ধীরে চলা

(দশম কিস্তি) 

১০  

মাদাম যখন গল্প করছিলেন, তখন চারপাশ দেখে নিচ্ছিলেন, মেপে নিচ্ছিলেন, ভেবে নিচ্ছিলেন পরে কী কী করতে হবে, তাঁর সঙ্গীকে সুযোগ দিচ্ছিলেন এটা ভাবতে যে এরপর কী বলতে হবে, কী করতে হবে। মাদাম এটা করছিলেন সুস্মিতভাবে, আভিজাত্যের সঙ্গে এবং পরোক্ষভাবে, যেন তিনি অন্য কোনো কিছু নিয়ে কথা বলছেন। শেভালিয়ের একটা প্রেম আছে, কমতেসের সঙ্গে, তার কথাও মাদাম পাড়েন, যেন যুবকটা এই ব্যাপারে ধাতস্থ হন, যাতে যুবা বিশ্বস্ততার কর্তব্য থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারেন, মাদামের মনে যে একেবারে বিপরীত একটা ফন্দি আছে, সেটাতে যেন তিনি ভারমুক্তভাবে অংশ নিতে পারেন। মাদাম যে কেবল আশু ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন, তা কিন্তু না, তিনি দেখতে পাচ্ছেন অতি দূরের ভবিষ্যৎ, তিনি শেভালিয়েকে এই ধারণা দিয়ে রাখছেন যে ভবিষ্যতে তিনি কমতেসির প্রতিযোগিনী হতে যাচ্ছেন না। কাজেই শেভালিয়ের উচিত হবে না কমতেসিকে পরিত্যাগ করা। তিনি যুবককে একটা স্বল্পমেয়াদি কোর্স করান ভালোবাসার ওপরে। আবেগীয় শিক্ষা বিষয়ে। ভালোবাসার ব্যাপারে তাঁর যে বাস্তব দর্শন, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন শেভালিয়েরকে। তিনি তাঁকে শেখান যে নৈতিকতার বিধির অত্যাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। গোপনীয়তার শর্ত দ্বারা সুরক্ষিত রাখতে হবে সবকিছু। সকল পুণ্যের ধারণা থেকে মুক্ত থাকাই হলো আসল পুণ্য। এবং মাদাম খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকে এটাও শেখালেন যে পরদিন যখন তার স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে, তখন কী রকম ব্যবহার করতে হবে।
আপনারা কি বিস্মিত হচ্ছেন? ভাবছেন, এই যে একটা মানচিত্র, যা খুবই যুক্তি দিয়ে সাজানো, নকশা করা, হিসাব করা, পরিকল্পিতভাবে আঁকা, মাপা, সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা, পাগলামো, ঘোরগ্রস্ততা, কামনার অন্ধত্ব, পাগলামোতে পরিপূর্ণ ভালোবাসার স্থান কোথায়, যার কথা সুররিয়ালিস্টরা আদর্শায়িত করে গেছেন, কোথায় সেই নিজেকে হারানো? আমরা ভালোবাসা বলতে যে অযৌক্তিক কাণ্ডকারখানার গুণাবলিকে বুঝিয়ে থাকি, সেসব কোথায়? না। এখানে সেসবের কোনো জায়গা নেই। কারণ মাদাম টি হলেন যুক্তিশৃঙ্খলার রানি। মার্কিস দে মেরতুর নিঠুর যুক্তিবাদ নয় এটা, এ হলো নরম, ভদ্র যুক্তিবাদ, এই হলো সেই যুক্তিবাদ, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভালোবাসাকে রক্ষা করা।

আমি দেখতে পাচ্ছি, তিনি শেভালিয়েরকে চাঁদের আলোর ভেতর দিয়ে নিয়ে চলেছেন। এবার তিনি থামলেন। যুবাটিকে দেখালেন ওই যে দেখো একটা কুটিরের ছাদ দেখা যাচ্ছে। আহ, কী একটা কামুকতাপূর্ণ মুহূর্ত দেখল এই দোচালাটা। আহা, কী করুণ কথা, তিনি বললেন, এই ঘরের চাবি তাঁর কাছে নেই। তাঁরা দরজার দিকে গেলেন। কী উদ্ভট। কী অপ্রত্যাশিত। ঘরটার দরজা খোলা।

কেন তিনি বললেন যে তিনি চাবি আনেননি? কেন তিনি বললেন না যে এই ঘরে বহুদিন আসলে তালাচাবি দেওয়া হয় না? সবকিছুই আগে থেকে লিপিবদ্ধ করা। বানিয়ে তোলা। কৃত্রিম। সবকিছু সাজানো নাটক। কোনো কিছু সোজাসাপ্টা নয়। বা অন্য কথায়, সবকিছুই শিল্প। এই ক্ষেত্রে সাসপেন্স দীর্ঘায়িত করার শিল্প। আরও ভালোভাবে বলা যায়, যত দীর্ঘক্ষণ পারা যায় কামোত্তেজনা ধরে রাখার শিল্প।

[প্রিয় পাঠক, আনিসুল হক বলছি। আমরা কিন্তু একটা উপন্যাস পড়ছি, যার নায়ক নায়িকা ভেরাকে নিয়ে একটা হোটেলে আছে। ভেরা ঘুমাচ্ছেন। আর নায়ক জানালা দিয়ে বাগান দেখছেন। কোথায় সেসবের বর্ণনা। আমরা একটা পুরোনো উপন্যাসের গঠনশৈলী নিয়ে আলোচনা করছি। আপনারা আসুন ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে। দেখা যাক, সেখানে কী ঘটে!]