রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কারবৃত্তান্ত

>
২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নয়জন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। সাহিত্যে এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ। মূলধারার সাহিত্যাঙ্গনে তিনি একেবারেই পরিচিত নন। এমনকি তাঁর লেখাও তেমনভাবে পঠিত হয়নি। ফলে নাম ঘোষণার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁকে নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা–সমালোচনা। একুশে পদকপ্রাপ্ত কোনো কোনো ব্যক্তিকে নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এই প্রেক্ষাপটে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন রাষ্ট্রীয় পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা নিয়ে 

সামন্ত যুগে রাজা-বাদশাহরা সমাজে যাঁরা জ্ঞানচর্চা করতেন, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করতেন, তাঁদের নানাভাবে পুরস্কৃত করতেন, ভূমি দান করতেন, বৃত্তি দিতেন, যাতে তাঁরা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন। আধুনিক রাষ্ট্রও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতিজগতের কীর্তিমানদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পুরস্কৃত করে। প্রতিভাবানদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় ও পুরস্কৃত করায়, তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়ায় ব্যক্তি যতটা উপকৃত হন, সমাজ ও রাষ্ট্র হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। নতুন নতুন প্রতিভা বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কারের গুরুত্ব অসামান্য। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই নানা রকম পদক-পুরস্কার প্রচলিত রয়েছে। ভারতে আছে জ্ঞানপীঠ, আকাদেমি পুরস্কার প্রভৃতি। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকার প্রবর্তন করে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’। তা ছাড়া স্বাধীনতার আগে ছিল সাহিত্যের জন্য আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার প্রভৃতি। আইয়ুব ছিলেন সামরিক শাসক। কিন্তু পদক-পুরস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রাধান্য না দিয়ে দিয়েছেন ব্যক্তির কর্মকে। সে কারণে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছেন দলমত-নির্বিশেষে অনেকেই। পেয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্​, জসীমউদ্​দীন, ফররুখ আহমদ, আবুল ফজল, শওকত ওসমান প্রমুখ। কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পুরস্কার কমিটি গঠন করে দিত, সেই কমিটির সুপারিশমতো মনোনীত হতেন পুরস্কারপ্রাপ্তরা। মৃদু পক্ষপাতিত্ব আদৌ হয়নি, তা নয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন শামসুর রাহমান ও শহীদুল্লা কায়সার।

বাংলাদেশে সরকারি পদক-পুরস্কারের মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু প্রথম থেকেই এ পুরস্কারগুলোর মনোনয়ন নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এসব পুরস্কার প্রদানের যে নীতিমালা আছে, তা থাকা না-থাকা সমান। স্বচ্ছতারও কোনো প্রমাণ নেই। স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক যাঁরা পান, তাঁরা যেন অলৌকিকভাবে পান, কঠিন বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নয়।

প্রথম বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান কবিতায় গোলাম মোস্তফা এবং উপন্যাসে আবুল হাসেম খান, যিনি এখন শুধু নয়, তখনই অপরিচিত ছিলেন। জসীমউদ্​দীন পুরস্কার না পাওয়ায় সেই যে তিনি বাংলা একাডেমির ওপর ক্ষুব্ধ হন, সেই ক্ষোভ ছিল তাঁর আমৃত্যু।

প্রতিটি সরকারি কাজের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা নিয়ম। বাংলাদেশের মতো ‘মরণোত্তর’ পুরস্কারের ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। কোনো কারণে হয়তো উপযুক্ত একজন পুরস্কার পাননি। অথচ তাঁর প্রাপ্য ছিল। এর মধ্যে তিনি মারা গেলেন। যে বছর তিনি মারা গেলেন, সে বছর পুরস্কারের জন্য তাঁকে মনোনীত করা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সিকি শতাব্দী আগে একজন ইহলোক ত্যাগ করেছেন, মানুষ তাঁকে ভুলে গেছে, তাঁর ছেলেমেয়ে বা পরিবারের প্রভাবশালী কারও তদবিরে তাঁকে দেওয়া হলো মরণোত্তর পুরস্কার।

প্রায় প্রতিবছরই এ রকম অনেকে পেয়ে থাকেন। বহু বছর আগে লোকান্তরিত এ রকম কয়েকজনকে একবার স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক দেওয়ায় আমি লিখেছিলাম—সরকার ভুল করছে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, আলাওল, দৌলত কাজী ও রবীন্দ্রনাথকে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার না দিয়ে। যিনি জাতীয় সংগীত লিখেছেন, স্বাধীনতা পুরস্কারটা তাঁর প্রাপ্য। ভাষা আন্দোলনের জন্য একুশে পদক দিতে চাইলে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমকে দিয়ে শুরু করলে ক্ষতি কী? এই কথাগুলো বলতে বাধ্য হচ্ছি বেদনা থেকে। আমাদের রাষ্ট্র যাঁরা চালান, জ্ঞান-বুদ্ধিতে তাঁরা অনেক বড়, কিন্তু তাঁদের সাধারণ আক্কেলের অভাব পীড়াদায়ক।

অতীতে এক জাতীয়তাবাদী দলের সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক দিতে গিয়ে কিস্তিমাত করে। তারা দয়াপরবশ হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পুরস্কারে ভূষিত করে। ওই পুরস্কার ঘোষণায় মনের কষ্টে আমি হতবাক হয়ে যাই। ফাজলামোর একটা সীমা আছে! আমি আমার কলামে লিখেছিলাম, জাতির মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বদ্ধ উন্মাদের মতো যা খুশি তাই করছে, ঈশ্বর এদের ক্ষমা করবেন, কারণ, তারা জানে না তারা কী করছে!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু যাঁরা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তাঁদের আমন্ত্রণ করে এনে সংবর্ধনা, সম্মাননা ও ‘সোনার মেডেল’ দেওয়া হয়। যেখানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি রয়েছে, সেখানে দুর্নীতি ও চুরিচামারি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। দেখা গেল মেডেলের ধাতুটি সোনা নয়, তামা বা ওই-জাতীয় কোনো ধাতু। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়ে গেল, অপরাধী শনাক্ত হলো, কিন্তু তার শাস্তি হলো না। চক্ষুলজ্জাবশত বিশেষ কেউ উচ্চবাচ্যও করলেন না। যাঁরা প্রতিদিন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি উচ্চারণ করেন, তাঁরাও নীরবতা অবলম্বন করলেন। বিদেশি বন্ধুরা জানলেন, বাংলাদেশের মানুষ প্রতারক। পদক ও প্রতারণা পৃথিবীতে এই প্রথম।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুই হাত ভরে শুধু পদক-পুরস্কার দিতেই জানে না, সে প্রদত্ত পুরস্কার ছিনিয়েও নিতে পারে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জিয়াউর রহমানকে দেওয়া মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল বা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে জিয়াউর রহমানের দেওয়া পীর সাহেবের পুরস্কারটি রয়ে গেছে।

বাঙালি পরিমাণকে গুরুত্ব দেয়, অল্পে তার মন ভরে না। যে সমাজে কৃতী মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, সেখানে প্রতিবছর পদক-পুরস্কার প্রাপকের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। একুশে পদক এবার দেওয়া হয়েছে ২১ জনকে। ভেবেছিলাম স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হবে ২৬ জনকে, কিন্তু পেয়েছেন তার চেয়ে কয়েকজন কম। ধারণা করি, পুরস্কারের মর্যাদা না বাড়ুক, টাকার অঙ্ক সরকার যত বাড়াবে, পুরস্কার প্রাপকের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়বে।

সহনশীলতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় এবার স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যন্ত প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। এবার যে ঘটনা ঘটেছে, তা নজরুল, ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুকে পুরস্কার দেওয়ার বিপরীত ব্যাপার। অনেককে কেউ চেনেন না। তাঁদের নাম মানুষ জানে না। সে জন্য তাঁদের কোনো দোষ নেই।

রাষ্ট্রের কর্তাদের কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করতেই পারেন, কিন্তু বিনা জবাবদিহিতে কেউ ছাড় পেতে পারেন না। রাষ্ট্রের কোষাগারের টাকা, যা জনগণের করের টাকা, তা খুশিমতো বিলিবণ্টন করা যায় না। অসংখ্য মানুষকে পুরস্কার প্রদানের এই কাণ্ডকারখানার পর যাঁরা পুরস্কার প্রদান কমিটিতে ছিলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা উচিত, কোন বিবেচনায় তাঁরা পুরস্কারের জন্য তাঁদের মনোনীত করেছেন। তা যদি না-ও করা হয়, অন্তত সরকারের উচিত পুরস্কার কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। মানুষ অন্তত তাঁদের চিনে রাখবে।

কয়েক বছর ধরে স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক নিয়ে যে অপ্রীতিকর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, এসব অনাচারের পেছনে মূল কারণ অন্যখানে। মনোনয়ন ও নির্বাচনের জন্য মানুষ বাছাইয়ে ভুল কি শুধু পদক-পুরস্কারের ক্ষেত্রেই হচ্ছে? তা নয়। সংসদ সদস্য প্রার্থী নির্বাচনে যে দেশে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়, টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা যায়, নিবেদিত নেতা বাদ পড়েন, টাকাওয়ালা ব্যক্তি মনোনীত হন, ভোটার ছাড়া নির্বাচিত হওয়া যায়, সেখানে সবকিছুতেই অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটবে। আমাদের রাষ্ট্রের ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে ভোটারবিহীন নির্বাচন হবে, টেন্ডারে প্রাপ্ত কাজ শেষ না করেই পুরো বিল পাওয়া যাবে, যোগ্যতা ছাড়াই উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যাবে এবং তদবির করে বা দশ-বিশ লাখ টাকা খরচ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারটিও খরিদ করা কোনো ব্যাপার নয়। তাই অবস্থার কারণে এরপর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষ রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কার নিতে চাইবেন না।