখা আর টক শোয়ের ভক্ত ডা. আশফাক জানালেন, ‘আজ ডাক্তারদের একটা মিটিং ছিল। মিটিংয়ের আগে–পরে প্রত্যেকের মুখে ছিল মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুর বেদনা। তাঁর মরে যাওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি।’ এ কথা বলার জন্য তিনি প্রথমবার যখন ফোন করেন, তখন আমি প্রথম আলো ভবনের গেটের কাছে মিজান ভাইয়ের সামনে, যখন বর্তমান ও সাবেক সহকর্মী আর কয়েক শ ভক্ত–শুভানুধ্যায়ীর মাঝখানে কফিনের মধ্যে তিনি নিরব হয়ে আছেন। এই নীরবতা মিজান ভাইয়ের সঙ্গে একেবারেই যায় না। তখন আমার ফোনকেও আমি নীরব করে রেখেছিলাম।

‘প্রথম আলো’তে কাজ করার সময় সিএ ভবনে যখন ছিলাম বা যখন ছিলাম প্রগতি ভবনে, ঘটনাচক্রে আমরা এক ফ্লোরে কাজ করতাম। সিএ ভবনে বসতাম খুব কাছাকাছি। তিনি ফোনে অনেক বিশেষজ্ঞের মত নিতেন। অনেকের সাক্ষাৎকার নিতেন। তাঁর উচ্চ স্বর কথাবার্তায় আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যেত। প্রগতি ভবনে মিজান ভাই এক মাথায়, আমরা আরেক মাথায়। মিজান ভাইয়ের যে গলা, তাতে কিছু উনিশ-বিশ হয়নি। ২০০৭–০৮ সালের দিকে একবার বললাম, আপনার গলায় কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে। পশ্চিম বাংলার এক নামকরা নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত কথা বলার কারণে গলা ও কানের রোগ বাড়ছে। তাঁর রোগী বেড়ে গেছে। কিছুদিন পর মিজান ভাইকে সত্যিই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। অভ্যাস তিনি পরিবর্তন করেননি।

মিজান ভাই কথা বলার মানুষ। তর্ক করার মানুষ। ‘প্রথম আলো’তে কাজ করার সময় সিএ ভবনে যখন ছিলাম বা যখন ছিলাম প্রগতি ভবনে, ঘটনাচক্রে আমরা এক ফ্লোরে কাজ করতাম। সিএ ভবনে বসতাম খুব কাছাকাছি। তিনি ফোনে অনেক বিশেষজ্ঞের মত নিতেন। অনেকের সাক্ষাৎকার নিতেন। তাঁর উচ্চ স্বর কথাবার্তায় আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যেত। প্রগতি ভবনে মিজান ভাই এক মাথায়, আমরা আরেক মাথায়।

মিজান ভাইয়ের যে গলা, তাতে কিছু উনিশ-বিশ হয়নি। ২০০৭–০৮ সালের দিকে একবার বললাম, আপনার গলায় কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে। পশ্চিম বাংলার এক নামকরা নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত কথা বলার কারণে গলা ও কানের রোগ বাড়ছে। তাঁর রোগী বেড়ে গেছে। কিছুদিন পর মিজান ভাইকে সত্যিই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। অভ্যাস তিনি পরিবর্তন করেননি।

আকবর আলি খান প্রথমা প্রকাশনের জন্য একটি বই লিখছিলেন। সে কাজে তাঁর বাসায় গিয়েছি। কথা বলছি এ সময় একটি ফোন এল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন স্যার। ফোন ছেড়ে বললেন, আপনাদের মিজান। আমি বললাম, বুঝতে পেরেছি স্যার, ওনার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। ফোন না করে এমনিতে ডাক দিলেও আপনি শুনতে পেতেন। প্রাণ খুলে হাসলেন স্যার। বললেন, মিজান কিন্তু লেখেন ভালো।

আরও পড়ুন

হয়তো কোনো একটা কাজ করছি। হঠাৎ মিজান ভাইয়ের গলার উচ্চতায় মন ছুটে গেল। দৌড়ে গেলাম। মিজান ভাই, আমরা যখন কথা বলি আপনি শুনতে পান? মিজান ভাই অবাক, না তো!

