আত্মহনন নয়, বেঁচে থাকাটাই জীবন

চিন্তা করুন তো, কাজ করতে গিয়ে ছুরির ধারে আপনার আঙুল কেটে গেল, কেমন লাগবে আপনার? আপনি হয়তো রেগে গিয়ে আমাকে বলতে পারেন, কেমন লাগবে মানে! আঙুল কেটে রক্ত বের হচ্ছে। অবশ্যই যন্ত্রণা হবে, কষ্ট হবে। সত্যিই তো, কষ্ট হবে। আমার কেবল জানতে ইচ্ছা হয়, চট্টগ্রামের যে ছেলেটা তার পুলিশ কর্মকর্তা বাবার নামে ইস্যু করা পিস্তল দিয়ে নিজের ডান বুকে গুলি করে মারা গেল, ওর কি কষ্ট হয়নি? কিংবা মুঠোফোনে গেমস খেলতে না দেওয়ায় যে মেয়েটা ফ্যানের সঙ্গে গলার ওড়না পেঁচিয়ে মারা গেল? গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার সময় ওর নিশ্চয়ই আঙুল কেটে যাওয়ার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ব্যথা করেছিল।

ঠাকুরগাঁওয়ে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা দিতে বিলম্ব হওয়ায় অভিমানে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে যে স্কুলছাত্রী, কিংবা ফেসবুকে আপত্তিকর ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ও লজ্জায় বিষপানে আত্মহত্যা করে মাদারীপুরের শিবচরের যে স্কুলছাত্রী, ওরা কী করে সেই যন্ত্রণা সহ্য করল? কেনই-বা এই রকম ধ্বংসাত্মক মনোভাব হলো ওদের। মনের ভেতর কতটা, কী, কেমন কষ্ট হলে একজন মানুষ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে? শুনতে খুব কষ্ট হলেও মায়া লাগলেও এটা সত্যি যে আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যার প্রবণতা একধরনের মানসিক রোগ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের ৯৫ ভাগই কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভোগেন। মানসিক রোগ মূলত হয় মস্তিষ্কে রাসায়নিক পদার্থের তারতম্যের কারণে। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ অনেকাংশেই সেরে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মানসিক রোগের সঠিক চিকিৎসা করা গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার ৬০। পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বাংলাদেশি। এ দেশে প্রতিবছর লাখে ১২৮ দশমিক শূন্য ৮ জন আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন আত্মহত্যা করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেনটিং সুইসাইড: আ সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’-এ বলা হয়, প্রতিবছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। এ গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়, ২০২০ সালে এ সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছাবে। তাদের এই আশঙ্কা যে মিথ্যা নয়, তা সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে বোঝা যায়।

তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এ প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ উদ্বেগজনক। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। (সূত্র: ১৩ মার্চ ২০২০, প্রথম আলো)। আর মহামারির এই সময়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে আত্মহত্যা। এক বছরের ব্যবধানে আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়াটা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়।

এই মহামারি করোনায় মানুষ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে, অতিমাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছে। নানা রোগে মারা গেলেও মানুষ মনে করছে করোনায় মৃত্যু হয়েছে। মনের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। জীবনের অবমূল্যায়ন, চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়া, সন্তান স্কুলে না যাওয়ার কারণে মানুষ হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, মানুষ বুদ্ধি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

দেখা গেছে, শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নন, অল্প বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। আত্মহত্যার দুটি ধরন—পরিকল্পিতভাবে ও আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহত্যা। বাংলাদেশে অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর আত্মহত্যার ঘটনা আবেগতাড়িত। হতাশা, প্রেমে ব্যর্থ, পরীক্ষার ফল খারাপ, মা-বাবার সঙ্গে ঝগড়াসহ ছোটখাটো বিষয়েই আবেগতাড়িত হয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেন। নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এর পেছনে রয়েছে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, নির্যাতন, ইভ টিজিং, যৌতুক, সম্ভ্রমহানি, অবমাননা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেল অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

২০২০-এ শুরু হওয়া মহামারির এই সময়ে আত্মহত্যার সংখ্যা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দেশে চলমান মহামারির মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন বলে তথ্য দিয়েছেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী (সূত্র: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বিডিনিউজ২৪ ডটকম)। এই মহামারি করোনায় মানুষ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে, অতিমাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছে। নানা রোগে মারা গেলেও মানুষ মনে করছে করোনায় মৃত্যু হয়েছে। মনের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। জীবনের অবমূল্যায়ন, চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়া, সন্তান স্কুলে না যাওয়ার কারণে মানুষ হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, মানুষ বুদ্ধি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিষণ্নতার চরম পরিণতি হচ্ছে আত্মহত্যা। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতাও কমে আসবে। সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, পরকীয়া, যৌতুক—এসব কারণে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। অনেকে পরিকল্পনা করেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

মানসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও মানসিক বেদনা এবং অর্থনৈতিক দৈন্য বেড়ে গেলে চরম হতাশা কাজ করে। এতে তাঁরা সংবেদনশীল হয়ে পড়ছেন। মূলত প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতে না পারাই মানুষকে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। একজন মানুষের জীবনে একের পর এক এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাঁকে চরম মাত্রায় হতাশ করে তোলে। হতাশাই নিজের মধ্যে নেতিবাচক ধারণাগুলো তৈরি করে। একপর্যায়ে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তখনই মানুষ আত্মহত্যা করে। সাম্প্রতিক সময়ে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে মানুষ ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়াও আত্মহত্যার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। করোনার এই সময়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শিশুরা বেশি সময় ব্যয় করছে।

এ কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে তাদের চোখ, মাথা ও কানের মতো পঞ্চেন্দ্রিয়ের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়ছে। নিজেরা যখন অসংবেদনশীল, সেই সময় নিজেদের কোনো ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার মতো প্রত্যাখ্যান তারা মেনে নিতে পারে না। একপর্যায়ে খুব সামান্য বকাঝকা, জোরে কথা বলা বা যেকোনো বায়নার প্রত্যাখ্যানে তারা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে এমনটাই দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে না। যে ঝুঁকিগুলো এখন পর্যন্ত গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যত বেশি সংখ্যায় ঝুঁকিগুলো থাকবে, আত্মহত্যার ঝুঁকি তত বেশি।

আরও মনে রাখতে হবে, কেউ হঠাৎ আত্মহত্যা করে না। মানুষের শৈশবের প্রতিকূল বা বিমুখ অভিজ্ঞতা, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যেমন হঠাৎ রেগে যাওয়া বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি না জানা, কোপিং করার ক্ষমতা না থাকা, মানসিক রোগ থাকা—এই পাঁচ ফ্যাক্টরের সঙ্গে যখন ওপরের ঝুঁকিগুলো এবং ট্রিগার ফ্যাক্টর যুক্ত হয়, তখন মানুষ আত্মহত্যা করে।

আমাদের পরিচিত-প্রিয়জনদের অনেকেই মনের রোগে ভুগছেন। একজন পরিচিত হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। পরিবারের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে, সবার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে, একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

যে সময়টাতে শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা উচিত, সেই বয়সের একটি শিশু আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অভিভাবক হিসেবে আমরাও কি এই পরিস্থিতির জন্য কিছুটা দায়ী নই? আমাদের যে প্রিয় মানুষটি আমাদের ছেড়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তার জন্য আহাজারি করার সময় আমরা কিন্তু বলি, আহা রে, ও সব সময় বলত, ওকে কেউ বোঝে না, একবার যদি একটু বলত যে ওর মনে কী ছিল। কিন্তু সত্যিই কি সে চলে যাওয়ার আগে আমাদের কোনো সংকেত দেয়নি? আমরা বুঝেছিলাম? ১৮-১৯ বছরের একজন ছেলে বা মেয়ে যখন বলেন, আমার কিছু ভালো লাগছে না, আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ আমাকে বোঝে না; অধিকাংশ অভিভাবকই তখন বলি, বেশি পেকে গেছ, না? এটা বয়সের দোষ, এসব ঢং করা বন্ধ করো। কে জানে, হয়তো সত্যি তাঁদের মনে কোনো যন্ত্রণা আছে, বয়সের যে পরিবর্তন, সেটাই তো বড় একটা মানসিক যন্ত্রণা। তার ওপর আমাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা তো আছেই।

প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘কাজের মাধ্যমে আশা জাগাও’। প্রতিপাদ্যটা দেখলেই বোঝা যায়, আমরা একটু সচেতন হলেই আমাদের আশপাশের পরিচিত মানুষ বেঁচে যেতে পারে। আমাদের করণীয় আছে, আমাদের দায়িত্ব আছে। আমরা কী করতে পারি? আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের একটু চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে আমাদের আশপাশের প্রিয় মানুষগুলোর আচরণ। প্রত্যেক আত্মহত্যাকারীই মৃত্যুর আগে কিন্তু একজন মানসিক রোগী। যার অর্থ হচ্ছে, আমরা একটু সচেতন হলেই এ মানুষগুলোর লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে পারব এবং প্রয়োজনে আমরা তাদের প্রতি সহায়তার, ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে তাকে সুস্থ করার কাজটি করতে পারব।

আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির লক্ষণ
আত্মহত্যার প্রবণতা যাঁদের মধ্যে থাকে, তাঁদের মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। তাঁদের আচরণে পরিবর্তন আসে। যেমন হঠাৎ তাঁরা একা থাকতে পছন্দ করেন, প্রায়ই তাঁরা মৃত্যু বা আত্মহত্যার কথা বলে থাকেন, অনেকেই অতিরিক্ত ঘুমান বা কেউ কেউ হয়তো ঘুমের স্বল্পতায় ভোগেন। অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, নিজেকে আঘাত করে ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা যায়। এ লক্ষণগুলো কারও মধ্যে দেখা গেলেই আমাদের সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত। তাঁদের তখন মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

আমাদের করণীয়
আমাদের আচরণেও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন কোনো রকম বাছবিচার করার মানসিকতা বাদ দিয়েই আমাদের উচিত সেই মানুষটাকে সময় দেওয়া। নিজস্ব অভিমত চাপিয়ে না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শোনা। যে মানুষটি মানসিক চাপ বোধ করছেন,তাঁর প্রতি যে আপনার ভালোবাসা আছে, তিনি যে আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তাঁকে বুঝতে দেওয়া উচিত। মানুষটার প্রতি আমাদের ভালোবাসা, যত্ন বোঝাতে হবে। সহানুভূতি, ভালোবাসা, যত্ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে আচরণ করতে হবে। অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় দিন পার করা মানুষটি যেন তাঁর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারেন, তার চেষ্টা করতে হবে। তাঁর মনোযোগ সৃষ্টিশীল কাজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। তাঁকে খেলাধুলা, সৃজনশীল কাজের প্রতি মনোযোগী করে তুলতে হবে। তাঁকে একা রাখা যাবে না। তাঁর যে অর্জনগুলো আছে, সেগুলো তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে।

জীবনে নানা রকম সংকট, না পাওয়া, কষ্ট থাকবেই। সেই দুর্বলতা-সংকট কাটিয়ে আমাদেরই সামনের দিকে এগোতে হবে। যখনই মনে হবে পরিচিত কেউ মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বা তাঁর মধ্যে আত্মহত্যার লক্ষণ আছে, তখনই তাঁকে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ ১৬ শতাংশ। আমাদের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি হিসাব করলে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ। ডা. মোহাম্মদ ফারুক আলম বলেন, দুই কোটির বেশি মানসিক রোগে আক্রান্তের চিকিৎসার জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন ৩০০-এর কিছু বেশি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

এ কারণে সবার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করাটা বেশ দুরূহ। চিকিৎসকের সংখ্যা এবং আক্রান্তের সংখ্যা হিসাব করলে পাওয়া যায়, প্রায় ৭০ হাজার রোগীর চিকিৎসার জন্য রয়েছেন মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। (সূত্র: ২০ নভেম্বর ২০১৮, দৈনিক যুগান্তর)। তাই সব দায় কেবল চিকিৎসকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মানসিক রোগের চিকিৎসা করে থাকে, কোনো প্রতিষ্ঠান এমনও আছে, যারা মনোযোগ দিয়ে আক্রান্তের কথা শোনে। আমাদের পরিচিত-প্রিয়জনদের অনেকেই মনের রোগে ভুগছেন। একজন পরিচিত হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। পরিবারের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে, সবার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে, একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে সন্তানদের শারীরিক, মানসিক চাপ মোকাবিলা করার জন্য ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দিতে হবে।

স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীর আবেগ-অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে জমিয়ে না রেখে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। যিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন, তিনি হয়তো অসহ্য যন্ত্রণা ও মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে নিজের মতো করে তাঁর পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন; কিন্তু যিনি চলে যান, তাঁর শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কখনো মেনে নেওয়া যায় না এই আত্মহত্যা। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের মতোই আমাদের জীবনে নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমাদের সন্তানদের, আমাদের প্রিয়জনদের প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে, নিজেদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনে, জীবনযাপনের উদাহরণ দিয়ে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত নিজের ওপর বিশ্বাস রাখার শিক্ষা দিতে হবে। আত্মহত্যা মানে জীবনের অপচয়। জীবন তো একটাই। সেই জীবন একবার শেষ হয়ে গেলে আর ফিরে আসবে না। মানুষের জীবনে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু যে জীবনের সম্ভাবনা অপার, একটি অপমৃত্যু যেন সেই সম্ভাবনা নষ্ট করে না দেয়। ভালোবাসা দিয়ে, যত্ন নিয়ে একটি জীবন যেন বেঁচে থাকে। জীবনে চড়াই-উতরাই থাকবে, হাসি-আনন্দের মতো দুঃখ-কষ্টও আসবে। আমাদের কেবল মনে রাখতে হবে, বেঁচে থাকাটাই জীবন।

মাহবুবা সুলতানা প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক