বিদ্রোহী গান

গিরীন চক্রবর্তী ও আলতাফ মাহমুদ
‘বিদ্রোহী’ গানের দুই সুরকার

কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ সন্দেহাতীতভাবে বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ। একই সঙ্গে খ্যাতি ও শ্রেষ্ঠত্বের যূথবদ্ধতা কবিতার ক্ষেত্রে খুব কমই ঘটলেও ‘বিদ্রোহী’ সেই বিরলতম উদাহরণের একটি। নজরুলেরই জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে আমরা এই কবিতার আবৃত্তি শুনেছি। যাঁরা সব্যসাচীর কণ্ঠে কবিতাটি শুনেছেন বা ভবিষ্যতে শুনবেন, তাঁরাই এর যথার্থ তাৎপর্য, মর্মার্থ ও সমগ্রতা উপলব্ধি করতে পারবেন। পরবর্তীকালে আরও অনেকে কবিতাটি আবৃত্তি করলেও সব্যসাচীর কণ্ঠেই যে এটি সেরা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু ষাটের দশকে আমরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে শুনতে পেয়েছিলাম গান হিসেবেও। সে গান পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে মানুষকে। ‘বিদ্রোহী’কে গান হিসেবে আমরা প্রথম শুনেছিলাম খ্যাতিমান গণসংগীতশিল্পী ও সুরকার শেখ লুতফর রহমানের উদাত্ত কণ্ঠে। দেহ-মনের সমস্ত প্রেম ও শক্তি দিয়ে তিনি গাইতেন। সে গানের শব্দ, সুর ও ঝংকারে উদ্দীপ্ত হতাম আমরা।

তখন তো আমরা ছাত্র—উজ্জ্বল ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী। শেখ লুৎফর রহমান ছাড়াও গান হিসেবে ‘বিদ্রোহী’ শোনার সুযোগ আমাদের হয়েছিল অভিনেতা ও গায়ক আরিফুল হকের কণ্ঠে। সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে একবার এই গান তিনি গেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর অবশ্য তাঁর কণ্ঠে গান খুব একটা শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

শেখ লুৎফর রহমান ও আরিফুল হকের গাওয়া গানটির সুর করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম সংগীতগুরু, লোক ও নজরুলসংগীতশিল্পী এবং সুরকার গিরীন চক্রবর্তী। সেটিই অনেক প্রচলিত। তাঁর সুর করা ‘বিদ্রোহী’ অনেকেই গেয়েছেন। গিরীন চক্রবর্তী ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। শৈশবে তিনি শিষ্য হয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর। ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত স্নেহধন্য। নজরুলের প্রায় ৩০টি গান, বিশেষ করে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’, ‘নারী’ ও ‘এই শিকল–পরা ছল্​’ গানের সুর করেছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। ১৯৪৯, মতান্তরে ১৯৫২ সালে তিনি সংক্ষিপ্তাকারে ‘বিদ্রোহী’র সুর করেছিলেন। যা-ই হোক, এটিই সম্ভবত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রথম সুরারোপের উদাহরণ। গিরীন চক্রবর্তী নিজেও গিয়েছিলেন গানটি, এটি এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে নতুনু একটি সুর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের শহীদ গায়ক ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ। মনে পড়ে, ১৯৬৫ সালে নজরুলজন্মবার্ষিকীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন হলে প্রথমবারের মতো বড় আকারে একটি নজরুলসংগীতের অনুষ্ঠান করেছিল ছায়ানট। আলতাফ মাহমুদ ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের পরিচালক।

ওই অনুষ্ঠানের জন্য ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন একটি সুরারোপ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। দেশের সেরা নজরুলসংগীতশিল্পীরা গান গেয়েছিলেন সেখানে। প্রথমে আলতাফ মাহমুদ নিজে একক কণ্ঠে গানটি শুরু করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে একক ও কোরাসে অংশ নিয়েছিলেন জাহিদুর রহিম, অজিত রায়, ফাহমিদা খাতুন, আহসান মোর্শেদ প্রমুখ। কী যে ভালো লেগেছিল গানটি! আলতাফ মাহমুদের ভক্ত ছিলাম বলেই যে এত প্রশংসা করছি, তা কিন্তু নয়। সুর, সংগীত পরিচালনা, পরিবেশনা—সব মিলিয়ে গানটির উপস্থাপনাই ছিল অন্য রকম। পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে ‘বিদ্রোহী’ গানটি গেয়েছেন অজিত রায়।

আলতাফ মাহমুদের পরিচালনা ও কণ্ঠের সেই গান যাঁরাই শুনেছেন, আমার ধারণা, এখনো তাঁদের কানে বাজে সেই সুর, সেই গান, সেই গায়কি। আমার বিবেচনায় গিরীন চক্রবর্তীর চেয়েও আলতাফ মাহমুদের ‘বিদ্রোহী’ গানের সুর অনেক আধুনিক ও জোরালো ছিল।

পরের বছর ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন তিন দিনব্যাপী একটি সম্মেলন করেছিল। শেষ দুই সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথম দিন রবীন্দ্রসংগীত এবং তাসের দেশ-এর নৃত্যনাট্য। আর দ্বিতীয় দিনে ছিল গণসংগীত অনুষ্ঠান। এদিন সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি কণ্ঠও দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। গণসংগীতের অনুষ্ঠানের পরই পরিবেশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ গান, সঙ্গে নৃত্যনাট্য। নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেছিলেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক আলতামাস আহমেদ। সে অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার কারণে মহড়ার সময় বারবার আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ গানটি শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই সুর যেন আমার কানে লেগে আছে, চোখে লেগে আছে নাচের ঝংকার।

স্ত্রী প্রমীলা এবং দুই পুত্র সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধর সঙ্গে নজরুল
ছবি: সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী’র আবেদন এখনো আগের মতোই আছে, সামান্যও কমেনি; কিন্তু একই সঙ্গে দেশ-কালের প্রেক্ষাপটে যে এর প্রাসঙ্গিকতাও কমেনি, এটি আমাদেরই ব্যর্থতা। আজও ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনি’ তোলে, ‘অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভীম রণভূমে রণি’ ওঠে। ফলে নজরুল নিশ্চয়ই শান্ত হননি। শান্ত হননি আলতাফ মাহমুদও।

‘বিদ্রোহী’র এই শতবর্ষে বারবার মনে পড়ছে আলতাফ মাহমুদের সুর করা সেই গানের কথা। এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না গানটি, সিনেমা বা অন্য কোথাও কোথাও খণ্ডিতভাবে ব্যবহৃত হলেও তা কতটা শুদ্ধ হয়েছে—সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের ইচ্ছা, আলতাফ মাহমুদের সুর করা সেই ‘বিদ্রোহী’ গানটি নতুন করে দাঁড় করানো। তাঁর সুরের গানটি আমরা শুনতে চাই।

এ বিষয়ে আমরা আলতাফ মাহমুদের শ্যালক সংগীতশিল্পী লীনু বিল্লাহ ও শ্যালিকা অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা সম্মতি প্রকাশ করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ গানের সেই সুর তাঁদের জানা। আমরা চেষ্টা করব দ্রুত গানটির একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ তৈরি করে তা প্রচারের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, যারা কাজী নজরুল ইসলামের অনুরাগী, নজরুলকে নায়ক বলে মনে করে, আশা করি, আমাদের এই উদ্যোগ তারা সাদরে গ্রহণ করবে।

মতিউর রহমান: প্রথম আলোর সম্পাদক