প্রেম ও যুদ্ধের উপন্যাস

অলতাচক্রআহমদ ছফাপ্রকাশক: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানিআহমদ ছফা একই সঙ্গে মননশীল ও সৃজনশীল লেখক হিসেবে পাঠকের কাছে নন্দিত। তাঁর প্রতিটি গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে আপন অভিজ্ঞতা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও কল্পনার মিশেলে। অলাতচক্রও ব্যতিক্রম নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে তিনি যেসব কলাকুশলী বেছে নিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ আমাদের চেনা মুখ; রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মানুষ।উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র তায়েবা লাখ লাখ শরণার্থীর একজন, যিনি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে সপরিবারে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। লেখকের বয়ানে আমরা জানতে পারি, তায়েবা একজন সংস্কৃতিকর্মী, তাঁর বোন ডোরা রবীন্দ্রসংগীতের প্রখ্যাত শিল্পী। বাঙালির সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সাহসী কর্মী তায়েবা ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ১৪৪ ধারা ভেঙে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন।কিন্তু কলকাতায় দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনি যখন পিজি হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দানিয়েলের। দানিয়েল নামের ছদ্মাবরণে লেখক আহমদ ছফা বারবার নিজের উপস্থিতি জানান দেন পাঠককে।হাসপাতালে তাঁদের সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের শুরু, শেষও হাসপাতালে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে গোটা শহরে নিষ্প্রদীপ মহড়া চলতে থাকে, হাসপাতালে চিকি ৎ সক ও স্বজনহীন তায়েবার মৃত্যু হলো। লেখক যাকে বলেছেন, ‘আত্মবিসর্জন’। একাত্তরে যে অগণন সাধারণ মানুষ আত্মবিসর্জন দিয়েছে, তাদের কথা যেমন ইতিহাসে লেখা নেই, তেমনি আমরাও মনে রাখিনি।উপন্যাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আমরা প্রত্যক্ষ করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের গতি-প্রকৃতি, তার নানা পর্যায়, সবলতা ও দুর্বলতাগুলো। প্রত্যক্ষ করি লাখ লাখ নিরাশ্রয় মানুষের আকুতি, বেদনা ও স্বজন হারানোর শোক। সেই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থবাদিতা এবং দ্বন্দ্বের বিষয়টিও লেখক শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ সেদিন দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে এলেও একতাবদ্ধ করতে পারেনি। আজকের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বৈরী অবস্থা ও বিদ্বেষ, তার বীজও রোপিত হয়েছিল একাত্তরে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ছিল নানা মত ও পথ। রাজনীতির এই জটিল ও কুটিল দিকগুলোও লেখকের কুশলী বর্ননায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনা পরম্পরায় এসেছে একাত্তরের নানা কলাকুশলী—কেউ নায়ক, কেউ খলনায়ক। মানুষের জীবন এমনই বিস্ময়কর যে একই ব্যক্তি কোথাও নায়ক, কোথাও খলনায়ক।আহমদ ছফা এই উপন্যাসের মাধ্যমে একাত্তরে বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র অঙ্কন করতে চেয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ যুদ্ধটিকে ত ৎ কালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ইচ্ছা করেই ভারতের মাটিতে নিয়ে এসেছে।এসব রাজনৈতিক বিতর্ক ও তত্ত্বের বাইরে ব্যক্তি মানুষের মনবেদনা ছড়িয়ে আছে পংক্তিতে পংক্তিতে, যা পাঠককে স্পর্শ না করে পারেনা। অলাতচক্র সেই যুদ্ধেরই উপন্যাস। একই সঙ্গে প্রেমেরও। প্রেম ও যুদ্ধ তো জীবনেরই অংশ।