ইন্টারনেট মৌলিক মানবাধিকারেরই অংশ

ইন্টারনেট আবিষ্কারের ২৫ বছর চলছে। এই ২৫ বছরে প্রায় চার শ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এর আগের যেকোনো প্রযুক্তির চেয়ে এটি দ্রুত মানুষ গ্রহণ করেছে এবং এর অগ্রগামিতা বাড়ছেই। বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি উৎপাদন শুরু করার ২৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেই ১ শতাংশের কম মানুষ একটি গাড়ির মালিক হতে পেরেছিল। মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করার ১৪০ বছর পর পৃথিবীর অর্ধেকের কম মানুষের কাছে তা পৌঁছেছিল। কিন্তু ইন্টারনেট তার গতিতেই মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

নতুন আবিষ্কৃত যেকোনো জিনিসকেই প্রথমে বিলাসসামগ্রী হিসেবে মনে করা হয়। ধীরে ধীরে সেটি প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস হয়ে ওঠে। তার ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়তে থাকে। চলমান করোনা মহামারির কারণে আমাদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ, দূরশিক্ষণ, টেলিমেডিসিন, ব্যাংকিং, সাংবাদিকতা ও নানা ধরনের সামাজিক সেবা দেওয়া–নেওয়ার বিষয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। মহামারির কারণে আমাদের অনেককেই অনিচ্ছায় হলেও প্রযুক্তির সহায়তায় কাজ করতে হচ্ছে। এতে একসময় যা আমাদের কাছে নিতান্ত দুর্বোধ্য ছিল, তা ধীরে ধীরে এখন সহজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। আমাদের অনেকেই এখন বুঝতে শুরু করেছি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের অবরুদ্ধ হয়ে থাকা এই জীবনে আরও বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। 

ভেবে দেখুন বিশ্বের বাকি অর্ধেক মানুষের নাগালের মধ্যে ইন্টারনেট নেই এবং ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে থাকা এই বিপুলসংখ্যক মানুষের একটি বড় অংশ করোনা মোকাবিলা করছে। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর ৮০ শতাংশ মানুষ অনলাইন দুনিয়ার আলো থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন। যারা ইন্টারনেট সুবিধার মধ্যে আছে, তারা অনলাইন শিক্ষা পাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। কেনাকাটা করতে পারছে। পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ রাখতে পারছে। বিশ্বের হালনাগাদ খবর পাচ্ছে। অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বের নাগরিক সুবিধা তারা ভোগ করতে পারছে। আর অন্যদিকে যারা ইন্টারনেটের আওতার বাইরে, তাদের জীবনযাপন ইন্টারনেট সুবিধাপ্রাপ্তদের জীবনযাপনের চেয়ে বহু গুণ পিছিয়ে। তার মানে অনলাইন সুবিধা থাকা বা না থাকার মধ্য দিয়ে গোটা মানবজাতির মধ্যে একধরনের বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। যারা ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে তারা যত দ্রুত বিশ্বকে বুঝতে পারছে, যারা ইন্টারনেট পাচ্ছে না তারা সে তুলনায় অন্ধ অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। ইন্টারনেট সুবিধা যেভাবে সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, তেমনিভাবে এটি বৈষম্যের কারণও হয়ে উঠছে। এ কারণে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সবার জন্য তুলনামূলক সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হলে মৌলিক অধিকারের মধ্যে ইন্টারনেটকেও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার হয়ে পড়েছে। যেকোনো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও উন্নয়নের রাস্তায় তুলে আনতে হলে সেই জনগোষ্ঠীর জন্য ইন্টারনেট–সেবা সহজলভ্য করতেই হবে।

মানবাধিকার, বৈশ্বিক পরিবেশ, বৈশ্বিক শান্তি, সংঘাত নিরসন—এ ধরনের ইস্যুতে বৃহত্তর জনসংযোগ দরকার। এর প্রধান হাতিয়ার ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের কোনো সীমান্ত নেই এবং এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেয়ে বেসরকারি খাতই বেশি ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে ইন্টারনেটের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা অবাধই রয়েছে। ইন্টারনেট যাতে আরও সহজলভ্য হতে পারে, সে জন্য বৈশ্বিক উদ্যোগ নিতে হবে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব একটি রোডম্যাপ ফর ডিজিটাল কো-অপারেশন প্রকাশ করেছেন। সেই রূপরেখায় ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য ইন্টারনেট–সেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ইন্টারনেট–সেবাপ্রাপ্তিকে মানবাধিকার হিসেবে ধরে নিয়ে এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ডিজিটাল নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথাও ওই রূপরেখায় বলা হয়েছে।

গত সপ্তাহে ওই রোডম্যাপ উন্মোচনের সময় ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) আবিষ্কারক স্যার টিম বার নার্স লি বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতকে এক হয়ে ইন্টারনেট মাধ্যমটিকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রাইভেসি পলিসি অনুসরণ করে ভুল তথ্যপ্রবাহ ঠেকাতে হবে। ইন্টারনেটের জগৎকে প্রথমত সবার জগৎ এবং এরপরই সবার জন্য নিরাপদ জগৎ হিসেবে গড়তে হবে। 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ফেবরিজিও হোসশিল্ড জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল