'কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে' মোদি-শাহ জুটির ভয়


প্রথম তির ছোড়া হয়ে গেছে
ভারতে জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র তিন-চার মাস বাকি। বলা হচ্ছে, এটা হবে আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ’। যদিও কুরুক্ষেত্রের মতোই সিংহাসন নিয়েই যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু ২০১৯-এর নির্বাচনী লড়াইয়ের ‘পাণ্ডব’ ও ‘কৌরব’ কারা, সেটা বিতর্কিত। তবে নিশ্চিতভাবে যুদ্ধের একদিকে আছে আরএসএস-বিজেপি পরিবারের নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি।

মোদির সঙ্গে অমিত শাহর বন্ধুত্ব নিয়ে সত্য-মিথ্যার মিশেলে অনেক গল্প আছে। তিন দশক হলো এই বন্ধুত্বের। আরএসএসের পূর্ণকালীন ক্যাডার হিসেবে যখন থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু, তখন থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব। অমিত শাহর চেয়ে মোদি ১৩ বছরের বড়। কিন্তু বন্ধুত্ব বয়স মানে না। কেবল একটি তথ্য দিয়েও এই এই বন্ধুত্বের গভীরতা বোঝানো সম্ভব। গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফায় মোদির অধীনে একপর্যায়ে অমিত শাহ ১৭টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এটা সবাই জানে, ২০১৪ সালে বিজেপির বিজয়ে মোদির পক্ষে ‘মাস্টার প্ল্যানার’ ছিলেন অমিত শাহ। ২০১৯ সালেও তা–ই আছেন তিনি।

গত নির্বাচনে কংগ্রেসকে লোকসভায় যে লজ্জাকর ৪৪ আসনে নামিয়ে আনা গিয়েছিল,Ñসেই অবিশ্বাস্য ঘটনার নায়ক নিঃসন্দেহে মোদির পক্ষে অমিত শাহ। কেবল জাতীয় নির্বাচনই নয়, ২০১৪ সালের পর থেকে অনেকগুলো রাজ্য নির্বাচনে কংগ্রেসকে নিঃস্ব করেছে এই জুটি। অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে হটিয়ে অমিত শাহ যে বিজেপির সভাপতি হলেন, সেও মোদিও জিদের কারণেই। আজকের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ড বলা হয় তাঁর ৫৩ বছর বয়সী এই বন্ধুকে।

কিন্তু এই জুটির বিরোধী পক্ষও এখন আগের চেয়ে অনেক শক্ত-পোক্ত-সচেতন। এ সপ্তাহে উত্তর প্রদেশে যাদবদের সঙ্গে দলিত মায়াবতীর নির্বাচনী ঐক্যের ঘোষণার মধ্য দিয়ে আসন্ন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রথম তির ইতিমধ্যে বর্ষিত হয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, মায়াবতী ও অখিলেশ যাদবের ঐক্য মোদি-শাহ জুটির জন্য দীর্ঘ এক দুঃস্বপ্নের সূচনা মাত্র।

উত্তর প্রদেশে মায়াবতী-অখিলেশ-অজিত সিংয়ের ঐক্য
ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হলো উত্তর প্রদেশ। যারা ভারতে সরকার গড়তে চায়, তাদের উত্তর প্রদেশে বিজয়ী হতে হয়। সংগত কারণেই ১২ জানুয়ারি প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে স্থানীয় বহুজন সমাজবাদী দলের (বিএসপি) মায়াবতী এবং সমাজবাদী দলের (এসপি) অখিলেশ যাদবের নির্বাচনী ‘মেগাবন্ধন’-এর ঘোষণামাত্রই ভারতজুড়ে তা প্রধান সংবাদ হয়ে উঠেছে। এই জোট গঠনের ঘোষণায় কার্যত ভারতজুড়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারও শুরু হয়ে গেল। এসপি-বিএসপি জানাচ্ছে, তারা উভয়ে রাজ্যে ৩৮টি করে আসনে বিজেপিকে মোকাবিলা করবে। বাকি দুটি আসনে (আমেথি ও রায়বেরেলি) তারা সম্ভবত কোনো প্রার্থী দেবে না, যেহেতু সেখানে লড়বেন তাদের দূরবর্তী মিত্র গান্ধী পরিবারের সদস্যরা। ‘রাষ্ট্রীয় লোকদল’ নামের স্থানীয় আরেকটি ছোট রাজনৈতিক শক্তি এই এসপি-বিএসপি জোটে শরিক হতে পারে বলেও মনে করা হয়। লোকদলের শক্তিভিত মূলত রাজ্যটির ‘জাট’ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ভোটে যাদের রয়েছে ৫ ভাগের মতো হিস্যা। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং ছিলেন এই সমাজের। তাঁর ছেলে অজিত সিং এখন লোকদলের নেতা। লোকদল জোটে এলে তাদের দুই–তিনটি আসন ছেড়ে দেওয়া হবে বলে ধারণা করা যায়।

