মিতা হক: ‘যত দূরেই যাই না কেন, আপনার গান প্রতিদিন শুনি’

সদ্য প্রয়াত শিল্পী মিতা হক স্মরণে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

মিতা হকের ছবি অবলম্বনে

মিতা আপা আমার গুরু। ছায়ানটে ভর্তি হই যখন, আমার বয়স তখন ১১ বছর । ‘প্রারম্ভিক ক’-তে ভর্তি হই ১৯৮৭ সালে। ছায়ানটে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি ওয়াহিদ কাকা (ওহিদুল হক) ও সন্‌জীদা (সন্‌জীদা খাতুন) খালাকে। প্রথম বর্ষ থেকেই ক্লাস শুরু হয় ওয়াদুদ কাকার কাছে আর পার্থদার কাছে। উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম শুরু হয় শাকিল ভাই, পুলকদা, সুমনদার কাছে। সেই সঙ্গে সতীন্দ্র হালদার স্যার, বলতেই হয়, ১৩ বছর বয়সে যাঁর ক্লাসে প্রথম উপলব্ধি করতে শুরু করি, স্বরসাধনা কতটা আরাধ্য হতে পারে। সেই সময়ে প্রতিটা রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাস আমাকে ভীষণভাবে গানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ওয়াদুদ কাকার শেখানো ক্লাসগুলোতে গানগুলো আমাকে গান নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর রেজওয়ান আলী লাভলু স্যারের কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শেখা শুরু হয়।

শৈশব থেকেই আমি প্রচুর গানের ক্যাসেট সংগ্রহ শুরু করি। সদ্য প্রয়াত মিতা হক, মিতা আপার একটি ক্যাসেট আমি খুব সম্ভবত ‘গানের ডালি’ থেকে কিনি । ‘সে আসিবে’ শিরোনামে ক্যাসেটটি শুনে আমি মিতা আপার ভক্ত হয়ে যাই। সারা দিনরাত আমি আ্যলবামটি শুনতে শুরু করি।

তাঁর গায়কি, তাঁর স্বরক্ষেপণ, তার উচ্চারণ—প্রতিটি ব্যাপার আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করতে শুরু করে। একে একে তাঁর প্রতিটি ক্যাসেট সংগ্রহ করতে শুরু করি। এর কিছুদিন পরে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অডিটরিয়ামে মিতা আপার প্রথম সিডি বের হয়, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। আমাদের তখন কোনো সিডি প্লেয়ার ছিল না। তবু আমি সিডিটা কিনব বলে টিফিনের টাকা জমিয়ে টাকা গোছাতে শুরু করি। সিডি প্লেয়ার কেনার আগে সিডিটা কিনে ফেলি টিফিনের টাকা জমিয়ে। তার কিছুদিন পরে বাবা (আবুল হাসনাত) ও কাশেম কাকা, মানে আমার ছোট কাকার সঙ্গে স্টেডিয়াম মার্কেট গিয়ে সনির একটি সিডি প্লেয়ার কিনতে পেরে আমার, বাবার আর কাশেম কাকার খুশি দেখে কে! যাহোক, বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই সিডিটা আর ইফফাত খালার বেঙ্গল থেকে বের হওয়া দুটি সিডি আমার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে ওঠে। আমার সদ্য কৈশোরের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকে গানগুলো। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ শুনতে শুনতে একাকী আমি আমাদের পুরোনো ঢাকার বাসার ছাদে কত বসন্তের প্রারম্ভে মন কেমন করা উদাস দুপুর কাটিয়েছি! আবার এই একই গান আমার আমিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে দেহমনের সুদূরপাড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে গানের সুরে মুক্তি খুঁজে পেতে। আমার সদ্য কৈশোরের সেই সময়ে বাবা ও আম্মুকে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হতো তাঁদের সাংবদিকতা, মহিলা পরিষদ বা সামাজিক নানা গুরুদায়িত্ব নিয়ে। সেই একাকী দুপুরগুলোতে মিতা আপা, ইফফাত খালার গানগুলো আমাকে নানাভাবে দিশা দেখিয়েছে; আমার একাকীত্বের সময়গুলো বেদনার্ত না হয়ে কেমন করে তাঁদের মতো গান করতে উজ্জীবিত হওয়া যায়, তা–ই শিখিয়েছে।

আমার বেড়ে ওঠার প্রতিটা রাতে মিতা আপার গানের সঙ্গে বলতে শিখেছি, আশা বিকাশে সব বন্ধন ঘুচে নিত্য অমৃতরস পায় হে।

এই যে গানের মধ্যে বলছে নীতল নীল নীরব মাঝে বাজল গভীর বাণী নিকষেতে উঠল ফুটে সোনার রেখাখানি...নীতল নীল আকাশ তবে কেমন, আর নিক্ষেপকালের মাঝে সোনার রেখাখানিবা কীভাবে ফুটে উঠবে? আমার অবচেতন মন এই কথা আর ভৈরব রাগের সুরের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যেত!

‘বিরহের গভীরে সখী আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’ গানটি মিতা আপার সঙ্গে গাইতে কত কেঁদেছি। কিসেরই পিয়াসে কোথা যে যাবে সে, পথ জানে না। সেই অজানা ব্যথায় কিসের খোঁজে আমার মনকে কোথায় নিয়ে গেছেন মিতা আপা। কত কত গানের কথা বলব যে গানগুলোকে আজও ৩৩ বছর ধরে প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্তে বহন করে চলেছি। মিতা আপার গায়কি গানের বোধ তৈরি করে দিয়েছেন ওয়াহিদুল কাকা, যিনি ইফফাত খালারও শিক্ষক। আমি অবচেতনভাবেই এই গায়কির প্রেমে পড়ে গেছি ছোটবেলা থেকে।

১৯৯৮ সালে আমি মিতা আপার কাছে তাঁর বাসায় গিয়ে শেখা শুরু করি। প্রায় চার বছর তাঁর কাছে কত গান যে তুলেছি! এই কিছুদিন আগেও মিতা আপাকে ফোনে বললাম, ‘আমি যত দূরেই যাই না কেন, আপনার গান প্রতিদিন শুনি।’ উনি বললেন, ‘তুই আসলে তোকে আমার বাসায় নিয়ে আসব। তোর খুব ভালো লাগবে। আমরা সারা দিন রান্নাবান্না করব আর গানবাজনা করব, দেখবি তোর খুব ভালো লাগবে।’ কিন্তু...
আমি কীভাবে এখন মিতা আপাকে বলব যে কত দিন ধরে আমি আপনার গান ‘ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া’ শুনেছি আর রের্কড করছি। আজকে সারা দিন শুনলাম ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালোবাসার ধন’। এই গানেই তো আছে, ‘...তোমার শেষ নাহি তাই শূন্য সে যে শেষ করে দাও আপনাকে যে...ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন, ও মোর ভালোবাসার ধন।’
ভালোবাসি আপনাকে, ‍মিতা আপা!