যেভাবে বিয়ে হয়েছিল বিমল করের

বিমল করছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে

ষাট ও সত্তরের দশকে তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বিমল কর। ‘কিকিরা সমগ্র’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘হ্রদ ও বালিকা বধূ’সহ তাঁর রয়েছে অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টি। লেখক হিসেবে বিমল কর ছিলেন খুবই সাহসী। তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে গিয়ে সামাজিক ‘ট্যাবু’ ভাঙতে কলম ধরেছিলেন তিনি।

তবে ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুব সাবধানী আর খুঁতখুঁতে। একা একা বাসে উঠতেন না। বিমানে চড়তে ভয় হতো বলে বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েও যাননি। বইমেলায় একা যেতেন না কখনো। এমনকি রাস্তা পার হতে সঙ্গী লাগত তাঁর। এসব কারণে ‘ভ্রমণ’ শব্দটা থেকে তফাতেই থাকতেন লেখক।

শেষ বয়সে একবার তাঁর পা ভেঙে গিয়েছিল, তবে ভয়ে হাসপাতালে যাননি। বিমল করের বাসাতেই পুরো হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা হয়েছিল। এখানে এসেই চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেছিলেন।

শুধু তা–ই নয়, একটা শিঙাড়া খেতে গিয়েও সাবধানতার শেষ ছিল না বিমল করের। তাঁর আড্ডার জায়গা ছিল কলকাতার এসপ্লানেডের কে সি দাশ মিষ্টির দোকান। সেখানে বসে শিঙাড়া খাওয়ার আগে চামচ দিয়ে ভেঙে ভেতরের পুর খুটিয়ে ভালোভাবে দেখে নিতেন। রোজ রোজ তাঁর এই কাণ্ড দেখে একদিন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি ও রকম করেন কেন?’ বিমল করের জবাব ছিল, ‘ভিতরে কাচের টুকরো, পেরেক থাকলে কী হবে?’ যদিও শিঙাড়ার মধ্যে এসব থাকবে কেন, তা ভেবেই পেতেন না সঞ্জীব।

তবে এত সাবধানী যে মানুষ, তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একবারও ভাবেননি, বিয়ের মতো একটা কাজ এত আচমকা তিনি করে ফেলতে পারেন, তা কে ভেবেছিল!

রেলের চাকরি ছেড়ে বেনারস থেকে কলকাতায় ফিরেছেন বিমল। কোথাও থিতু হতে পারছেন না। এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা বছর, গল্প লিখছেন। সাহিত্যিকদের আড্ডায় এদিক-ওদিক ঢুঁ মারছেন। সে সময় তাঁর খুব ভাব হলো গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে। গৌরকিশোর ঘোষ ছিলেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সাংবাদিক। তাঁর মাধ্যমেই বিমল কর লিখলেন ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য তাঁর প্রথম গল্প ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’।

গল্প ছাপা হওয়ার পর সেকি আনন্দ দুজনের! বাস মাতিয়ে তুললেন গৌর। চিৎকার করে সিট থেকে লাফিয়ে উঠলেন। পাশে বসে মিটিমিটি হাসছেন বিমল কর।

১৯৫১ সাল। বিমলের জীবন তখন অস্থায়ী শিবিরের মতো। প্রবল আর্থিক টানাটানি। এমনই এক দুপুরে বাসে যেতে যেতে বিমলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন গৌরকিশোর, ‘বিয়ে করবি? আমার একটা গরিব বোন আছে। কোচবিহারে থাকে। একটু কালো। স্কুলে চাকরি করে।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তরে বিমল বলেছিলেন, ‘করব।’

এরপর ৫ জুন কফি হাউসে হবু স্ত্রী গীতার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় বিমলের। পাঁচ দিন পরে ১০ জুন তাঁরা বিয়ে করেন! পরিবারের কাউকে জানাননি আগে। শুধু হাজারীবাগের বাড়িতে স্রেফ একটা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ‘বউভাতের আয়োজন করো।’

 এতে অবশ্য বিমল করের পরিবারের কেউই ক্ষুণ্ণ হননি। আর তাঁদের জুটিটাও ছিল দারুণ। আমৃত্যু তাঁরা একসঙ্গেই ছিলেন। ৫১ বছরের দাম্পত্য জীবনে খুব কম দিন স্ত্রীকে ছেড়ে থেকেছেন বিমল। মৃত্যুর আগে সন্তানদের বলেছিলেন, ‘আমরা মেড ফর ইচ আদার।’

গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন

সূত্র: উজ্জ্বলকুমার মজুমদার সম্পাদিত ‘বিমল কর: সময়-অসময়ের উপাখ্যানমালা’

সংশোধনী গতকাল ‘প্রথম আলো’র শুক্রবারের ক্রোড়পত্র ‘অন্য আলো’র প্রিন্ট সংস্করণে ‘যেভাবে বিয়ে হয়েছিল বিমল করের’ শিরোনামে এই লেখায় অসাবধানতাবশত  পশ্চিমবঙ্গের আরেক কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বইটির রচয়িতা হিসেবে বিমল করের নাম ছাপা হয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত। অনলাইন সংস্করণে বিষয়টি সংশোধন করা হলো। —বি. স.