আসলে আমি কী বলতে চাইছি উনি ধরতে পারেননি। তাই অবাক হয়েছেন। এ ধরনের একটা প্রশ্ন তাঁকে আমি কেন করতে গেছি, এই জিজ্ঞাসা তাঁর চোখে। তিনি যে উচ্চ স্বরে কথা বলেন, সেটা কিন্তু বুঝতে পারেন না। আমি বললাম, তাহলে আপনি যখন কথা বলেন আমরা শুনতে পাই কেন?

এবার বুঝতে পারলেন। এবং দিলেন সেই হাসি। যে হাসি তিনি প্রশংসা করলে দেন, সমালোচনা করলে দেন, ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক—মতি ভাই প্রশ্রয় দিলে দেন, মতি ভাই বকাবকি করলে দেন। তাঁকে কিছু অফার করলে দেন, কারও কাছে কিছু চাইতে গিয়ে দেন। এটা আসলে তাঁর মুখে লেগেই থাকে। এক হাসির এত ব্যবহার বিস্ময়কর। অবশ্য আমার ধারণা, এই হাসি সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। গতকাল আর আজ ফেসবুকে শত শত পোস্টে, অসংখ্য হাহাকারে মিজান ভাইয়ের যে কটি ছবি দেখতে পাচ্ছি, প্রায় সব কটিতেই সেই হাসি বিবৃত হয়ে আছে। সেই হাসি দিয়েই যেন বললেন, গেলাম ব্রাদার।

মিজান ভাইয়ের ঘরে গেলে দেখতাম, আইন, সংবিধান, সাংবাদিকতা বিষয়ে বড় বড় বই আর অজস্র কাগজপত্রের মধ্যে তিনি ডুবে আছেন। কিছু বললে, ওই বই আর কাগজপত্রের ভেতর থেকে জেগে উঠতে তাঁর একটু সময় লেগে যেত। মতি ভাই কখনো এসে বলতেন, মিজান, ঘরটাকে কী করে রেখেছ। গোছাও এগুলো।
গোছাব মতি ভাই।

তারপর তাঁর সেই হাসি। মতি ভাই যেমন বুঝতেন, তেমনি আমরাও, এই গোছানো আর হয়েছে। লেখা দেরিতে দেওয়ার কারণে মতি ভাই মাঝেমধ্যে বকাবকি করতেন। আবার আমাদের কাছে প্রশংসাও করতেন মিজান ভাই চলে গেলে।

আরও পড়ুন

প্রথম দিকে তিনি কম্পিউটারে কম্পোজ করতে পারতেন না। মতি ভাই তাঁকে একজন অপারেটর দিয়েছেন। তিনি ছোট–বড় নানা কাগজে নেওয়া আট–দশটা নোট দেখে, কখনো স্মৃতি থেকে বলে যেতেন। অপারেটর কম্পোজ করতেন। মাঝেমধ্যে অপারেটরের মাথা খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু মিজান ভাইয়ের ওই হাসিতেই ম্যানেজ হয়ে যেত ব্যাপারটা। তবে ওই অপারেটরের জন্য আমাদের করুণাই হতো। কারণ, অপারেটর এক হাত দূরে বসে কাজ করলেও মিজান ভাইয়ের গলা এক শ গজ দূর থেকে শোনা যেত। তিনি তন্ময় হয়ে বলে যেতেন, কত জোরে কথা বলছেন বুঝতে পারতেন না। অফিসে তাঁর কাজের বাইরে কী ঘটছে, সে ব্যাপারে মিজান ভাইয়ের কোনো ধারণাই থাকত না।

