হ‌ুমায়ূন আহমেদ এবং আমার বেড়ে ওঠা

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিন আজ। তাঁকে নিয়ে অজস্র লেখক-পাঠকের আছে এন্তার গল্প। এই লেখার পাওয়া যাবে তেমন কিছু গল্প।

হুমায়ূন আহমেদ।
ছবি: প্রথম আলো

দুর্ঘটনার সূত্রপাত আমার বোনের মাধ্যমে। ইমিডিয়েট বড় বোন আমার। বয়সে আমার থেকে ছয় বছরের বড়। সে ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। গান গেয়ে সে একবার একটা বই পুরস্কার পেল। বইয়ের নাম ‘সাজঘর’। লেখক হুমায়ূন আহমেদ। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। বইটা হাতে নিয়ে মাত্র পড়া শুরু করব, বাসা থেকে বলা হলো, এটা অ্যাডাল্ট বই। পড়া যাবে না।

কেউ আমাকে কিছু করতে নিষেধ করলে সে কাজ করার জন্য আমি সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারি। ছোটবেলা থেকেই এ বাজে অভ্যাস আমার আছে। অ্যাডাল্ট বই ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য আমি ‘সাজঘর’ বইটা লুকিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলাম পরদিন। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে পড়ে শেষ করলাম।

এত দিন পর্যন্ত সেবা প্রকাশনীর কিশোর থ্রিলার আর কিশোর ক্ল্যাসিক পর্যন্ত ছিল আমার দৌড়। এরপর হুমায়ূন আহমেদ আমাকে পেয়ে বসল। লুকিয়ে-চুরিয়ে যেখানে যা পেতাম গোগ্রাসে গিলতাম। ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটার কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। মুরং রাজার মেয়ে বালক হুমায়ূনকে বলেছিল, তুমি এত পাগল কেন!

সেই থেকে আজ অবধি মাথার ভেতরে ওই শব্দগুলো ঘোরে। আমিও পাগল হয়ে থাকি। কারণে বা অকারণে। মনে হয়, ও রকম পাগল হতে না পারলে জীবনের মানে কী?

ক্লাস সেভেনে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হই। রেস্ট টাইম বলে সেখানে আমাদের একটা বিষয় ছিল। দুপুরে খাবার পর হালকা ঘুম দিতে হতো ওই সময়ে। জুনিয়রদের জন্য রেস্ট টাইমে ঘুমটা ছিল মাস্ট।

এখন যেমন অবলীলায় ভাতঘুম দিয়ে দিতে পারি, তখন মোটেই এ রকম ছিলাম না আমি। দিনের বেলা ঘুম আসত না কোনোভাবেই। কলেজ মনোগ্রাম আঁকা বেডকাভার মুড়ি দিয়ে ঘুমের ভান করতাম। কাভারের নিচে চুপি চুপি বই পড়তাম। কেউ টের পেত না।

একদিনের ঘটনা বলি। আমি প্রতিদিনের মতো বই পড়ছি। পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই কখন যে কাঁদতে শুরু করেছি আমার মনে নেই। নিঃশব্দে কাঁদছিলাম। কিন্তু শরীর যেহেতু কাঁপছিল, আমার রুম লিডার টের পেয়ে গেলেন যে আমি ঘুমাইনি।

রুম লিডারের নাম শরীফ। আমাদের এক বছরের সিনিয়র। তিনি ভারী গলায় ডাকলেন, আলভী...।
আমি চাদরের নিচে বইটা লুকিয়ে মুখ বের করলাম।
শরীফ ভাই জানতে চাইলেন, ঘুমাও নাই?
আমি দুপাশে মাথা নাড়লাম।
তিনি ভালো করে আমার মুখটা দেখলেন। তারপর বললেন, কাঁদতেছ কেন?

