নদী রক্ষা করতে না পারলে মানুষও টিকবে না

ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার
ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার
>

ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এর আগে তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। কমিশনের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি একে একে দেশের সব কটি গুরুত্বপূর্ণ নদী পরিদর্শন করছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে দেশের নদী দখলদারদের প্রথম একটি সামগ্রিক তালিকা তৈরি হয়েছে। ওই তালিকা ধরে নদীগুলো দখলমুক্ত করার কাজ চলছে। দেশের নদ-নদীগুলোর সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে আরেকটি প্রতিবেদন তৈরির কাজও চলছে। দেশের নদ-নদী রক্ষায় সরকারের চিন্তা-পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়ে তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো: বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের সৃষ্টি ও বসতি গড়ে ওঠার সঙ্গে নদীর সম্পর্ক গভীর। এই নদীগুলো কেমন আছে?

মুজিবর রহমান: বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শুধু সৃষ্টি আর বসতির সঙ্গেই যে নদীর সম্পর্ক আছে, তা নয়। নদী এখানকার অধিবাসীদের জীবন ও জীবিকার মূল উৎস। এই অঞ্চলের সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। এই যে আমাদের রাজধানী ঢাকার জন্ম হলো, শুধু এর চারপাশে ছয়টি নদ–নদী আছে বলে। ফলে এখানকার অধিবাসীদের জীবনে নদীর ভূমিকা অনেকটা মায়ের মতো। তবে নদীগুলো যে ভালো নেই, তা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। উচ্চ আদালত থেকে আমাদের নদ–নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

উচ্চ আদালতের ওই রায়কে যদি আমরা অন্যভাবে পাঠ করি, যেমন ধরেন নদী তো আসলে সব জীবনের উৎস। এই যে উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ, প্রকৃতি, বায়ুমণ্ডল, অক্সিজেন—এই সবকিছু থাকত না, যদি না নদী থাকত। আমরা বলি, পৃথিবীর এক ভাগ স্থল আর তিন ভাগ পানি। আমাদের মানুষের শরীরের ৬২ শতাংশ কিন্তু পানি। ফলে সামগ্রিকভাবে নদী হচ্ছে জীবনের প্রধান আধার। সেই নদীকে যদি আমরা রক্ষা না করতে পারি, তাহলে মানুষও টিকবে না।

প্রথম আলো: আমরা কি আমাদের নদীগুলো রক্ষা করতে পারছি? নদী তো বসতি, শিল্পকারখানা ও সমতল ভূমিতে পরিণত হচ্ছে।

মুজিবর রহমান: দেশের নদ-নদীগুলোর সামগ্রিক চিত্র ধরে যদি বলেন, আমি বলব হ্যাঁ। দেশের নদীগুলো ভালো নেই। দখল-দূষণ চলছে। নদীগুলো একে একে মারা যাচ্ছে, কিন্তু গত কয়েক বছরে এর কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। সরকার নদী রক্ষায় কমিশন গঠন করেছে, জাতীয় পানি আইন করেছে। নদীগুলো কে রক্ষা করবে, তা নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। সেটি এখন এককভাবে নদী রক্ষা কমিশনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা নদীর দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের উচ্ছেদ শুরু করেছি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীবিষয়ক তৎপরতা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন কার্যালয় দখলদারদের দ্রুত তালিকা করেছে। তাদের উচ্ছেদে সহযোগিতা করছে। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলো নদীতীরবর্তী এলাকাগুলো রক্ষায় হাঁটার পথ ও নানা অবকাঠামো গড়ে তুলছে। এগুলোকে আমি ইতিবাচক পদক্ষেপ মনে করি।

প্রথম আলো: ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে তো ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হলো? তিস্তা নিয়ে চুক্তি তো হলো না?