একদিন সিএ ভবনের ছয়তলার ক্যানটিনে আমরা বেশ কয়েকজন বসে আছি। মিজান ভাই গরম পানিতে একটা চায়ের ব্যাগ দিয়ে বেরিয়ে যাবেন, সংবিধান বা আইন বিষয়ে চলমান কোনো ঘটনা নিয়ে একজন একটা প্রশ্ন করে বসলেন। দরজার মুখে থমকে দাঁড়ালেন মিজান ভাই। কাপটা রাখলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মিনিট দশেক পর দেখা গেল আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। মিজান ভাই কিন্তু বলেই যাচ্ছেন। হঠাৎ চোখ খুলে দেখলেন কেউ নেই। যিনি প্রশ্ন করেছেন, তিনিও নেই। মিজান ভাই কাপটা তুলে নিয়ে চলে গেলেন রুমের দিকে।

মিজান ভাই যখন এলেন ‘প্রথম আলো’য়, দেখলাম বেশ উঁচুতে পরা ঢোলা একটা প্যান্ট। ঢিলাঢালা একটা ভাব। ‘প্রথম আলো’র সবার সঙ্গে যেন তেমন একটা যায় না।

একদিন একটা লেখা ছাপা হলো। তার এক জায়গায় হতাশা প্রকাশ করতে গিয়ে লিখলেন, ‘ধন্য আশা কুহকিনী’। আমরা ভাবলাম এসব কি? মতি ভাই কোত্থেকে যে কাকে নিয়ে আসেন! সেই মিজান ভাই অচিরেই প্রমাণ করলেন, বুকের কাছে প্যান্ট পরা এই ঢিলাঢালা লোকটা নিজেকে নিয়ে গেলেন এক অনন্য উচ্চতায়। তিনি যা পারেন, আমরা কেউই তা পারি না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা, তাঁর অধ্যবসায়, কোনো একটা বিষয় নিয়ে দিন-রাত এক করে লেগে থাকা, তাঁর স্মৃতিশক্তি, যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষমতা আমাদের বিস্মিত করে দিল। তাঁর লেখা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল, সংবাদপত্রের সীমিত পরিসরে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতে হতো বলে এটা জটিলতর হতো। তবে তিনি নিজে যখন কম্পিউটারে লিখতে শুরু করেন তখন এ জটিলতা কমে গিয়েছিল। ‘প্রথম আলো’য় যেকোনো লেখা সম্পাদনা করা হয়, এমনকি সম্পাদক মতি ভাই পর্যন্ত কিছু লিখলে সেটা সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হক, অরুণ বসু থেকে শুরু করে আমাদের মতো অর্বাচীন অধমদেরও দেখতে দিতেন। এই প্রক্রিয়াও মিজান ভাইয়ের লেখাকে সহজতর করেছিল। অন্যদিকে তিনি যখন বলতেন, সেটা আমাদের সামনে হোক কি টেলিভিশনের পর্দায়, তাঁর যুক্তি ছিল স্বচ্ছ, বক্তব্য থাকত পরিষ্কার। যুক্তিগুলো তিনি উপস্থাপন করতেন অবিশ্বাস্য প্রজ্ঞায়। এত রেফারেন্স, এত ধারা-উপধারা কীভাবে মনে রাখতেন, সেটা এক বিস্ময়!

এটা আসলে তাঁর মুখে লেগেই থাকে। এক হাসির এত ব্যবহার বিস্ময়কর। অবশ্য আমার ধারণা, এই হাসি সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। গতকাল আর আজ ফেসবুকে শত শত পোস্টে, অসংখ্য হাহাকারে মিজান ভাইয়ের যে কটি ছবি দেখতে পাচ্ছি প্রায় সব কটিতেই সেই হাসি বিবৃত হয়ে আছে। সেই হাসি দিয়েই যেন বললেন, গেলাম ব্রাদার।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয় ড. কামাল হোসেনের ‘বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ (ইউপিএল) বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘বাংলাদেশ: সত্য ও ন্যায়ের সন্ধানে’। অনুবাদ মিজান ভাই—মিজানুর রহমান খানের। এর বেশ আগে এ বইয়ের কাজে আমি আর প্রথমার তখনকার উপব্যস্থাপক (এখন ব্যবস্থাপক) হুমায়ুন কবির ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে যাই। তখন কোনো একটা লেখার কারণে মিজান ভাইয়ের নিরাপত্তা বিষয়ে একটু সংশয় দেখা দিয়েছিল। সত্য বলতে কি, মিজান ভাই একটু লুকিয়েই ছিলেন তখন। কথায় কথায় মি. কামাল হোসেন বললেন, আইন জিনিসটা মিজান যতটা বোঝে, অনেক নামকরা উকিল-ব্যারিস্টারও ততটা বোঝে না। ওকে কিনা লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে!