হ‌ুমায়ূন আহমেদ।

আমি চুপ করে রইলাম।
শরীফ ভাই বললেন, বাসা থেকে চিঠি আসছে? কোনো খারাপ খবর?
আমি এবারও কোনো উত্তর দিলাম না।
ভাই বিছানা থেকে উঠে বসলেন। বললেন, কেউ মারা গেছে?
কী বলব আমি? কী বলার আছে? আরও একবার প্রশ্নটাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম।
তিনি বললেন, মা ভালো আছে তোমার?
বললাম, হুম্‌।
ভাইবোন?
হুম্‌।
বাবা কেমন আছে, সে প্রসঙ্গে যাওয়া উচিত ছিল শরীফ ভাইয়ের। তিনি জানতেন, আমার বাবা বেঁচে নেই। তাই সে প্রসঙ্গে না গিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, কাছের কেউ মারা গেছে?
না।
কী হইছে আমাকে বলবা তো! কাঁদতেছ কেন?
টিয়া মারা যাবে।
টিয়া কে?
টিয়ার আরেক নাম হলো নাতাশা। নাতাশাকে বাঁচাতে হলে চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে হবে। অনেক টাকা লাগবে। নাতাশার মাকে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে বিছানায় শুয়ে সেই টাকা জোগাড় করতে হবে।
মানে?
‘এপিটাফ’ বইটা বের করে দেখালাম। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
শরীফ ভাই চুপ করে রইলেন। কোনো বকাঝকা করলেন না। নরম মনের এই অসম্ভব ভালো মানুষটা বছর তিনেক আগে সুইসাইড করেছেন। দূর অস্ট্রেলিয়ায়। একা, একেবারে একা, নিঃসঙ্গ এক মৃত্যু!

হ‌ুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮—১৯ জুলাই, ২০১২)

আমার জীবনের অনেকগুলো বছর আমি হুমায়ূন আহমেদের বই গোগ্রাসে গিলেছি। তিনি যা লিখতেন, সব পড়ার চেষ্টা করতাম। কোনো ঈদসংখ্যায় তাঁর উপন্যাস ছাপা হলে সেই সংখ্যা সংগ্রহ করিনি, এমন হয়নি। ক্যাডেট কলেজে থাকতে বন্ধুদের মধ্যে দুটো দল ছিল। একদল হুমায়ূন আহমেদের সমর্থক। আর একদল অ্যান্টি–হুমায়ূন আহমেদ। যারা অ্যান্টি পার্টি, তাদের প্রধানতম অভিযোগ, হুমায়ূন আহমেদের লেখার মধ্যে কোনো মাল নেই।
মাল কী জিনিস তা আমরা জানতাম না। লেখার মধ্যে মাল কী করে ঢোকায়, সে ব্যাপারেও ধারণা ছিল না কোনো। তবে মাল আছে বা নেই, সে ব্যাপারে রেডিমেড যুক্তি আমাদের কম ছিল না।
বাংলা ক্লাসে আমরা স্যারের পড়া থামিয়ে তুমুল তর্ক জুড়ে দিতাম। কখনো কখনো স্যারও যোগ দিতেন সেই তর্কে। একবারের কথা স্পষ্ট মনে আছে। আমাদের বাংলা পড়াতেন আক্তার হোসেন স্যার। তিনি তর্কের মীমাংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, দ্য থিং ইউ রাইট ইজ নট অ্যাজ ইমপর্টেন্ট অ্যাজ দ্য ওয়ে ইউ রাইট।

অর্থাৎ কী লিখলাম, সেটা একটা ব্যাপার বটে, কীভাবে লিখলাম, সেটাই আসল কথা। স্বাভাবিকভাবেই এই কথার পক্ষে-বিপক্ষে দুটো দল দাঁড়িয়ে গেল। আবার শুরু হলো তর্ক। ক্লাস আর করতে হলো না।