মুজিবর রহমান: আন্তসীমান্ত নদীগুলো মূলত যৌথ নদী কমিশনের বিষয়। আমরা আমাদের সীমানার মধ্যে নদীর যে অংশটুকু আছে, তার দেখভাল করি। যে ৪৭টি নদী নিয়ে আমরা সমীক্ষা করছি, তার মধ্যে ফেনী নদীও আছে। এই নদীতে দখল–দূষণের সমস্যা নেই। তবে সেখানে প্রচুর ডুবোচর আছে, অনেক জায়গায় ভাঙনও চলছে। আমরা দুই দেশ মিলে এর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা ও চুক্তি করেছি। কিন্তু নদীটিকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায়, সেই উদ্যোগও লাগবে। তিস্তার ক্ষেত্রেও একই কথা আমি বলব। ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি হলে আমরা শুষ্ক মৌসুমে পানি পাব, এতে আমাদের উত্তরাঞ্চলের কৃষির জন্য ভালো হবে। কিন্তু বাংলাদেশ অংশে তিস্তার অনেক স্থানে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। আমরা যদি ফেনী ও তিস্তা নদীর গভীরতা বাড়ানো ও খননের ব্যাপারে উদ্যোগ নিই, তাহলে এখন যে পরিমাণে পানি আছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ পানি আমরা সেখানে রাখতে পারব। এতে দুই দেশেরই পানি সমস্যার সমাধান হবে।

প্রথম আলো: আমাদের নদীগুলোর ওপরে তো একসময় সাধারণ মানুষের অধিকার ছিল। নদীপথে যাতায়াত, নদীতে মাছ ধরা, সেচ দেওয়া, নদীর তীরে বসতি করার কাজটি দেশের সাধারণ মানুষের সুযোগ হিসেবে ধরা হতো। এখন নদী কী সাধারণের অধিকারে আছে?

মুজিবর রহমান: এসব সুবিধার কারণেই তো আমাদের এখানে সব বসতি নদীর তীরে গড়ে ওঠা? পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই তা–ই। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান হয় কৃষিকাজ করে ও মাছ চাষ করে। এটিও নদী ও জলাশয়নির্ভর। পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে সহজ ও কম ব্যয়বহুল পথ হচ্ছে নৌপথ। ফলে নদী রক্ষা পেলে সবচেয়ে বেশি উপকার হবে সাধারণ মানুষের। এখন নদীগুলো যেভাবে আছে, তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষ। আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার দখলদারের তালিকা করেছি। এর মধ্যে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আছে। শিল্পকারখানা, বহুতল ভবন তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ক্যানসার হাসপাতালের নামও দখলকারীদের তালিকায়।

প্রথম আলো: নদীগুলো দখল ও দূষণের কারণে দেশের কৃষি খাতের সমস্যা হচ্ছে? দূষিত পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় খাদ্যের মধ্যে দূষিত পদার্থ ঢুকে পড়ছে।

মুজিবর রহমান: আমাদের দেশের কৃষিকাজ এখনো নদী ও নালার পানিনির্ভর। আমাদের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। নদীগুলোতে আট মাস পূর্ণ পানি থাকে। আর দখল-দূষণের বিষয়গুলো বেশি হচ্ছে শহরের আশপাশের নদীগুলোতে। সেখানে খুব বেশি কৃষিকাজ হয় না। তবে মানুষের খাওয়ার পানির উৎস হচ্ছে নদী। নদীর পানি দূষিত হলে তা পরিশোধন করাও ব্যয়বহুল হয়ে যায়। আর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো মূলত জোয়ার-ভাটানির্ভর। সেখানে দূষণের খুব বেশি প্রভাব নেই। তবে সেখানকার নদীগুলোতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো এখন খনন শুরু হয়েছে। খননের ক্ষেত্রেও আমরা একটি নীতিমালা তৈরি করেছি। আগে খনন করে পলিগুলো নদীর পাড়ে ফেলে রাখা হতো। ফলে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি এসে তা আবার নদীতে পড়ত। এই অবস্থা যাতে না হয়, সে জন্য আমরা খননের পলি দূরে কোথাও সমতল ভূমিতে রাখার নিয়ম করে দিয়েছি।

প্রথম আলো: এসব পদক্ষেপে নদী কতটুকু রক্ষা পাবে বলে মনে করেন। বড় দখলদারেরা তো এখনো আছে। তারা তো অনেক প্রভাবশালী।

মুজিবর রহমান: দখলদারেরা যত প্রভাবশালী হোক না কেন, আমরা তাদের উচ্ছেদ করবই। ইতিমধ্যে আমরা তুরাগতীরের অনেক প্রভাবশালীকে উচ্ছেদ করেছি। যেকোনো স্থাপনা ভাঙতে অর্থের প্রয়োজন হয়। সরকার ওই অর্থের জোগান দিচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। উচ্চ আদালত থেকে নদী রক্ষায় দুটি যুগান্তকারী রায় দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নদীগুলো রক্ষায় আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র নদী রক্ষায় তৎপর হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন আরও কঠোর হচ্ছে। এর একটি খসড়াও চূড়ান্ত হয়েছে। খুব শিগগির তা সংসদে অনুমোদন পাবে বলে আমরা আশা করি। নদীগুলোর দখলের চিত্রকে আমরা ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে তুলে আনছি। আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা নদীর সব দখলদারকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। দখলদার যত শক্তিশালী হোক না কেন, আমরা তাদের ছাড় দেব না।

