কেমন ছিল মহীনের আদি ঘোড়ার শেষ দিনগুলো

২৫ জুন কলকাতায় প্রয়াত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রবাদপ্রতিম ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপী দাস। বেশ কিছুদিন ধরে ফুসফুস ক্যানসারে ভুগছিলেন এই শিল্পী। এমনকি মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগেও বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে যে কনসার্ট হওয়ার কথা, তার জন্য স্মারক টি-শার্টে স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের রক মিউজিক গবেষক গৌতম কে শুভর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর। কেমন ছিল মহীনের এই আদি ঘোড়ার শেষ দিনগুলো?

হাসপাতালের বিছানায় তাপস বাপী দাস। তখনো তাঁর ক্যানসার ধরা পড়েনি, সেপ্টেম্বর ২০২২ছবি: লেখক

‘ফিরব না পিছনে/আর অন্ধকারে,/শব্দহীন শব্দের এই আঁধারে।’

‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গানের ‘শব্দহীন শব্দের এই আঁধারে’ ব্যাপারটি আমি প্রথম অনুভব করলাম ২৫ জুন রোববার সকাল সাড়ে ১০টায়, কলকাতা থেকে যখন ফোনে ভেসে এল, ‘বাপীদা আর নেই।’ এরপর কয়েক মিনিট আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিছুই। হঠাৎ মৃত্যুসংবাদ শুনে বিশ্বাস না করতে পারার ব্যাপার হয়ে থাকে অনেক সময়। না, আমার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। কারণ, আগের দিন রাতেও সুতপা দিদির (বাপীদার স্ত্রী) সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার বাপীদার শরীরটা বড্ড খারাপ।’ তখন এসএসকেএম হাসপাতালে ক্যানসারের রুটিন চিকিৎসা ইমিউনোথেরাপি চলছিল তাঁর। 

বলছিলাম কলকাতার বিখ্যাত ও প্রবাদপ্রতিম ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপী দাস, আমাদের সবার ‘বাপীদা’র কথা। বাপীদা মননে ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক বাঙালি। ‘ছিলেন’ কেন বলছি? তিনি তো আজীবন থাকবেন এই পৃথিবীর আস্তাবলে, মহীনের ঘোড়া হয়ে চরে বেড়াবেন জ্যোৎস্নার প্রান্তরে। 

ফুসফুস ক্যানসারের সঙ্গে বাপীদার লড়াই বছরখানেকের। আরও অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। কিন্তু কখনো থেমে থাকেননি। কাজ করে চলেছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন হাঁটতে না পারলেও এই আদি তেজি ঘোড়ার তেজের কমতি কখনোই হয়নি। টগবগিয়ে ছুটেছেন জীবনজুড়ে। বাপীদা সত্তরের আত্মা। সক্রিয় থেকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সাংগীতিক দর্শন বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন একমাত্র তিনিই। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র প্রধান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর, ২০০৩ সালে বাপীদা নতুনদের নিয়ে ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’ নামে ব্যান্ড করলেন। এর পর থেকেই গানে কিংবা লেখায় সক্রিয় থেকেছেন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি থেকে গেলেন মহীনের কাউন্টার কালচারের অন্যতম আদি ঘোড়া হয়ে। আপস করলেন না কখনোই, তাঁর গুরু গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতো।

গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিক তাঁর ছোট একটি অপারেশন হয়েছিল। আমি তখন কলকাতায় আমার বাবার চিকিৎসা করাচ্ছি। তখনো কিন্তু বাপীদার ক্যানসার ধরা পড়েনি। আমি দেখা করতে গেলাম হাসপাতালে। এখানেই নাকি বাপীদা গত ১০ বছরে চারবার ভর্তি হয়েছেন। তাই এখানে সবাই তাঁকে চেনে ‘মহীনের জ্যেঠু’ নামে। বাপীদা আমাকে দেখেই বললেন, ‘কত কথা বলার আছে তোমার সঙ্গে! কিন্তু আমি এখন এই অবস্থায়!’ আমি বললাম, আপনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবেন। এরপর আমরা আমাদের প্রজেক্টগুলো নিয়ে কথা বলব। 

বাপীদা এরপর আর সুস্থ হননি। আমার সেই সব প্রজেক্ট নিয়ে আর এগোনো হয়নি। 

তাপস বাপী দাস, ১৯৮০ সালের দিকে
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ঘণ্টা তিনেক ছিলাম সেখানে। তখনই দেখলাম, আগামী মাসে কয়েকটা কনসার্ট আছে ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’র। বাপীদা সেগুলো নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায় হেলান দিয়েই। যদি পুরোপুরি সেরে না ওঠেন, তবে অসুস্থ শরীর নিয়ে কোন কোন গান তিনি গাইতে পারবেন, সেগুলো নিয়েও আলাপ করলেন। সুতপাদি জানালেন, আজ যতটা স্বাভাবিক প্রাণবন্তভাবে কথাবার্তা বললেন, গত ১৫ দিনে নাকি অসুস্থতার জন্য এতটা কথাই বলেননি কারও সঙ্গে। 

