ক্যামেরা আর কম্পিউটার দিয়ে যেভাবে খুঁজে ফেরা হলো নজরুলকে

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন অবলম্বনে সম্প্রতি ‘শেষ হয় নাই বেলা’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন শাকুর মজিদ। সেখানে ক্যামেরা ও কম্পিউটার দিয়ে জাতীয় কবিকে খুঁজে ফিরেছেন তিনি। রাজধানীর বনানীস্থ বুয়েট গ্র্যাজুয়েটস ক্লাবে নজরুলজয়ন্তী আয়োজনে প্রদর্শিত এই প্রামাণ্যচিত্র সুধীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

‘শেষ হয় নাই বেলা’ প্রামাণ্যচিত্রের পোস্টার

সবকিছুকে ভিন্নভাবে দেখাই আধুনিকতা; তবে তার মধ্যে অবশ্যই বিজ্ঞানচিন্তা ও যুক্তি থাকা প্রয়োজন। রবীন্দ্র–নজরুল চর্চ্চার মধ্যেও সেই আধুনিকতা দাবি করে। সম্প্রতি নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন উদ্যোগ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাজধানীর বনানীস্থ বুয়েট গ্র্যাজুয়েটস ক্লাবে নজরুলজয়ন্তী আয়োজনে এক ভিন্ন উপস্থাপনা দেখা গেল। এ ধরনের আয়োজন সাধরণত একটি গবেষণায় থাকে। কিছু গবেষক ও নজরুল অনুসারীর বক্তব্য, সংগীত পরিবেশনা ও আবৃত্তিতে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে যায়। এই অনুষ্ঠানেও গান, আবৃত্তি, উপস্থাপনা ছিল; কিন্তু আরও কিছু যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত করেছে, সে বিষয়ে দুটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। 

নজরুল এখনো অনাবিষ্কৃত এক বাঙালি সৃজনশীল মহীরুহ, যিনি মাত্র ২১ বছরের বিস্ময়কর সৃজনচাঞ্চল্য দিয়ে বাংলার শিল্পসাহিত্যে একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। একেবারেই মক্তব–মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু, লেটোগানের দলে সঙ্গীতচর্চার সূচনা, প্রথাগত শিক্ষারও তেমন সুযোগ পাননি। করাচিতে এক মাওলানার কাছে আরবি, উর্দু, ফার্সি শিক্ষা গ্রহণ করেন, এরপর কী করে তিনি এত ধর্মের পুরাণ, আন্তর্জাতিকতা, শ্রেণিসংগ্রাম—এসব নিয়ে একটি বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন? এসবই ওই অনুষ্ঠানে ছিল। কিন্তু মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে সত্যনিষ্ঠ চর্চায় তা যেমন বিশ্বস্ত এবং বাঙ্‌ময় হয়ে উঠেছে, অতীতে এমন প্রচেষ্টা আর দেখা যায়নি। 

ইঞ্জিনিয়ার্স ক্লাবে নজরুলজয়ন্তী আয়োজনে কথা বলছেন প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা শাকুর মজিদ

অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থাপক ছিলেন দুজন নজরুলগীতির ঋদ্ধ গায়েন—শাহীন সামাদ ও সুজিত মুস্তফা। এদের সঙ্গে আরও ছিলেন শহীদ কবির ও মাহবুবা আকন্দ। আর অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন আরিফ রানা ও নায়না তাবাসসুম।

ছিল একটি মাল্টিমিডিয়া যন্ত্র। এই যন্ত্র খুঁজে খুঁজে নজরুলকে আবিস্কার করে যুক্ত হয়েছে পুরো আয়োজনে। দুর্লভ কিছু তথ্য, কিছু গান, আবৃত্তি ও নজরুল–সম্পর্কিত নানা তথ্য এবং তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবেদন পুরো গ্রন্থকে জীবন্ত করে তুলেছে। বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্রেও নজরুল আবিষ্কারের কাজটি হয়েছে; কিন্তু ভিন্নতা অন্যখানে। এখানে যুক্ত হয়েছে এক খুঁজে বেড়ানো শিল্পী ও তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাতাল—মর্ত্য! আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ। সে কি উন্মাদ? এই উন্মাদের শীর্ষের সন্ধান পাওয়া গেল, যাঁর নাম শাকুর মজিদ। এই শাকুর আবার শিল্পের ক্ষেত্রে বহুগামী। প্রকাশ ভঙ্গিমায় যখন যা প্রয়োজন হয়, তা–ই তিনি করেন। নজরুলের এক হাতে বাঁশের বাঁশরী আর অন্য হাতে ছিল রণতূর্য। শাকুর মজিদের এক হাতে ক্যামেরা, অন্যহাতে কম্পিউটার।

বাংলায় একট প্রবাদ আছে, ‘খ্যাপা খুঁজে ফেরে।’ এই খুঁজে ফেরার খ্যাপাদের আজ প্রবল অনটন। এই অনটনের কালে শাকুর মজিদ খ্যাপা নজরুলকে নিয়ে এসেছেন।

যখন প্রয়োজন হয় শাহ্ আবদুল করিমকে নিয়ে মঞ্চে নাটক করতে হয়, তখন তিনি লেখেন মহাজনের নাও; হাসন রাজাকে নিয়ে লেখেন মঞ্চেই। সেই নাটকগুলোও মঞ্চসফল হয়ে যায় দেশে-বিদেশে। ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে ক্যামেরা নিয়ে বেড়াতে যান গ্রিসে। গ্রিসের প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে আবিষ্কার করেন সক্রেটিসকে। প্রাচীন শহর কলকাতায় গিয়ে তিনি খুঁজে ফেরেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। বিদেশের ভ্রমণ তাঁর কাছে শুধু চোখের দেখা নয়, থাকে ক্যামেরার লেন্স। সেই লেন্সই কখনো তৃতীয় চক্ষু হয়ে কম্পিউটারের সঙ্গে বসিয়ে দেযন, তাতেই বইয়ের পর বই লেখা হয়ে যায়। প্রকাশভঙ্গি সহজিয়া হওয়ার ফলে পাঠক অবলীলায় তা পাঠ করে একটা নতুন ভাবনায় উপনীত হতে পারেন। ভ্রমণকাহিনির জন্য বাংলা একাডেমি থেকে তিনি পুরস্কৃত হন। এই শেষ হয় নাই বেলা প্রমাণ্যচিত্রটির প্রধান বিষয় হচ্ছে, খুঁজে বেড়ানো। নজরুলের ওপর সর্বশেষ বই গোলাম মুরশিদের বিদ্রোহী রণক্লান্ত। তিনি বলেন, এটি তাঁর এই নির্মাণের গবেষণার কেন্দ্র। দুর্লভ সব গান, আঙ্গুর বালা, নীহার বালা, নজরুলের স্বকণ্ঠের গান, দুর্লভ সব আবৃত্তি যথাস্থানে স্থাপিত হয়ে অভিনব এক দ্যোতনার সৃষ্টি করেছে।

বাংলায় একট প্রবাদ আছে, ‘খ্যাপা খুঁজে ফেরে।’ এই খুঁজে ফেরার খ্যাপাদের আজ প্রবল অনটন। এই অনটনের কালে শাকুর মজিদ খ্যাপা নজরুলকে নিয়ে এসেছেন। নজরুলের এক নগণ্য ভক্ত হিসেবে তাঁকে জানাই অভিনন্দন।