
মোহনা
হরিশংকর জলদাস
প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
দাম: ২২০ টাকা
জেলেদের নিয়ে জলপুত্র, বেশ্যাদের নিয়ে কসবি, মেথরদের নিয়ে রামগোলাম লেখার পর একাদশ শতকের কৈবর্তদের নিয়ে লিখলেন মোহনা। কেবল বারাঙ্গনাপল্লির সুন্দরী রমণীটির নাম ‘মোহনা’ বলেই এই উপন্যাসের নাম মোহনা নয়। ‘মোহনা থেকে বেশ কয়েক মাইল উজান পর্যন্ত মিষ্টি আর নোনাজলের মেশামেশি। আরও উজানে মিষ্টি জল। মোহনার দিকে সমুদ্রের মাছ। নোনাজলের মাছের আনাগোনা এ অংশে—তপসে, সুন্দরী, ভোলপোঁপা, পাঙাশ—এসব। ডমরনগরলগ্ন কালিন্দী জলে নানা মাছের ছড়াছড়ি। রোহিত, পাবদা, চিতল, কাতল, বাইম, কোড়াল, চিংড়ি, বাতাসি, বোয়াল। বর্ষায় কালিন্দীর এই অংশে ইলিশ ধরা পড়ে জালিকদের জালে। সমুদ্র থেকে উজান বেয়ে মিষ্টি জলে ডিম পাড়তে আসে ইলিশেরা। এসব মাছে জালিকদের জীবন চলে।’ এই যে নোনাজল আর মিষ্টি জলের মোহনার বাসিন্দা হালিক-জালিক তথা কৈবর্ত জনজীবনের সংগ্রামী আখ্যান বলেও এই উপন্যাসের নাম হয়ে উঠেছে মোহনা।
বরেন্দ্রভূমির বৌদ্ধ পাল রাজা আর সনাতন বিশেষত নমশূদ্র কৈবর্তদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ঘিরেই এই কাহিনি আবর্তিত। পাল রাজার উত্তরসূরি রামপাল আর কৈবর্ত রাজার উত্তরসূরি ভীমদেব যখন ক্ষমতায়, এই কাহিনি তখনই পূর্ণতা পেয়েছে। প্রেক্ষাপটে রয়েছে পাল রাজাদের ইতিহাস আর কৈবর্তরাজ প্রতিষ্ঠার নায়ক দিব্যকের বীরত্বগাথা। তবে এই কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে মোহনা নামের বারাঙ্গনা। কুড়িয়ে পাওয়া তথাকথিত জারজ সন্তান চণ্ডককে ্আশ্রয় দিয়ে ভীমদেব তাঁর রাজ্যের সমরনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেন। অসীম সাহস ও বীরত্বের অধিকারী চণ্ডক হয়ে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্রে কৈবর্তরাজ রক্ষার মুখ্য নিয়ন্তা। কিন্তু পিতৃপরিচয়হীন আত্মদ্বন্দ্বমুখর চণ্ডক একসময় বেশ্যাসক্ত হয়ে পড়ে। ছুটে যায় কালিন্দীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা বারাঙ্গনাপল্লিতে। যেখানে ‘ক্ষুধা মেটাতে আসে মাহুত, মশালচি, শ্মশানের ডোম, জল্লাদ; শরীরের ভার কমাতে আসে সৈন্য, চারণকবি, টিকিনাড়া ব্রাহ্মণ; আসে হাটুরিয়া, বাজারিয়া। আসে রাজন্য আর আসে চণ্ডক।’ এখানে প্রথম রাতে আধা পণ কড়ি দিয়ে মোহনার কুমারীত্ব কিনে নিয়েছিল চণ্ডক। রীতি মোতাবেক মোহনার বিয়ে হয়েছিল লোহার বঁটির সঙ্গে। কিন্তু সে রাত কাটাতে শুরু করে চণ্ডকের সঙ্গে। রাজপুত্রবধূর জন্য আনা নবরত্ন হার ছিনিয়ে এনে বারাঙ্গনা মোহনার গলায় পরিয়ে দিয়ে নিজের প্রেম প্রকাশ করে। স্বেচ্ছাচারিতা ও রূঢ়তার কারণে রাজপুত্রের সঙ্গে এবং কালক্রমে মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে বিরোধ বাধে চণ্ডকের। চণ্ডক সেই প্রতিশোধ নেয় যুদ্ধক্ষেত্রে। শত্রুপক্ষ পাল রাজাদের সঙ্গে হাত মেলায় সেনাপ্রধানের পদ পাওয়ার লোভে। যুদ্ধে কৈবর্তরাজ পরাজিত হয়, সবংশ নিধন হয়। কৈবর্তরাজ্যের মানুষ যে যার মতো পালিয়ে বাঁচে। চণ্ডক আসে পাল রাজাদের সেনাপ্রধান পদে অভিষিক্ত হওয়ার বারতা নিয়ে মোহনার কাছে। বারাঙ্গনাপল্লির সবাই পালিয়ে গেলেও সনকাবুড়ি, নপুংশক ধনারাম আর মোহনা মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে। সনকা পাল সেনাদের হাতে শহীদ হয়। আর বিশ্বাসঘাতক চণ্ডকের জন্য মোহনার থেকে যাওয়াকে সবাই যখন ঘৃণার চোখে দেখে, তখন মোহনা বলে, ‘তুমি আমাকে থুতু দাও আর অপমান করো, আমার এক কথা—চণ্ডকের জন্য আমাকে এই পল্লিতে থেকে যেতে হবে। তার ভালোবাসার দাম চুকাতে হবে যে আমাকে।’ হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতক চণ্ডক এলে শরীর দেয় মোহনা। তারপর সেনাপ্রধান পদে অভিষিক্ত হতে চণ্ডক রওনা হলে মোহনা ডাকে, ‘তোর আসল পুরস্কারটা নিয়ে যা রে চণ্ডক। তোরে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য আমি পালিয়ে যাই নাই। অধীর আগ্রহে তোর জন্য প্রতীক্ষা করছি।’ যে বঁটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মোহনার, সেই বঁটি দিয়ে সে কুপিয়ে হত্যা করে চণ্ডককে। স্বজাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিল বারাঙ্গনা মোহনা। মোহনা এখানে কেবল প্রেমিকা নারী নয়, হয়ে উঠল কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রকৃত নায়ক। পতিতা হয়েও মোহনা হয়ে উঠল পরাজিত পতিত সমাজের একমাত্র বিজয়ী বীর। সমাজের অপাঙেক্তয়, অস্পৃশ্য, দলিত, নমশূদ্র নারী মোহনা হয়ে উঠল শ্রদ্ধেয় ও নন্দিত। এভাবে নিন্দিত চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তোলার জন্য হরিশংকর জলদাসের সাহিত্যিক সাহসকে আমরা সাধুবাদ জানাতে চাই।
লেখক নমশূদ্রদের বলেছেন ‘শূদ্রের শূদ্র নমঃশূদ্র’। এটি ‘রাজার রাজা মহারাজা’র মতো সরল সমীকরণের ব্যাপার নয়। শূদ্র আর নমশূদ্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, লেখকের সেটি অজানা থাকার কথা নয়।
উপন্যাসের সময় একাদশ শতক হলেও ভাষায় তেমন জটিলতা সৃষ্টির প্রবণতা নেই। তরতর করে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। টানটান উত্তেজনাও ছড়িয়ে রাখতে পেরেছেন কাহিনির পরতে পরতে। আগের উপন্যাসগুলোয় ভাষার জড়তা ও চরিত্রের শিথিলতা কিছুটা থাকলেও, এই উপন্যাস তা থেকে মুক্ত। পুরস্কার-স্বীকৃতির পর্যায় পেরিয়ে মোহনার মাধ্যমেই শুরু হতে পারে হরিশংকর জলদাসের কথাসাহিত্যের নবযাত্রা।