বাপীদা সেদিন একনাগাড়ে আমাকে বলে যাচ্ছিলেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সেই সব দিনের কথা। তাঁর মণিদার (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) সব পাগলামির কথা। মণিদা সাগরেদদের নিয়ে কীভাবে চষে বেড়িয়েছেন গোটা শহর। ১৯৭৯ সালে কলকাতায় ইন্টারন্যাশনাল জ্যাজ ফেস্টিভ্যালে একমাত্র ভারতীয় ব্যান্ড হিসেবে পারফর্ম করেছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, সেই গল্প করলেন। 

আদতে বাপীদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক দিনের। তিনি জানতেন আমি বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছি। তাই আমাকে বলছিলেন, কলকাতার ষাট-সত্তরের জ্যাজ মিউজিকসিনের কথা; এবং সেটা কীভাবে হাতছাড়া হয়ে অন্য একটি ধারায় ঢুকে গেল। গোটা পালাবদলটা যে আদতে ভূরাজনৈতিক, সেটা বোঝালেন। এসব তাঁর নিজের চোখে দেখা। আমি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংগীত নিয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান দেখে!

এর দিন সাতেক পর জানতে পারলাম, বাপীদার শরীর ঠিক হয়নি। আমি তখন ঢাকায় ফিরেছি। চিকিৎসকের রিপোর্টগুলো চাইলাম। সেই রাতে রিপোর্ট ভালোভাবে পড়ে, বুঝে তখনই সুতপা দিদিকে ফোন করলাম। জানালাম, রিপোর্ট পড়ে যেটুকু বুঝলাম, তাতে সন্দেহ হচ্ছে যে ফুসফুসে সমস্যা আছে। পরামর্শ দিলাম, কলকাতা টাটা মেডিকেলে দেখানোর, আমার বাবারও সেখানে চিকিৎসা চলছিল। 

বাপীদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক দিনের। তিনি জানতেন আমি বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছি। তাই আমাকে বলছিলেন, কলকাতার ষাট-সত্তরের জ্যাজ মিউজিকসিনের কথা; এবং সেটা কীভাবে হাতছাড়া হয়ে অন্য একটি ধারায় ঢুকে গেল। গোটা পালাবদলটা যে আদতে ভূরাজনৈতিক, সেটা বোঝালেন। এসব তাঁর নিজের চোখে দেখা। আমি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংগীত নিয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান দেখে!

এরপর সেখানে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হলো। পরীক্ষা করে জানা গেল, বাপীদার ক্যানসার। তৃতীয় ধাপে আছে, কেমোথেরাপি দিতে হবে। সেদিনই চিকিৎসা শুরু হলো। মাসখানেক পর আবার কলকাতায় গেলাম। তখন বাপীদার দ্বিতীয় দফার কেমোথেরাপি চলছে। বাপীদার মনের জোর ঈর্ষা করার মতো। একবারের জন্যও ভেঙে পড়েননি তিনি। আমার বাবার চিকিৎসার জন্য সে সময় প্রায়ই আমাকে কলকাতায় যেতে হতো। আমি কলকাতায় গেলে মাঝেমধ্যেই অক্সিজেনের নল খুলে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করতেন বাপীদা। একবার জানালেন, এবার সুস্থ হলে আমরা যেন তাঁকে বাংলাদেশে গাইতে ডাকি। বাপীদার পূর্বপুরুষের বাড়ি বাংলাদেশে। তাই আমার সঙ্গে যখনই কথা হতো, জানাতেন, তিনি বাংলাদেশে যেতে চান। তখন কথাপ্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত নিয়ে কথা বললাম তাঁর সঙ্গে। বাংলাদেশে এখনো ওপেন এয়ার কনসার্টে দশ হাজার মানুষ টিকেট কেটে গান শুনতে যায় জেনে বাপীদা তাঁদের ১৯৭৫-৮১ সালের ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র লড়াইয়ের গল্প শোনালেন। গত ২০ বছরে তিনি আরও অনেক কিছু করতে পারতেন, প্রবল ইচ্ছা থাকার পরও কেন সেসব পারেননি, সেই আক্ষেপের কথা জানালেন। বিছানায় শুনেই অনর্গল বলে গেলেন ‘মহীনের ঘোড়া’দের ইতিহাস, একেকটা গান তৈরির কথা। সেসব ইতিহাস মাথায় নিয়ে আমি কয়েক দিন পর ঢাকায় ফিরে এলাম।

‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য—গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও তাপস বাপী দাস
ছবি: সংগৃহীত

তারপর আবার ডিসেম্বরের শুরুতে গেলাম সেখানে। সুতপা দিদির কাছে এর মধ্যেই জেনে গেছি, ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাঁর জমানো টাকা সব শেষ। কিন্তু তিনি ও সুতপা দিদি—কেউই কোনোভাবেই কোনো আর্থিক সাহায্য নিতে চান না। এমনকি বাপীদার ক্যানসারের কথাও যেন কাউকে না জানাই, এমন বললেন আমাকে। 

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের বাড়িতে গেছে আর্থিক সাহায্য নিয়ে, বাপীদা সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাঁর চিকিৎসা তাহলে চলবে কীভাবে!

কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবলাম কয়েক দিন। কয়েকজন সিনিয়র প্রবাসী শিল্পীকে জানালাম বাপীদার আর্থিক অবস্থার কথা, যাঁরা তাঁর বন্ধুস্থানীয়। তাঁদের দুজন বেশ ভালো অঙ্কের টাকা পাঠালেন তাঁকে। কিন্তু এই চিকিৎসা এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত যাবতীয় খরচের তুলনায় এমন পরিচিতজনদের আর্থিক সহায়তা ছিল বেশ সামান্যই। তাই সুতপা দিদিকে অনুরোধ করলাম, তাঁরা যেন অন্তত সবাইকে জানান যে বাপীদা ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। 

তাপস বাপী দাস পরিণত বয়সে
ছবি: সংগৃহীত

পরে আমি একপ্রকার বাধ্য হয়ে ফেসবুকে বাপীদার ক্যানসারের কথা জানিয়ে লিখলাম। আর্থিক সাহায্য দরকার, সেটা সরাসরি না লিখে লিখলাম, আমাদের উচিত তাঁদের খোঁজখবর নেওয়া। কিছু লাগলে সেটার ব্যবস্থা করা। কলকাতার কয়েকজন পরিচিত সাংবাদিকসহ পরিচিত বন্ধুদের জানালাম। জনপ্রিয় এক ব্যান্ড তারকা ব্যাপারটি জানতে পেরে চিকিৎসার কথা ফেসবুকে লিখলেন। মূলত তাঁর মাধ্যমেই সবার কাছে পৌঁছে গেল বাপীদার অসুস্থতার কথা। তখন কলকাতার শিল্পীরা এগিয়ে এলেন। তাঁরা বিভিন্নভাবে কনসার্টের আয়োজন করে, অনলাইনে গান গেয়ে চিকিৎসায় সহায়তার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে লাগলেন। 

কিছুদিন পর রাজ্য সরকার থেকে সুতপা দিদিকে জানানো হলো, বাপীদার সব  চিকিৎসার দায়িত্ব তারা নিচ্ছে। আমি তখন টাটা মেডিকেলে সুতপা দিদির পাশে বসা। ফোন রেখেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গৌতম, আমরা এখন কী করব?’ কারণ, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের সুবিধা নিতে চান না। আমরা পাশে যাঁরা ছিলাম, তাঁরা বোঝালাম, এটা কোনো রাজনৈতিক দলের দেওয়া সুবিধা নয়, এটা একজন কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে বাপীদার প্রাপ্য অধিকার রাষ্ট্রের কাছে। তার পর থেকেই এসএসকেএম হাসপাতালে বাপীদার চিকিৎসা চলছিল। 

‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র পরিবেশনা
ছবি: সংগৃহীত

আমি তারপর আরও কয়েকবার বাপীদার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। ফোনে নিয়মিত খোঁজখবর রেখেছি। বাপীদা আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন, সেটা আমি কখনো লিখে প্রকাশ করতে পারব না। সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশ থেকেও তাঁর চিকিৎসার সহায়তায় কনসার্টের আয়োজন করেছিলাম, সেখানে বাংলাদেশের ৩৫ শিল্পী ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গান গাইবেন। ব্যাপারটা যখন প্রথম বাপীদার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম, তখন খুব খুশি হয়েছিলেন। কারণ, তিনি নিজে আর বাংলাদেশে আসতে না পারলেও তাঁকে স্মরণ করে আমরা কিছু করতে চলেছি, এটা তাঁর ভালো লেগেছিল। 

মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগেও তিনি আমাদের কনসার্টের জন্য স্মারক টি-শার্টে স্বাক্ষর করেছেন। আমরা আশা করছি, এই কনসার্ট রূপ নেবে বাপীদার স্মরণ উৎসবে, সেখানে স্ত্রী সুতপা ঘোষসহ তাঁর হাতে তৈরি ব্যান্ড ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’ উপস্থিত থাকবে। তাপস দাস বাপীরা মরেন না। তাঁরা আজীবন বেঁচে থাকেন আমাদের হৃদয়ে। আমরা যখন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ‘ভেসে আসে কলকাতা’, ‘সংবিগ্ন পাখিকুল’, ‘হায় ভালোবাসি’, ‘সুধীজন শোনো’, ‘এই সুরে বহু দূরে’—তাঁর লেখা বা সুর করা বা গাওয়া এসব গান শুনব, তখন ঠিকই আমাদের স্মৃতির মানসপটে বাপীদা নামক এক দৃশ্যের জন্ম হবে।

বিদায় প্রিয় বাপীদা, আস্তাবলের নালহীন এক ঘোড়া।

আরও পড়ুন