একবার আমাদের এক বন্ধু হুমায়ূন আহমেদের বাসার টেলিফোন নম্বর জোগাড় করে ফেলল। ক্যাডেট কলেজে ফোন করার সুবিধা ছিল না তখন। পুকুরপাড়ের পাশে সেকেন্ড গেটে একটা কার্ড ফোন বুথ ছিল। সেই বুথ সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য নয়। টিচার ও স্টাফরাই সেটা ব্যবহার করেন। তবু অতি সাহসী কিছু ক্যাডেট সেই ফোন বুথ গভীর রাতে ব্যবহার করতে যেত। বাড়িতে তাদের প্রেমিকা আছে। তাদের সঙ্গে কথা না বললেই নয়। প্রেমিকার গলার স্বর শোনার বদলে যে কোনো পানিশমেন্টের জন্য তারা প্রস্তুত।
প্রেম করার ব্যাপারটা তখনো আমার মাথায় ঢোকেনি। তবু আমি ঠিক করলাম, একদিন সেই ফোন বুথে যাব। হুমায়ূন আহমেদের ফোন নম্বর যখন পাওয়াই গেছে, তাঁকে একটা ফোন করতে হবে। তখন ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। একদিন রাতে সিকিউরিটি গার্ডকে ফাঁকি দিয়ে গেলাম সেই ফোন বুথে। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে এক কিশোরীর গলার মিষ্টি আওয়াজ পেলাম, হ্যালো।
আমি চুপ করে রইলাম। ফোন করব এ পর্যন্ত ডিসিশন আমার নেওয়া ছিল। ফোনে কী বলব, তা তো ভাবিনি।
ওপাশ থেকে আবারও বলল, হ্যালো।

নয় নম্বর িবপদসংকেত ছবির শুটিংয়ে হ‌ুমায়ূন আহমেদ।
ছবি: প্রথম আলো

আমি মৃদুস্বরে বললাম, স্লামালাইকুম। আমি হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
তিনি এখন ব্যস্ত। কথা বলতে পারবেন না।
ও আচ্ছা।
আপনি কে?
আমি ওনার একজন ভক্ত।
উনি সাধারণত ফোনে কথা বলেন না।
আমার খুব জরুরি কথা ছিল।
কী কথা? আমাকে বলেন। আমি বাবাকে বলে দেব।
আমি একটু থমকে গেলাম এবার। ‘বাবাকে বলে দেব’—কথাটার অর্থ দাঁড়ায় আমি তাঁর মেয়ের সঙ্গে কথা বলছি। কোন মেয়ে? যে মেয়ে অ্যাকটিং করে? কংকা ভাইয়া? গলার স্বরে তেমনই মনে হলো। আমি তো তার ভক্ত। টিভিতে দেখে তো মনে হয়, বেশ নরম মনের মেয়ে। এই মেয়েকে ভালো করে রিকোয়েস্ট করলে তার বাবাকে ডেকে দেবে না?
ওপাশ থেকে বলল, কই বলেন। কী বলবেন?
আমি বললাম, আমি কি কাল এ সময়ে ফোন করলে তাঁকে পাব?
না। তিনি ফোন ধরেন না, বলে মেয়েটা ফোন রেখে দিল।

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই। গল্পও নেই। আবার গল্প যে নেই, এ কথাও-বা কীভাবে বলি? আমার শৈশব ও কৈশোরের বিষণ্ন দুপুরগুলো যে লোকটা একার হাতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে নিয়ে যদি আমার গল্প না থাকে তো কাকে নিয়ে থাকবে? তিনি কত বড় সাহিত্যিক, সে তুমুল বিতর্কে না গিয়ে শুধু এটুকু বলব, আমার অর্ধেক জীবন তিনি দখল করে ছিলেন। আর কেউ পারেনি।

এ ঘটনার ঠিক দেড় বছর পর হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। ১৯৯৯ সালে এইচএসসি পাস করে আমি ঢাকায় স্থায়ী হই। সামনে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা। বন্ধুবান্ধব সবাই কোচিং-টোচিং করে। আমি সেসব কিছু করি না। খুব বেশি টেনশনও করি না ভর্তি নিয়ে। হলে হবে, না হলে নাই—এই টাইপের একটা মেন্টালিটি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। ঢাকায় তখন প্রচুর হাওয়া–বাতাস। আমি হাওয়া লাগাই গায়ে। হাতে প্রচুর ফাঁকা সময়। খাইদাই ঘুরি, দু-একটা প্রেম করার চেষ্টা করি। সিম্পল লাইফ।

২০০০ সালের ২৬ মার্চ। তারিখটা মনে আছে বিশেষ কারণে। ১৯৯৯ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের জন্য একটা নতুন ভবন তৈরি হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হকও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। তিনি সেই ভবনের নামকরণের জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমামের নামটা প্রস্তাবনা আকারে আনলেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা কিছুতেই এটা হতে দেবে না। তারা তাদের নিজস্ব পেটেন্ট করা পদ্ধতিতে শুরু করল বিশৃঙ্খলা। হুমকি–ধমকি চলতে লাগল।