ভারতীয় লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের ভোট হবে। এর মধ্যে ৮০টি আসন হলো উত্তর প্রদেশে। সংখ্যার হিসাবে উত্তর প্রদেশের গুরুত্ব পুরো নির্বাচনের ১৫ শতাংশ হলেও বাস্তবে তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আরও অনেক বেশি। এসপি–বিএসপি বহুকালের প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছে। বলা যায়, ২৫ বছর পারস্পরিক বিরোধিতা শেষে এবার তারা ঐক্যবদ্ধ হলো। স্পষ্টত, আবারও প্রমাণিত হলো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই। যা স্থায়ী,Ñতা হলো ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ; তথা নির্বাচনী স্বার্থ।

বিজেপি ৪০টি আসন হারাতে পারে উত্তর প্রদেশে
উত্তর প্রদেশে এসপি-বিএসপি উভয় দল মূলত দলিত, মুসলমান ও যাদবদের মধ্যে (২০+২০+১০=৫০ শতাংশ) প্রভাবশালী। তাদের ঐক্যবদ্ধতা বিজেপির জন্য নিঃসন্দেহে একটি খারাপ বার্তা; যদিও রাজ্যটিতে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। ৪০৩ আসনের বিধানসভায় বিজেপির রয়েছে প্রায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব—৩২৫টি আসন।

হিসাবে দেখা যায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই রাজ্যে এসপি–বিএসপি-লোকদলের ভোট হিস্যা যৌথভাবে প্রায় ৪৩ শতাংশ। বিজেপির ভোট হিস্যাও তদ্রূপ। কংগ্রেস গত নির্বাচনে এই রাজ্যে ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আসন্ন নির্বাচনে তারা যদি প্রয়োজনমতো বিভিন্ন আসনে এসপি-বিএসপি জোটকে ভোট ছাড় দেয়, তাহলে এই রাজ্যে বিজেপি প্রায় ৪০টি আসন হারাতে পারে, যা হবে গতবারের চেয়ে প্রায় ৩১টি কম।

উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের গড় ভোটব্যাংক ১০ শতাংশ মাত্র। সব মিলে তারা ৮০টির মধ্যে ১০ থেকে ১২ আসনে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। শহরাঞ্চলে তাদের কিছু ভোটব্যাংক রয়েছে উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে। বিএসপি ও এসপি জোট গড়ার ঘোষণা দেওয়া মাত্রই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কংগ্রেস বলেছে, তারা একাই সেখানে জাতীয় নির্বাচনে লড়বে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ত্রিমুখী। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কংগ্রেসের সঙ্গে এসপি-বিএসপি জোটের গোপন বোঝাপড়া থাকবে নির্বাচনী লড়াইয়ে। যেখানে এসপি-বিএসপি শক্তিশালী, সেখানে কংগ্রেস তাদের সমর্থন দেবে। আর যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে জোট তাদের পক্ষে থাকবে। এভাবেই এই ত্রয়ীশক্তি একক প্রতিপক্ষ মোদি-শাহ জুটিকে দিল্লির মসনদ থেকে সরাতে চায়।

উত্তর প্রদেশে দলিতদের পক্ষপাত মায়াবতীর দিকে, আর মুসলমানদের পক্ষপাত কংগ্রেস ও এসপির প্রতি। কংগ্রেস-এসপি-বিএসপি-লোকদল চাইছে যেকোনো উপায়ে মুসলমান-দলিত ভোটব্যাংককে বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। অন্যদিকে, এই রাজ্যের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা (সংখ্যায় প্রায় ২০ শতাংশ) প্রধানত বিজেপির সমর্থক হলেও কিছু উচ্চবর্ণ কংগ্রেসকেও ভোট দিয়ে থাকে। এসপি-বিএসপি চাইছে, কংগ্রেস পৃথকভাবে নির্বাচন করে উচ্চবর্ণের ভোট বিভক্ত করুক। কেবল এভাবেই এই রাজ্যে বিজেপিকে পরাস্ত করা সম্ভব।

