রক্ত যখন জেলি হয়ে যায়...

ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মা জাহেদা আমিন চৌধুরী। গত বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে কর্মচারী সমিতির ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে। ছবি: প্রথম আলো
ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মা জাহেদা আমিন চৌধুরী। গত বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে কর্মচারী সমিতির ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে। ছবি: প্রথম আলো

নীল রঙের শাড়ি পরা এক মা, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন। চারপাশে চকের আঁকিবুঁকি, কারণ সেখানে যে খেলা হচ্ছিল। সেই মা অসহায়ের মতো মাটিতে পড়ে থাকলেও কেউ তাঁকে তুলতে আসেননি। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, নিরাপদ (!) দূরত্বে থাকা আশপাশের মানুষদের। মায়ের মাথা খানিকটা নুয়ে ছিল, মাটিতে গুঁজে ছিল, অপমানে নাকি বিবমিষায়—কে জানে!

তিনি ২০১৬ সালে খুন হওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী। গত বুধবার ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় উপস্থিত ছিলেন জাহেদা। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর তাঁর ছেলের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। প্রথম ময়নাতদন্তে বলা হয়েছিল, দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন। আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর জাহেদা আমিন বাদী হয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর টিপু, সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন।

দিয়াজ ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার পর দুটি বসন্ত চলে গেছে, আরেকটি বসন্ত দ্বারপ্রান্তে। প্রায় দুই বছর ধরে এ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগপত্র এখনো দেয়নি তদন্ত সংস্থা। নানা হাত ঘুরে তদন্তের ভার এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাঁধে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। অথচ গত বুধবার চোখের সামনে জাহেদা দেখতে পান ছেলে হত্যা মামলার প্রধান আসামি মোহাম্মদ আলমগীর টিপুকে। তাও স্যুভেনিরে, সঙ্গে ছিল টিপুর শুভেচ্ছাবাণী! সেটি পড়তেও হয়েছে ছেলে হারানোর ব্যথায় জর্জর মা -কে। যাঁকে ছেলের হত্যার কারণ হিসেবে জানেন, নিজের সতীর্থদের তরফে তাঁর এমন নিষ্কলুষ (!) প্রচার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না জাহেদা। তাই স্যুভেনির নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মাঠে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে উত্তর জানতে। তা না পেয়ে জাহেদার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুখ গোঁজা ছাড়া আর কি কোনো গত্যন্তর ছিল?

দিয়াজ ইরফান চৌধুরী
দিয়াজ ইরফান চৌধুরী

আচ্ছা, আপনি হলে কী করতেন? ভাবুন একবার, আপনার সন্তানের ঝুলন্ত লাশ নামানো হচ্ছে। শুনেই নিশ্চয়ই গা শিউরে উঠছে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, জাহেদা আমিন চৌধুরী কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ছেলে হত্যা মামলার আসামিদের পুলিশ খুঁজে না পেলেও স্যুভেনিরে ঠিকই দেখা মেলে! ছেলের হত্যার বিচার দাবিতে এর আগে অনেক দিন প্রতিবাদ করেছিলেন জাহেদা, অনশনে ছিলেন। তাতে কারোরই কিছু যায়-আসেনি, যেমনটা হয়েছে মাঠে লুটিয়ে পড়ার বেলাতেও। এখন মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন দিয়াজের মা, কথা বলছেন না তিনি। কথা বলার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটিই কি আর অবশিষ্ট থাকে? এমন বিচারহীনতার শিকার হলে আপনি-আমি কী করতাম?

এ দেশে জাহেদার মতো ‘অসহায় ন্যায়বিচারপ্রার্থী অভিভাবক’ আরও আছেন। দিয়াজের মা হয়তো এখনো বিচারের আশায় আছেন। কিন্তু দিনমজুর রুস্তম আলী ও রাবেয়া খাতুনের নির্বাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাঁদের মেধাবী ছেলে খুন হয়েছে, কিন্তু তাঁকে কেউ খুন করেনি ! স্বয়ং আদালতেই সেই রায় এসেছে। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে এক দিন পর মারা যান আবু বকর ছিদ্দিক। হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। কারণ কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি আদালতে! এমনকি মামলার রায় হয়ে যাওয়ার পর মাসের পর মাস কেটে গেলেও, জানতেও পারেননি ছিদ্দিকের মা-বাবা। পরে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে এই খবর আলোর মুখ দেখে।

