আমি এখন সত্যের সন্ধানে আছি

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ষ ছবি: জিয়া ইসলাম
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ষ ছবি: জিয়া ইসলাম

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার জন্ম ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ, গবেষণা এবং প্রত্নসম্পদ অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও সংগঠনে তিনি তুলনারহিত। এক শ ছুঁই ছুঁই বয়সেও সদা কর্মব্যস্ত।

মাসউদ আহমাদ: আপনি তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং রেজাল্টও ভালো ছিল, প্রত্নতত্ত্বের মতো নীরস বিষয়ে উৎসাহী হলেন কীভাবে?

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া: আমাদের পরিবারে পুঁথিচর্চার একটা পরিবেশ ছিল। শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে পুঁথির বড় সংগ্রহ। আমার বাবা ছিলেন ফারসি ভাষার পণ্ডিত, তিনি পুঁথির পাঠক ও সংগ্রাহক ছিলেন। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়, পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই বলতে পারেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় আমার। এরপর কর্মজীবনের প্রথম থেকেই আমি প্রত্নসম্পদ বিষয়ে জরিপ ও নোট নেওয়া শুরু করি। ১৯৪৬ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে। সেই সময় নৃতত্ত্বের ওপর কাজ করছিলাম আমি। তখন নৃতত্ত্বের ওপর বইপত্র তেমন পাওয়া যেত না। আর ঠিক ওই সময়েই আমি গেলাম মহাস্থানগড়ে। সেখানে গিয়ে তো আমি অভিভূত। আমাদের দেশে এত কীর্তি আছে! প্রকৃতপক্ষে, সেখান থেকেই আমার প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ শুরু হয়।

মাসউদ: আপনার লেখালেখির প্রকাশ এবং বইপত্র বেরিয়েছে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। এর কারণ কী?

যাকারিয়া: এক অর্থে এটা সত্য। আমি প্রায় ৪৮টি বই লিখেছি। এর বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছে চাকরি থেকে অবসরের পর। তবে আমার প্রথম বই বেরিয়েছে ১৯৭৪ সালে। আমি সবকিছু নোট করে রাখতাম এবং পরে ওই নোট অবলম্বনে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতাম। ১৯৪৭ সালে আমি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিই পাকিস্তানে। চাকরি করেছি সিভিল সার্ভিসে, ঘোরাঘুরির কাজ। আমি চাকরিতে পূর্ণাঙ্গ সময় দিয়েছি। ফাঁকি দিইনি। কাজেই চাকরিজীবনে বই তেমন লিখতে পারিনি। কিন্তু নোট রেখেছি। অবসর নেওয়ার পর একাগ্রচিত্তে বই লেখা শুরু করলাম। আমি অনেক বড় বড় বই লিখেছি। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার প্রতি সদয় হয়েছেন, আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছেন।

মাসউদ: প্রত্নতত্ত্ববিদ, পুঁথিসাহিত্যবিশারদ কিংবা অনুবাদক, প্রতিটি পরিচয়েই আপনি সফল এবং ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। আমরা জানি, কবি হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল আপনার। আপনি যে কবি হলেন না—এ নিয়ে কোনো দুঃখবোধ, ক্ষোভ কিংবা কোনো অপূর্ণতা আছে কি?

যাকারিয়া: (সশব্দে হাসি) আমি কিছু কবিতা লিখেছি। কিন্তু কবিতার কোনো বই বের করিনি। আমার কোনো অতৃপ্তি নেই জীবনে। প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই বোধ হয় কবিত্ব থাকে। সেই অর্থে কবি হয়তো আমি নই। বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়েছে। একটা পাণ্ডুলিপিও করেছিলাম। খুঁজে দেখতে হবে। আমার বইয়ের ব্যাপারে কাউকেই আমি বলি না যে আমার বইটা প্রকাশ করেন। যারা আগ্রহ নিয়ে চায়, তাদের দিই। কবিতার পাণ্ডুলিপি কেউ চায়নি, তাই সেটা প্রকাশের মুখ দেখেনি।

মাসউদ: বর্ণময় এই জীবনে, আপনার কোনো ধ্রুবতারা আছে কি? এমন কেউ, যিনি দূর থেকে প্রেরণা দিয়েছেন আপনাকে?

যাকারিয়া: আমি গরিবের সন্তান। আমার বাবা-মা আমাকে কষ্ট করে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। ম্যাট্রিক পাস করতে আমার একটু দেরি হয়েছিল। কারণ, আমার বাবা আমাকে ছোটবেলায় কোরআন শরিফের অনেকখানি মুখস্থ করিয়ে তারপর ইংরেজি স্কুলে দেন। আমার বাবার জন্ম জমিদার ঘরে। কিন্তু আমি জন্মেছি গরিব ঘরে। এবং ছোটবেলা থেকেই নীতিবোধটা খুব প্রবল ছিল। এটা আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। আমি সারা জীবনই সেই নীতিবোধ লালন করে গেছি। অন্য কিছুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করিনি। দীর্ঘ জীবনে আমি অনেক বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে গিয়েছি। তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখেছি, মিশেছি। অনুপ্রাণিত বোধ করেছি, কখনো বিস্মিত হয়েছি কারও কারও জীবনদর্শন এবং আদর্শ দেখে। কিন্তু আমার বাবা যেন কোথাও বসে, আড়াল থেকে সব সময় কলকাঠি নাড়েন। সে ক্ষেত্রে ধ্রুবতারার কথা যদি বলেন, তাহলে বাবাই আমার জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা। জীবনজুড়ে আমি তাঁর ছায়া বা প্রভাব অনুভব করি।

মাসউদ: প্রথম চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় আপনার বাবা সম্ভবত কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন আপনাকে?

যাকারিয়া: হ্যাঁ। আমি যেদিন চাকরিতে যোগ দিতে যাই বাবা বলেছিলেন, তুমি তো আমার চেয়ে বেশি লেখাপড়া করেছ। আমি তোমাকে কয়েকটি কথা বলব। কথাগুলো হলো হারাম খেয়ো না। দান কোরো, সুবিচার দিয়ো এবং তুমি যা খাবে, তোমার সার্ভেন্টকে তা খেতে দিয়ো। তোমার ইচ্ছে হলে মানতে পারো, নাও মানতে পারো। আমি সারা জীবন তাঁর কথা মেনে চলার চেষ্টা করেছি। এই বয়সে এসেও সেই নীতিবোধ পরিবর্তন হয়নি আমার।

মাসউদ: এখন আপনি কী ধরনের কাজ করছেন?

যাকারিয়া: আমি এখন কাজ করছি—সিয়ার-উল-মুতাখিখরীন বলে বিরাট একখানা ইতিহাস বই আছে, এটার দুই খণ্ড আমি অনুবাদ করেছিলাম। রিভিউ অব দ্য মডার্ন টাইম—সৈয়দ গোলাম হোসেন খান লিখেছিলেন; এর তৃতীয় খণ্ডটি বাকি ছিল, অনুবাদটা এখন চূড়ান্ত করছি। মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছি। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি বইটি পরিমার্জন করছি। প্রথম সংস্করণের চেয়ে কলেবর বাড়ানো হচ্ছে। আপাতত এসব নিয়েই আছি।

মাসউদ: আপনি মূলত প্রত্নতত্ত্ব এবং পুঁথিগবেষণায় নিমগ্ন ছিলেন। অনুবাদে, বিশেষ করে ফারসি ভাষার বই অনুবাদে, আগ্রহী হলেন কেন?

যাকারিয়া: আমি যখন প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন বাংলা ভাষায় তেমন কোনো বই পাওয়া যেত না। বাংলার নবাবি আমলের ইতিহাস এবং সুলতানি ও মোগল আমলে বাংলা অঞ্চল নিয়ে লেখা ইতিহাস গ্রন্থসমূহের ভাষা মূলত ফারসি। বাংলার ইতিহাসের উৎস অনুবাদের কাজ খুব একটা হয়নি বাংলায়। সে কারণে আমাকে ফারসি ভাষা বিশেষভাবে রপ্ত করতে হয়েছে।

মাসউদ: ফারসি ভাষায় আপনার এই যে বিশেষ দখল, কীভাবে এটা অর্জিত হলো এবং এর সূচনা কেমন করে?