এই যখন অবস্থা, হুমায়ূন আহমেদ কিছু লাইন লিখলেন। অব্যর্থ কিছু লাইন। সরাসরি বুকের মধ্যে এসে লাগে। শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের (সম্ভবত প্রথম আলো পত্রিকায়) প্রথম পাতায় সেই লেখা ছাপা হলো। তিনি যা লিখেছিলেন, তার সারাংশ করলে দাঁড়ায়, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। এই দিনে তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে অনশন করবেন।
মূল তথ্যের সঙ্গে এই তথ্যও আমি জেনে গেলাম যে অনশন উপলক্ষে আগের রাতে তিনি উপবন এক্সপ্রেসে সিলেট যাবেন।
ছুটলাম উপবন এক্সপ্রেসের টিকিট কাটতে। টিকিট পাওয়া গেল না। ততক্ষণে তির ছুটে গেছে ধনুক থেকে। আমি ঠিক করেছি, যেতেই হবে আমাকে। রাতের বাসে সিলেট গিয়ে পৌঁছলাম। সকাল সকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গিয়ে বসলাম। লোক জমে উঠল। সারা দিন ছিলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি আমাকে দেখেননি বা দেখলেও সেটাকে দেখা বলে না। আমি দেখেছিলাম তাঁকে। মনভরে দেখেছিলাম। সে-ই আমার প্রথম হুমায়ূন–দেখা।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ

দ্বিতীয় দেখা ২০০৯ সালে। তখন আমি নাটক বানানো শুরু করেছি। সেটাই আমার পেশা। বাপ্পী নামে আমার বুয়েটের এক ছোট ভাই ছিল। তাঁকে এখন সবাই একনামে চেনে। পুরো নাম ওয়াহিদ ইবনে রেজা। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে কজন বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে, সে তাদের মধ্যে একজন।

বাপ্পী আর অভিনেতা মাজনুন মিজান একদিন রাতে আমার বাসায় এলেন। তাঁরা হুমায়ূন আহমেদের ‘নীল বোতাম’ গল্পটা নিয়ে একটা নাটক বানাতে চান। আমাকে সেই নাটক ডিরেকশন দেওয়ার প্রস্তাব করা হলো। সানন্দে রাজি হলাম। সেই সূত্রে হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাসায় খুব যাওয়া–আসা হলো কয়েক দিন।

আমার একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো, আমি যে কাউকে পছন্দ করি, এ কথাটা সরাসরি বলতে পারি না। হুমায়ূন আহমেদকে সামনাসামনি কখনো বলা হয়নি, আমি তাঁর কত বড় ভক্ত ছিলাম!

একসময় নাটক বানানো শেষ হলো। পরের বছর বাপ্পী জানাল, সে হুমায়ূন আহমেদের ‘জয়জয়ন্তী’ উপন্যাসটা নিয়ে ধারাবাহিক নাটক বানাতে চায়। নিজে প্রডিউস করবে। আমি দুই মাস সময় নিয়ে ২৬ পর্বের স্ক্রিপ্ট লিখলাম। হুমায়ূন আহমেদ সেই স্ক্রিপ্ট পড়ে গ্রিন সিগন্যাল দিলেন।

এনটিভির অনুষ্ঠানপ্রধান কামাল সাহেব সেই স্ক্রিপ্টের ওপর ওয়ার্ক অর্ডার পাস করলেন। নুহাশ চলচ্চিত্রের প্যাডে হুমায়ূন আহমেদ নাটকটা পরিচালনার লিখিত অনুমতি দিলেন আমাকে। এর মধ্যে তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ল। আরও কিছু আনুষঙ্গিক জটিলতায় সেই স্ক্রিপ্ট শুট করা হলো না আর। সেটা এখনো আমার ল্যাপটপে। নাটকটা আর বানানো হয়নি আমাদের।

