'বাঁধনহারা'র সুখপাঠ্য অনুবাদ

‘বাঁধনহারা’
‘বাঁধনহারা’

বাঁধনহারা: আনফেটার্ড—কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদ: তানভিরুল হক, আসফা খাতুন, শিরীন হাসানাত ইসলাম, আয়েশা কবীর, জ্যাকি কবির, সায়েদা করিম খান, শাহরুখ রহমান ও নিয়াজ জামান প্রচ্ছদ: শহীদ কাজী নিমফিয়া পাবলিকেশন, ঢাকা

বাংলা সাহিত্যের খুব কম লেখাই ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কেবল বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লেখা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। সেদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলামের পত্র-উপন্যাস বাঁধনহারার অনুবাদ অবশ্যই একটি সুসংবাদ। অনুবাদে উপন্যাসটির নাম দেওয়া হয়েছে আনফেটার্ড। কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম সমধিক পরিচিত হলেও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর প্রবেশ। লিখেছেন গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং নাটকও। যে বইটি নিয়ে এখন আলোচনা করছি, এটি নজরুলের প্রথম দিককার লেখা। বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে আটজনের একটি অধ্যয়ন সভা। অনেক নজরুল বিশেষজ্ঞই নজরুলের বাঁধনহারা উপন্যাসটিকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম পত্র-উপন্যাসের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ‘স্ত্রীর পত্র’ নামে কাঠামোগত দিক দিয়ে একই রকম একটি গল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ১৯১৪ সালে। হয়তো নজরুল এ গল্পটি পড়ে থাকতে পারেন এবং এ রকম ধাঁচে লেখায় অনুপ্রাণিতও হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের প্রধান চরিত্র বাঙালি গৃহবধূ মৃণাল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। নজরুলের উপন্যাসেও এ রকম চরিত্র আছে, যদিও তারা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি রুখে দাঁড়ায় না। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের কড়া সমালোচক তারা। মাহবুবা ও সাহসিকা চরিত্র দুটি এর প্রধান উদাহরণ। মাহবুবা বাঙালি সমাজে বিরাজমান পুরুষতন্ত্রের বলি এবং কড়া সমালোচক। উনিশ শতকে বাংলায় নারীমুক্তির আন্দোলন শুরু হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের নেতৃত্বে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আবির্ভাব ঘটে বেগম রোকেয়া ও সরলা দেবীর মতো নারীদের। এসব অবশ্যই বাংলা সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছিল, যার চিহ্ন আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের লেখায়।

বাঁধনহারা উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য হলো, এতে চরিত্রগুলো নিজেরা নিজেদের উন্মোচিত করে। নিজেদের সম্পর্কে এবং নিজেদের ধ্যানধারণা ও মতাদর্শ নিয়ে তারা চিঠির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে। উপন্যাসটিতে মোট চরিত্রের সংখ্যা দশটি—আয়েশা, খুকি, মা/রোকেয়া, মাহবুবা, মনুয়ার, নুরুল হুদা, রবিউল, রাবেয়া, সাহসিকা ও সোফিয়া। রাবেয়া ও রবিউল দম্পতির শিশুকন্যা খুকি বা আনারকলি ছাড়া প্রত্যেকেই চিঠিতে নিজেদের তুলে ধরে।

এই উপন্যাসের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। উপন্যাসটির মাধ্যমে বাঙালিদের প্রথম আধুনিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায়। একজন বাঙালি সৈনিক কীভাবে এই নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে বাঁধনহারায়। নজরুল নিজে যোগদান করেছিলেন বাঙালি পল্টনে এবং দুই বছর সামরিক জীবন কাটিয়ে ১৯২০ সালে ফিরে এসেছিলেন দেশে। তাঁর এই অভিজ্ঞতাই এই উপন্যাসের অন্যতম পুঁজি।

তবে বাঁধনহারা শুধু সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতাপূর্ণ একটি আখ্যান নয়; এটি আসলে একটি প্রেমের উপন্যাস। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মাহবুবা নুরুল হুদাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। কিন্তু নুরুল হুদা কোনো বাঁধনে জড়াতে চায় না। অবশেষে মাহবুবার বিয়ে হয়ে যায় চল্লিশোর্ধ্ব এক জমিদারের সঙ্গে। কিছুদিন পরই বিধবা হয়ে যায় মাহবুবা। পরে নুরুল হুদাকে সে লেখে যে, সে মক্কা ও মদিনায় তীর্থ ভ্রমণে যাবে এবং নুরুল হুদার কর্মস্থল বাগদাদেও যেতে পারে। নুরুল হুদা মাহবুবাকে নিষেধ করে না। তাদের দুজনের দেখা হওয়ার সম্ভাবনার মাধ্যমে শেষ হয় উপন্যাসটি।

কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম উপন্যাস বাঁধনহারার অনুবাদকর্মটি সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, অনুবাদটি মূল উপন্যাস থেকে অনেক সহজে পড়া যায়। এ ছাড়া বইয়ের শুরুতে নিয়াজ জামানের ভূমিকা এবং বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে অনুবাদকদের নোট উপন্যাসটির পাঠ অনেক সহজ করে দিয়েছে। এ রকম একটি মহৎ কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করায় অনুবাদকেরা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।