এসপি-বিএসপি জানে, তাদের সমর্থকেরা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে ভোট দিলেও কংগ্রেস–সমর্থক উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কোন অবস্থাতে দলিত-মুসলমানসমর্থিত এসপি-বিএসপিকে ভোট দেবে না। ফলে এসপি-বিএসপির লক্ষ্য মূলত কিছু কিছু প্রয়োজনীয় আসনে কংগ্রেস–সমর্থক মুসলমানদের ভোট। এই লক্ষ্যেই বিএসপির সঙ্গে প্রকাশ্য জোট ছাড়াও এসপি কংগ্রেসের সঙ্গেও একটা গোপন বোঝাপড়ায় আছে। আমেথি ও রায়বেরেলিতে কংগ্রেস ডাইনেস্টির জন্য ছাড় দেওয়াও গোপন সমঝোতারই ইঙ্গিত দেয়। সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বরাবরের মতোই আমেথি থেকে নির্বাচন করবেন রাহুল গান্ধী; রায়বেরেলি থেকে করবেন সোনিয়া গান্ধী। তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই এসপি-বিএসপি জোট সেখানে হয়তো প্রার্থী দেবে না।

নির্বাচনটি ‘মোদি বনাম রাহুল’-এর যুদ্ধ আকারে হচ্ছে না
ভারতের রাজনীতিতে আরএসএস-বিজেপি পরিবার সব সময় নতুন নতুন রাজনৈতিক জুটির জন্ম দেয়। অতীতে বাজপেয়ি-আদভানি জুটির কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। বাজপেয়ি ছিলেন প্রশাসক ধাঁচের ব্যক্তি, তাঁর চাণক্য ছিলেন আদভানি। তবে কংগ্রেসের বিপরীতে তাঁদের সফলতা মোদি-শাহ জুটির মতো নয় মোটেই। আদভানি এখনো জীবিত, তবে বিজেপির নতুন চাণক্য অমিত শাহ তাঁর চেয়েও অনেক শক্তিশালী জীবনবৃত্তান্তের অধিকারী। কিন্তু এসপি-বিএসপি জোট তাঁকেও খানিক বেসামাল করেছে। সেটা বোঝা গেল এই জোটের ঘোষণার পর দিল্লিতে প্রথম রাজনৈতিক সভায় তাঁর বক্তৃতায় অন্তত ১৫ মিনিট জুড়ে ছিল মায়াবতী ও অখিলেশের নিন্দায়।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি উত্তর প্রদেশ থেকে বন্ধুদলগুলোসহ ৮০ আসনের মধ্যে ৭৩টি (৭১+২) পেয়েছিল। এক রাজ্য থেকে এত অধিক আসনই মোদিকে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করে। ফলে, উত্তর প্রদেশে আসনক্ষয়ের শঙ্কা মাত্রই বিজেপির জন্য ক্ষমতাচ্যুতির ভয়।

অন্যদিকে, এই নির্বাচন এসপি-বিএসপির জন্যও টিকে থাকার লড়াই। মায়াবতীর বিএসপি গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ থেকে একটি আসনও পায়নি। অথচ এই রাজ্যই তাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ফলে, রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মায়াবতীর দলকে এবার বিজেপির কাছ থেকে কিছু আসন ছিনিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। অখিলেশ যাদবেরও একই লক্ষ্য। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতোই ২০১৭ সালের স্থানীয় নির্বাচনেও দলটি খারাপ করেছে। জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে হলে এসপিকেও আগের চেয়ে অনেক ভালো ফল করতে হবে। তবে মোদি-শাহ জুটির কাছ থেকে আসন কেড়ে নেওয়া সহজ নয়, সেটা মায়াবতী ও অখিলেশ দুজনেই জানেন।

উত্তর প্রদেশের নতুন রাজনৈতিক অঙ্ক এও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে জাতীয় পর্যায়ে মোদি-শাহ জুটির বিরুদ্ধে কোনো মহাজোট গড়ে উঠছে না। নির্বাচনটি মোদি বনাম রাহুলের যুদ্ধ আকারেও হচ্ছে না। বিজেপিবিরোধী শিবির মনে করছে, যুদ্ধটি ‘বিজেপি বনাম অন্য সকলে’ হলে মোদি-শাহ জুটি এটাকে ‘হিন্দুত্ব বনাম অন্য সকলের’ যুদ্ধে রূপ দেবে, যা ভোটের কৌশল হিসেবে ক্ষতিকর। তার চেয়ে এটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতোই থাকুক এবং কৌরব বনাম পাণ্ডব তথা ন্যায় বনাম অন্যায়ের যুদ্ধ হয়ে উঠুক। স্বভাবত এই যুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে অনেক আঞ্চলিক চরিত্রের জন্মদান। সে রকম ক্ষেত্রে যদি বিজেপি গতবারের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০টি আসন কম পায়, তাহলে নির্বাচনের পরই কেবল শুরু হতে পারে জোটগুলোর প্রকৃত ভাঙাগড়া। যে রকম সম্ভাবনাই উঁকি দিচ্ছে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলোয়।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস গবেষক