আমি বইমেলায় যাই না। গেলেও খুব দ্রুত যে বই কেনার জন্য গিয়েছি, সেটা কিনে কেটে পড়ি। ভিড়ভাট্টা আমার ভালো লাগে না। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ আমার সংগ্রহ করা হয়নি কখনো। তবু আমার কাছে তাঁর একটা সিগনেচার আছে। নুহাশ চলচ্চিত্রের প্যাডে ‘জয়জয়ন্তী’ নাটকের ব্যাপারে তাঁর অনুমতিপত্রের নিচে ছোট্ট করে সই।

এখনো মাঝেমধ্যে আমি পুরোনো ফাইল খুলে সেই কাগজটা বের করি। হলদেটে হয়ে গেছে কাগজ। অনেকটাই মলিন। সেই কাগজে চোখ রেখে মনে মনে বলি, হলো না।

এই ‘হলো না’ আসলে অনেক না হওয়ার সম্মিলিত যোগফল। হয় না, হবে না, সবকিছু একটা জায়গায়, একটা পয়েন্টে এসে থমকে যাবে। মৃত্যু বলে একটা অনিবার্য ব্যাপার পৃথিবীতে আছে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ l ছবি: প্রথম আলো

হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলা আমার জন্য সহজ নয়। একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়নি খুব বেশি, কথাও হয়নি। কী গল্প বলব তাঁর? মানুষ কেন শুনবে আমার গল্প? হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেকের অনেক স্মৃতি আছে। তাঁরা সেই স্মৃতি নিয়ে বই লিখেছেন। বাজারে দেদার চলছে সেসব বই। হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবন, তিনি কী খেতেন, কী পরতেন, কী ভালোবাসতেন, কী পছন্দ করতেন—এগুলো এখন সবাই জানে। সব লেখা হয়ে গেছে।

তাহলে আমি কোন সাহসে এই লেখা লিখতে বসেছি? আমার তো তাঁকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই। গল্পও নেই। আবার গল্প যে নেই, এ কথাও বা কীভাবে বলি? আমার শৈশব ও কৈশোরের বিষণ্ন দুপুরগুলো যে লোকটা একার হাতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে নিয়ে যদি আমার গল্প না থাকে তো কাকে নিয়ে থাকবে?

হুমায়ূন আহমেদ কত বড় সাহিত্যিক, সে তুমুল বিতর্কে না গিয়ে শুধু এটুকু বলব, আমার অর্ধেক জীবন তিনি দখল করে ছিলেন। আর কেউ পারেনি।

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এখন কথা বলতে গেলে ‘পাস্ট টেনস’ ব্যবহার করতে হয়। এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে পারিনি। পারার দরকারও নেই হয়তো।

প্রিয় লেখক,
আপনাকে নিয়ে মনের মধ্যে একটা শূন্যতা থেকে যাবে। আজীবন থাকবে। কোনো স্কেলে সেই শূন্যতা মাপা যাবে না। বিজ্ঞানী ফিহাও সেই স্কেল আবিষ্কার করতে পারবেন না।
অনেকখানি পথ তো হেঁটে ফেললাম জীবনের। ক্লান্ত পা দুটোর অজুহাতে দেখার চোখ তৈরি হলো না। বৃষ্টিকে কি আপনার মতো করে উপভোগ করতে পারলাম?

বৃষ্টি এখনো নামে, প্যাচপেচে কাদার ভয়ে রাস্তায় নামি না। অথচ একসময় আপনার মতো বৃষ্টিবিলাসের কথা ভাবতাম। পকেটের মোবাইল আর মানিব্যাগ পলিথিনে পেঁচিয়ে হুড খোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে কত বছর আগের কথা। মনে হয়, অন্য কারও জীবনের গল্প আমি লিখছি।
বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল দেওয়ার মানুষ আমার আজ নেই। দিই না কাউকে। সে ব্যাপারে আগ্রহও নেই। জোছনার আলো এখন জানালার পর্দার ওপাশে থাকে। ভারী পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকতে পারে না। অনুমতি দিই না আমি। শালবনে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
দিঘির জলে আজ ঝরা পাতা ভাসে। প্রিয় মানুষের ছায়া পড়ে না সেখানে।
কিছু একটা বদলে গেছে। বাজেভাবে বদলেছে। আগের মতো নেই। কিছু ঠিক নেই। কিচ্ছু না।
কারণ, আপনি নেই। কোথাও কেউ নেই।