বঞ্চিত আনন্দময় শিক্ষা ও শৈশব

চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে লেখা চিঠি। তাদের স্কুলে পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছুটির পর বাধ্যতামূলক কোচিং কিংবা অতিরিক্ত ক্লাস করতেই হয়। সে নিজে এতে আগ্রহী নয়। সে নিজের মতো করেই প্রস্তুতি নিতে চায় এবং বিকেলটা নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু যেহেতু তার স্কুল তাকে বাধ্য করবে আগামী বছর, তাই সে আমাদের কাছে অনুরোধ করেছে এই বাধ্যতামূলক কোচিং বন্ধে যেন আমরা কোনো উদ্যোগ নিই।
আগে কিছু স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে সব শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে, তারা তাদের জীবনের সুন্দর সময়গুলো মুখস্থ করার পেছনে ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে।
কেবল কি শিক্ষার্থী? এক অনুষ্ঠানে দেখা এক চিকিৎসকের সঙ্গে। জানলাম, গত কয়েক মাসে কোনো আন্তর্জাতিক সেমিনার, গুরুত্বপূর্ণ সভা, এমনকি অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানেও তিনি যোগ দিতে পারেননি। কেন? ‘আমার ছেলেটি এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেবে। এই ছোট্ট শিশুটিকে একটি পাবলিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। তাই আর অন্য কিছু করা হচ্ছে না।’
এই এখন বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্র। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির তথাকথিত মেধা যাচাইয়ের কবলে পড়ে শিক্ষার্থীদের শৈশব যেমন শেষ, তেমনি মায়েদেরও জীবন বরবাদ।
শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষাগুলোর মূল লক্ষ্যই হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ ক্ষমতা যাচাই করা। ‘মিনি কী করে’—এই প্রশ্নের উত্তরে এক শিক্ষার্থী লিখেছে: মিনি মুখে করে বাবার জুতা ড্রয়িং রুম থেকে বারান্দায় নিয়ে যায়। এই উত্তরে শিক্ষার্থীর পর্যবেক্ষণ এবং তা প্রকাশের চমৎকার নিদর্শন পাওয়া গেলেও শিক্ষক তার খাতায় শূন্য দিয়ে লিখে দিয়েছেন: মিনি রান্নাঘরে মাছের কড়াইয়ে মুখ দিয়ে মাছ চুরি করে। বেচারা শিক্ষার্থী তাদের বাড়ির বিড়ালটিকে কখনো এই কাজটি করতে দেখেনি, যা দেখেছে তা লিখেছে কিন্তু তাতে তাকে ভর্ৎসনাই করা হলো। ঠিক এভাবে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বারোটা বাজাই। সমকোণী ত্রিভুজ-সংক্রান্ত পিথাগোরাসের বিখ্যাত জ্যামিতিক উপপাদ্যটি প্রায় শ দুয়েক পদ্ধতিতে প্রমাণ করা যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমাদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য ইউক্লিডের পদ্ধতিতেই প্রমাণ করতে হয়।’ বলাবাহুল্য ইউক্লিডের প্রমাণটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি জটিল মনে হয়।
অথচ সামান্য চেষ্টা করলেই এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। বেশ কদিন আগে ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞান ক্যাম্প। সারা দেশের নির্বাচিত জনা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী সেখানে ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
‘বাচ্চারা পড়তে চায় না। তাদের ধরে বেঁধে পড়ার টেবিলে নিতে হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে হয় টিভি বা কম্পিউটারের সামনে তাদের পাওয়া যায়। অথচ এখানে তারা নিজেরাই হাজির হয়ে যাচ্ছে ক্লাসে! অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে কী জানি সব কাজ করছে। অথচ ঠিক ভোর সাড়ে ছয়টায় উঠে হাজির হয়ে যাচ্ছে পতাকার সামনে। বাসায় কত কষ্ট করে না তাদের ঘুম থেকে তুলতে হয়!’ ঠিক এভাবে ক্যাম্পে দিনাজপুরের এক মা তাঁর অভিজ্ঞতা বললেন। তাঁর অবাক হওয়ার কারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ওই ক্যাম্পটা তো আসলে পড়ালেখারই। কিন্তু তারা কেউ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে না।
গণিত ক্যাম্প শুরু করার সময় এটা আমরা জানতাম। আর বিজ্ঞান ক্যাম্পে তো বাড়তি মজা হলো প্রকৃতির সঙ্গে থাকা। নো ইন্টারনেট, নো ফেসবুক এবং নো টেলিভিশন। কিন্তু কী আশ্চর্য, আনন্দের কোনো কমতি নেই। বিষয়গুলো কিন্তু সহজ নয়, পর্যায় সারণি, জীবকোষ, বিজ্ঞানভিত্তিক পোস্টার বানানো, মাঠে মাঠে ঘুরে গাছের তালিকা তৈরি করা কিংবা দূর মহাকাশের খোঁজ নেওয়া।
পুরো চারটা দিন তাদের কেটেছে আনন্দের সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা করে। সে কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ দেশে কিছু লোক শিক্ষাকে বানিয়ে ফেলেছে নিরানন্দ, সৃজনশীল মুখস্থ পদ্ধতি। ‘নিজের ভাষায় লেখো’—এমন প্রশ্নের উত্তর পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়। শিক্ষার্থী সেটা মুখস্থ করে উগের দিয়ে আসে পরীক্ষার খাতায়। বেচারা কখনো সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখে না, সেটা ঘড়ির কাঁটার দিকে না উল্টা দিকে ঘোরে, গোধূলিবেলায় মেঘের ওপর মেঘ করে কি না, গুঁড়ির কাঁঠাল বেশি মিষ্টি নাকি কাণ্ডের, পিঁপড়া কি সাঁতার কাটতে পারে? সে এসব প্রশ্ন করলে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, এসব কি তোমার পরীক্ষায় আসবে?
আমাদের স্কুলগুলো পরীক্ষা আর জিপিএ–৫–এর পেছনে দৌড়ানোর জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। কারণ, তাদের নিজেদের মূল্যায়নও সরকার ওই জিপিএ–৫ দিয়েই করে। সরকার কিংবা স্কুলের কথা শুনলে মনে হয় জিপিএ–৫–ই জীবনের সব। আইনস্টাইন যদি না বুঝে মুখস্থ করতেন, তাহলে কি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হতো?
সে জন্যই দরকার পড়ালেখার মধ্যে আনন্দ খোঁজা, শিক্ষার্থীকে তার ছোঁয়া দেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের স্কুলগুলো এই কাজটা করে না। স্কুলগুলো আনন্দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ দিতে পারত, যদি তাদের ওপর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী কিংবা জেএসসির মতো অহেতুক পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া না হতো। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আনন্দের শৈশবও নষ্ট হতো না।
স্কুলগুলো আনন্দের আয়োজন করে না বলে আমাদের এই কাজগুলো করতে হয়। আমাদের স্বপ্নগুলো বড়, কিন্তু সামর্থ্য তো কম। তাই আমরা আশায় থাকি একদিন আমাদের স্কুলগুলোও হয়ে উঠবে আনন্দময়। স্কুলে যেতে না পারলে বাচ্চারা কান্নাকাটি করবে আর তাদের হাতে তৈরি হবে এক আশ্চর্য পৃথিবী!
মুনির হাসান: যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক, প্রথম আলো। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।