যাকারিয়া: ফারসি বিষয়ে আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। আমাদের পরিবারে যে ভাষায় কথা বলা হতো, এর অর্ধেক শব্দই ছিল ফারসি। যেমন ডিমকে বলা হতো বয়দা, পুকুরকে বলা হতো তালাব ইত্যাদি। আমার বাবা মুনশি এমদাদ আলী মিয়া ছিলেন ফারসি ভাষার পণ্ডিত। উনিশ শতকের মধ্যভাগের মানুষ ছিলেন তিনি। আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় পড়াশোনা করলেও ফারসিতে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে পুঁথির একটি সংগ্রহশালা ছিল। একবার বাড়িতে আগুন লেগে সব পুঁথি পুড়ে যায়। বাবা পরে তাঁর সংগ্রাহক হয়েছিলেন। পুঁথিপাঠক হিসেবে তাঁর কদরও ছিল। এসব থেকেও আমি প্রভাবিত হয়েছি। আর ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আমার পাঠ্যসূচিতে ফারসি ছিল।

মাসউদ: প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা, পারিপার্শ্বিকতা ও অর্জিত গুণাবলি—এসব একজন শিল্পীকে তৈরি করে। আপনার ক্ষেত্রে এর কোনটি মুখ্য ছিল?

যাকারিয়া: আমি আসলে তেমন মেধাবী মানুষ নই। তবে পরিশ্রম করতে পারি। এটাকে আপনি আমার গুণ বা দোষ যা-ই বলেন, সেটা আমার রয়েছে। এ কারণে গবেষণাটা আমাকে দিয়ে হয়। লেখাপড়াটা ঠিকমতো করতে চেষ্টা করেছিলাম। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, এখন যেটা ঢাকা কলেজ, সেখান থেকে আমি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে দশম স্থান অর্জন করি। সবটাই আমার প্রকৃতিপ্রদত্ত বা জন্মগত নয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংসর্গ ও প্রভাব এবং এর ফাঁকে ফাঁকে যা-কিছু অর্জন তার হয়তো অনেকখানি পারিপার্শ্বিকতা থেকেও এসেছে।

মাসউদ: লেখালেখি, গবেষণা ও সাংগঠনিক ভাবনা—এসব এক পাশে সরিয়ে রাখলে, এখন আপনার সময় কীভাবে কাটে?

যাকারিয়া: এখন আমার সময় কাটে লেখাপড়া করি, খাই-দাই-ঘুমাই। বাগান করি। ছাদের ওপরে ফুল, সবজি, ভেষজের বাগান আছে; সেখানে দুই ঘণ্টা সময় দিই। মনের আনন্দেই বাগান করি। আর তো কিছু করার নেই আমার।

মাসউদ: আপনি ত্রিকালদর্শী মনীষা। জীবনসায়াহ্নে এসেও আপনি নিরলস, বর্ণাঢ্য এবং তরুণদেরও প্রতিদ্বন্দ্বী। এই বয়সে জীবন সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কী?

যাকারিয়া: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা খুব মুশকিল আমার জন্য। একটা কবিতা আছে—‘আভাস আমি পাইনি সন্ধান তার/ চুপটি করে বসে আছি কলরবে একাকার।’ আমি আসলে যেটা নিয়ে আরম্ভ করেছিলাম সেটাতে নেই। এখন আমি সত্যের সন্ধানে আছি। সত্য আদৌ পাব কি না জানি না। আর শাশ্বত সত্য বলে কোনো কিছু আছে কি না তাও আমি জানি না। বিরাট কনফিউশনের মধ্যে আছি। তবে আই অ্যাগরি টু ডিফারেন্ট। আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ আমি মেনে নিতে রাজি আছি। আপনাকে জোর করে আমি ভাঙাতে যাব না। আমিও জোর করে কারও কাছে আমার মতবাদ প্রচার করতে যাব না। এবং আমি যেটা সত্য বলে জানি, তা সত্য বলে আঁকড়ে ধরে থাকব; যতক্ষণ না আমার ভুল প্রকাশ পায় বা অন্য সত্য না পাই। আমি জোর করে কাউকে কিছু বলতে চাই না—আপ টু ওয়ান টু অ্যাকসেপ্ট অর নট টু অ্যাকসেপ্ট।

মাসউদ: সম্প্রতি দিনাজপুরে একটি জলাধার এবং মুন্সিগঞ্জে একটি বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই বিহারে অতীশ দীপঙ্কর পড়েছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

যাকারিয়া: দিনাজপুরের জলাধার সম্পর্কে আমি তেমন কিছু বলতে পারছি না। এটা সম্পর্কে আমি ঠিক জানি না। তবে মুন্সিগঞ্জে বিহার আবিষ্কার হওয়ার ঘটনাটি জেনেছি। এখানে অতীশ দীপঙ্কর পড়েছেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে এসব আবিষ্কার আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, যা থেকে আমরা জানতে পারব আমাদের সোনালি অতীতের কথা।