প্রথম আলো: নদীর সীমানা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনেক অমীমাংসিত বিষয় আছে। দেশে অনেক ভূমি জরিপ হয়েছে। একেক জরিপে নদীর সীমানা একেকভাবে নির্দেশ করা আছে। নদীর জমি জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় ভূমি অফিসগুলো ব্যক্তির নামে নদীর জমি ইজারা দিয়ে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।

মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, এটা ঠিক। নদীর সীমানা নিয়ে নানা মত আছে। কিন্তু আমরা ১৯৪০ সালের সিএস জরিপ অনুসারে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে থাকি। প্রতিটি নদীর প্লাবন ভূমি ও জোয়ার-ভাটার এলাকা আছে। ফলে শীতকালে নদীর সীমানা আর গ্রীষ্মকালের সীমানার মধ্যে খালি চোখে পার্থক্য দেখা দিতে পারে। এ কারণে আমরা সরকারের মহাকাশবিষয়ক গবেষণা সংস্থা স্পারসোকে সঙ্গে নিয়ে দেশের সব নদীর সীমানা নির্ধারণ করেছি। গত ১০০ বছরে নদীর সীমানার কতটুকু বদল হলো। কারা কীভাবে দখল করল, সেই চিত্র ওই প্রতিবেদনে উঠে আসবে। ফলে দখলকারীদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।

আর জেলা প্রশাসকেরা ইতিমধ্যে নদী রক্ষায় যথেষ্ট সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ঢাকার চারপাশের নদ–নদীগুলো ছাড়াও আমরা যশোরে ভৈরব নদ, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নদ–নদী দখলমুক্ত করা শুরু করেছি। সেখানে অনেক প্রভাবশালীর বাধা এসেছে, কিন্তু আমরা তা মোকাবিলা করে নদীর জমি নদীকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। আর উচ্চ আদালত থেকে নদী দখলদারদের নির্বাচনে দাঁড়ানো অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমরা চিঠি দিয়েছি, তারা যাতে কোনো দখলদারকে ঋণ না দেয়। সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করার সময় এখন থেকে নদী কমিশনের অনাপত্তিপত্র লাগবে। আমরা প্রতিটি প্রকল্পের প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখব যে সেখানে কোনো নদীর জমি পড়েছে কি না। তারপর অনুমোদন দেব। ফলে সামগ্রিকভাবে নদী দখলদারদের জন্য কঠিন সময় আসছে। তবে আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে।

প্রথম আলো: নদীগুলো দখলমুক্ত করার পর তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। দখলদারেরা আবার ফিরে আসে। এর সমাধান কী?

মুজিবর রহমান: আমরা নদীগুলো দখলমুক্ত করে সেখানে সীমানা নির্ধারণী অবকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। নদীর মূল সীমানার পর হাঁটার পথ নির্মাণ করে দিচ্ছি ও গাছ লাগিয়ে দিচ্ছি। এতে ভবিষ্যতে কারও পক্ষে ওই স্থানগুলো আবার দখল করা সম্ভব হবে না। তবে নদীগুলোর দুই পাশে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া সম্ভব হবে না। কেননা, এতে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, আমাদের এখানে নদীগুলোর গতিপথ নানা সময়ে পরিবর্তন হয়। এ ছাড়া দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেললে ভূগর্ভস্থ পানির পূর্ণ ভরাটে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে আমরা সবকিছু বিবেচনা করেই নদী রক্ষার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।

প্রথম আলো: দীর্ঘ মেয়াদে নদীগুলো রক্ষায় আপনাদের পরিকল্পনা কী?

মুজিবর রহমান: সরকার দেশের নদীগুলোর জন্য ১০০ বছরের একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে। এর আওতায় আমরা গঙ্গা ব্যারাজ, প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষায় আলাদা পরিকল্পনা করা হয়েছে। সর্বোপরি দেশের নদ-নদী রক্ষায় একটি ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যম তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ধারা আমরা ধরে রাখার চেষ্টা করব। আশা করি, নদীগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মুজিবর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।