পড়াশোনার সুবাদে ২০১০ সালের ওই সময়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলাম। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে ওই ঘটনায় হওয়া বিক্ষোভে আদ্যন্ত অংশও নিয়েছিলাম। চোখের সামনেই দেখেছি, হাজারো শিক্ষার্থীর মিছিল কীভাবে গুটিকয়েকের মিছিলে পরিণত হয়! কারণ সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদ জানানোর তুলনায় হলের সিট বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ যে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর আবু বকরের রক্তে ভেজা খাতা আমাদের রক্তে আগুন ধরায় না। সেদিন অনেক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ ভুলে ডিমেনশিয়ার রোগী হয়েছিলেন। অনেক বলেকয়েও তাঁদের প্রতিবাদে শামিল করা যায়নি। তাই ছেলে হত্যার ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় থাকা রাবেয়া খাতুনকে অস্ফুটে বলতে হয়, ‘আমার নির্দোষ বাবারে যারা হত্যা করল, তাগো বিচার হইলো না! এইডা ক্যামন দেশ!’

রক্ত প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল উর্দু ভাষার বিখ্যাত গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর কথা। দেশভাগের সময় সংঘটিত দাঙ্গাকে উপজীব্য করে অনেক গল্প লিখেছেন তিনি। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মান্টোর গল্পগ্রন্থ ‘সিয়াহ হাশিয়ে’। তাতে রক্ত ও জেলি নিয়ে একটি ছোট্ট গল্প আছে। গল্পের শুরুতেই ঠেলাগাড়িতে বরফ নিয়ে যাওয়া এক ফেরিওয়ালা খুন হন। অনেকক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকার পর লাশ নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু রাস্তায় থেকে গিয়েছিল বরফমেশা লাল টকটকে রক্ত। ঘণ্টাখানেক পর সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া এক শিশু সেই থকথকে রক্তকে জেলি ভেবে ভুল করেছিল। সময়ের ফেরে আবু বকর ছিদ্দিকের খাতায় লেপ্টে থাকা রক্তও এখন আমাদের কাছে জেলি হয়ে গেছে, তা দেখে আর চিন্তার উদ্রেক হয় না!

আবু বকর ছিদ্দিক। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো
আবু বকর ছিদ্দিক। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো

হত্যার ন্যায়বিচার না হওয়া অবশ্য এই জনপদে নতুন কিছু নয়। শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ দেশের রাস্তায় পুলিশের গুলি খেয়ে মরে পড়েছিলেন দীপালি সাহা-জয়নালসহ কমপক্ষে ১০ জন। সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি, হয়তো কখনোই হবে না। কারণ রাষ্ট্র যে তাঁদের মরে যাওয়ার খবরই স্বীকার করে না। ওই দ্রোহের আগুন বয়ে চলা কেউ কেউ আজও ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে দেখে থাকেন, আর বাকিরা মেতে ওঠেন ভ্যালেন্টাইনকে গোলাপ দেওয়ার আনন্দে। খুব সচেতনভাবেই ফুল আর উপহারের স্রোতে পেছনে ফেলে দেওয়া হয় ওই দিনের সেই বিদ্রোহীদের, যাঁরা কিনা বিতর্কিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

স্মৃতিভ্রংশ রোগটা এখন সবাইকেই পেয়ে বসেছে। আমরা হয়তো ‘অপ্রিয়’ সব বিষয় ভুলেই যেতে চাই। হয়তো ন্যায়বিচার না পাওয়াটা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। বলাই তো হয়, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’। চেষ্টায় কী না হয়! তাই জাহেদা আমিন মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাঁর পাশে ছবিতেও কাউকে পাওয়া যায় না। তাঁর অপমানে ও অসহায়ের মতো বিচার চাওয়াতে কেউ কি ভ্রুক্ষেপ করেন? করলে হয়তো বছরের পর বছর ধরে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়াটা ঝুলে থাকত না।

সামনেই পয়লা ফাল্গুন, আবার আসছে বসন্ত। প্রকৃতির নিয়মে গাছে নতুন পাতা গজাবে, ফুল ফুটবে। ফাগুনের আগুনে পুড়ে, তার পরদিন ভ্যালেন্টাইনস ডেতে কেউ কেউ হয়তো দ্বিগুণ হবেন। কিন্তু দিয়াজ-ছিদ্দিক-জয়নাল-দীপালিরা আর ফিরে আসবেন না। তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। কারণ, আমাদের রক্ত এখন জেলির মতো জমাট বেঁধে গেছে। প্রতিবাদের উত্তাপে আমাদের রক্ত আর টগবগ করে ফোটে না। কারণ দ্রোহ যে হারিয়ে গেছে আপসের দোকানে।

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]