২০১৩ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয় মিজান ভাইয়ের ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’। এই বই করার সময় মিজান ভাই আমাদের জান পানি করে দিয়েছিলেন। আমি সব সময় চাইতাম লেখক পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করে দেবেন। তাঁর কাজ শেষ, এবার কাজ করব আমরা। মিজান ভাই এক দিন/দুই দিন পর আসতেন আর বলতেন, ভাই, এ জিনিসটা ঢোকাতে হবে। বলতাম, মিজান ভাই, আর কত। সেই হাসি। তবে শেষে তাঁর প্রত্যাশিত অংশ যোগও করে দিতাম। এটার মেকআপ খুব সহজ ছিল না। পাতায় পাতায় ফুটনোট। মেকআপ করার পর আসলেই কিছু ঢোকানো কঠিন। এবার তো আমি কোনোভাবেই সংশোধনী বা সংযুক্তি নেব না। মাথা তখন গরম। মিজান ভাই মতি ভাইয়ের শরণাপন্ন হতেন। মতি ভাই বললে তো করতেই হয়। মতি ভাই বলতেনও সেভাবে। বুঝছ না, মিজান একটু আওলা আছে। তবে যেটা দিতে চাচ্ছে, ইম্পরট্যান্ট।

কষ্ট করে ঢুকিয়ে দাও। দিয়েছি। ওই সময় কথা–কাটাকাটি হয়েছে মিজান ভাইয়ের সঙ্গে। তর্কবিতর্ক হয়েছে। অভিযোগ করেছি। রেগেছি। আবার ওই হাসি সব ভুলিয়েও দিয়েছে। আজ দেখি ওই বইয়ের নবম সংস্করণ বাজারে। আরও কত মুদ্রণ হবে। মিজান ভাই দেখবেন না। একবার ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার সুযোগও আর থাকল না। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে এই দু–একটা তিক্ততা, ধরতে গেলে ‘প্রথম আলো’য় আর কারও সঙ্গে হয়তো তেমনটি নেই। সে জন্যই কিনা জানি না, তাঁর মৃত্যু আমাকে আরও বেশি ক্ষমাহীন, অস্থির করে রেখেছে। মনে হচ্ছে আমিই সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছি।

আরও পড়ুন

কাল আর আজ ফেসবুকে শুধু মিজান ভাই। অনেক দিন আগে চট্টগ্রামের সবুজ হোটেলে আর পাশে সোবহানিয়ার চত্বরে আমাদের আড্ডায় এক তরুণ আসত—সুরেশ কুমার দাশ। কয়েক বছর আগে দেখি সেই সুরেশ এসেছে মিজান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। ঢাকায় সাংবাদিকতা করে। গতকাল সে মিজান ভাইয়ের ছবিসহ একটা পোস্ট দিয়েছে। মিজান ভাইয়ের নাম লেখেনি। শুধু লিখেছে, ‘আর কোনো ঈশ্বরের কাছে কোনো ফরিয়াদ নেই...। ’ তার টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম, ২৭ ডিসেম্বর দেওয়া একটা পোস্টে সে ঈশ্বরের কাছে মিজান ভাইয়ের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছিল।

সেই আবেদন—আমার, আপনার, সুরেশের, দেশে–বিদেশে মিজান ভাইয়ের অসংখ্য পাঠক, দর্শক, ভক্ত, সহকর্মীর—নামঞ্জুর হয়েছে।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]