শান্তিনিকেতনের সোনালি স্মৃতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের কথা এলে তাঁর ভুবনজয়ী সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি আসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের কথা। সেখানকার স্মৃতিচারণিক বই আগেও লিখেছেন বাংলাদেশের কেউ কেউ; আবদুল আহাদের আসা যাওয়ার পথের ধারে, আশরাফ সিদ্দিকীর রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর শান্তিনিকেতনে তিন মাস বইগুলোর কথা এ প্রসঙ্গে বলা চলে। তবে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, রবীন্দ্র-গবেষক ও সংস্কৃতিসাধক সন্‌জীদা খাতুনের শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০১৯) বইটি একটু ব্যতিক্রমী বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে গত শতকের ষাটের দশকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান তিনি। এরপর উচ্চতর গবেষণার জন্য তিনি সেখানে আরও কয়েক দফা যান। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিও।

বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ‘রবীন্দ্রনাথ চলে যাবার পরে ওখানে কি আর আগের পরিবেশ আছে!’—বলে কন্যাকে নিরস্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কন্যার প্রবল আগ্রহের কাছে তিনিও পরাস্ত হলেন। অবশেষে রবীন্দ্র–প্রয়াণের এক যুগের বেশি সময় পরে
১৯৫৪ সালে বিশ্বভারতীতে ভর্তি, এরপর ছন্দগুরু প্রবোধচন্দ্র সেনের পরামর্শে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিষয়ে এমএ দ্বিতীয় পর্ব গবেষণা শুরু। পড়াশোনার পাশাপাশি রাজা, শেষরক্ষার মতো রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চ-নেপথ্যে ও অভিনয়েও কুশলতা দেখিয়েছেন। পাঠের সাগরে ডুব দিয়েছেন যেমন, তেমনি অনুভব করেছেন শান্তিনিকেতনে বয়ে যাওয়া সুরের হাওয়া। কারণ, ‘আকাশে-বাতাসে গান ছড়িয়ে না গেলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমের আর কী মানে থাকল!’

শান্তিনিকেতনের পথে-প্রান্তরে ঘুরে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথের চরণচিহ্ন কীভাবে ছেয়ে আছে চরাচর:

‘উদয়নবাড়ির পুব দিকে আরও কটা বাড়ি রয়েছে। মাটির বাড়িটির নাম “শ্যামলী”। বাইরের দেয়ালে কিছু ভাস্কর্য ছিল কালো আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া। তার পাশে একটি ছোট একতলা, “পুনশ্চ”। এর পরে ছোট্ট দোতলা “কোনারক”। ওই সব ছোট ছোট ঘরে রবীন্দ্রনাথকে ধরত কেমন করে, অবাক লাগে।’

সন্‌জীদা খাতুন বলেছেন কানাই সামন্ত বা শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা।

রবীন্দ্ররচনার ব্যাখ্যা বা মূল পাণ্ডুলিপি বিষয়ে যাঁদের অতুলনীয় বিশেষজ্ঞতা ছিল। তাঁর আশঙ্কা:

‘এঁদের অবর্তমানে গবেষকেরা সব এখন কার কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছেন কে জানে!’

‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা এবং ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ বিষয়ে পিএইচডি-উত্তর গবেষণা করতে গিয়ে প্রিয় শান্তিনিকেতনকে নতুন করে আবিষ্কার করেন সন্‌জীদা। রবীন্দ্রসান্নিধ্যধন্য গবেষক, শিক্ষক, শিল্পীদের কাছ থেকে দেখার পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের রিকশাচালকের ভেতর সন্ধান পেয়েছেন কবিসত্তার:

‘রিকশাওয়ালা “মহাদেব” ছিল কবি। একটু বড় বড় চুল রাখত। ওর রিকশায় উঠলে ওর কথাবার্তা চলত বেশ গুরুগম্ভীর, কবিতা শুনতে হতো কখনো কখনো।’

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি সন্‌জীদা খাতুন প্রথমা প্রকাশন

২.

শান্তিনিকেতনে অবস্থান করে রবীন্দ্রনাথকে একান্ত নিজের করে, মুক্তদৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছেন তিনি। তাই পুলিনবিহারী সেন, কানাই সামন্ত বা অম্লান দত্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতে পারেন বিসর্জন নাটকে ‘হল কানায় কানায় কানাকানি’ এই অনুপ্রাস তাঁর দুঃসহ লাগে। এরপর মজা করে বলেছেন ‘কেন যে আমাকে রবীন্দ্রনাথের অন্ধভক্ত মনে করে লোকে, কে বলবে!’

বিশ্বভারতী মুদ্রিত রবীন্দ্রনাথের শব্দতত্ত্ব বইয়ে মারাত্মক মুদ্রণপ্রমাদ নিয়ে চিঠি লিখেও ভুলের কোনো সুরাহা পাননি। গীতবিতান-এর নতুন সংস্করণে একটি গানের শব্দপ্রয়োগ নিয়ে সন্দেহ জাগলে রবীন্দ্রনাথের মূল পাণ্ডুলিপি ও গানের ইংরেজি ভাষান্তর মিলিয়ে দেখেছেন, ‘বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড’ মারাত্মক ভুল করেছে এবং চলতে চলতে ভুলই চালু হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ‘স্বরবিতান’-এ ‘মনে যে আশা লয়ে’ গানের সঙ্গে রাগ হিসেবে ‘মেঘাবলী’ মুদ্রিত দেখে সংগীতভবনের ওস্তাদজির শরণাপন্ন হয়ে, রাগরাগিণী নিয়ে গবেষণা করে বুঝলেন ওই গানের রাগটির নাম ‘ইমনি বিলাবল’ বা ‘বেলাবলী’। এবারও ভুলের বিষয়ে সুরাহা না পেয়ে হতাশ তিনি।

শান্তিনিকেতনের নিরাপত্তাব্যবস্থার খুঁটিনাটি আলোচনা শেষে তাঁর বিস্ময়বাক্য, ‘এত কিছুর পরেও তো নোবেল পুরস্কারটি চুরি হয়ে গেল!’

৩.

শান্তিনিকেতনের দিনগুলিতে ফুলের কথা আছে, কাঁটার কথা আছে। তবে সবচেয়ে নিবিড় করে আছে স্বপ্নলোকের সুরের
কথা; বিশ্বলোকে যে মানবিক সুরের বার্তা রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ‘সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে’ গানটির কথার কাব্যসৌন্দর্য গানে যথাযথভাবে প্রকাশ হয়েছে কি না তা যাচাই করতে শান্তিনিকেতনের বন্ধু শান্তার বাড়িতে গিয়ে গাইলেন। শ্রোতা ছিল বন্ধুকন্যা ছোট্ট সোনাইও। সেই মুহূর্তটির স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে তিনি:

‘আমার জিজ্ঞাস্য ছিল গানের বাণীর বেদনা সুরে সেভাবে প্রকাশ পেয়েছে কি না। সে কথা বলিনি ওঁদের। গান শেষ হতেই হু হু করে কান্নায় উচ্চকিত হলো সোনাই! অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শান্তাকে আমার প্রশ্নের বিষয়ে বললাম। স্মিতমুখে শান্তা বলল, “উত্তর তো পেয়ে গেছেন। তাই না?’’’

অক্ষরে অক্ষরে রবীন্দ্রনাথের এই সুরে ভরা শান্তিনিকেতনের ছবিই এঁকেছেন সন্‌জীদা খাতুন, যা সর্বকালে প্রেরণা জোগায়।