পরিবার তাঁকে পরিত্যক্ত করেছে; সমাজও গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্র দেয়নি আশ্রয়। সময় দিল না মানুষের স্বীকৃতি। তাহলে কোথায় যাবেন তিনি? পথ তাঁকে বলেছে—দূর দূর। পুরো পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কেননা প্রকৃতি তাঁকে দেয়নি সঠিক কোনো লিঙ্গপরিচয়। কিন্তু পৃথিবীতে তিনি তো আর নিজের ইচ্ছায় আসেননি। কেন, কোন উদ্দেশ্যে তাঁকে এই পৃথিবীতে আনা হলো? কোন জনমের পাপের প্রতিশোধ নিতে? এই অনিচ্ছাজন্ম কেন হলো তাঁর? এমন ধিক্কারের দুর্ভেদ্য জীবন কেন তিনি পেলেন? এ রকম নানা অমীমাংসিত প্রশ্ন তাঁর বুকের ভেতর কেউ যেন পাথরের মতো ছুড়ে মারে। আর একেকটা পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত হতে থাকেন তিনি। কিন্তু কার কাছে উত্তর পাবেন? তাঁর নাম কামরুন নাহার ওরফে কামরুদ্দিন ওরফে কাকলি।
সকাল থেকে তাঁর সব হাততালি ব্যর্থ হয়েছে। দৃষ্টি আকর্ষণের সব কৌশল কারও মনে দয়ার সৃষ্টি করেনি। তাঁর ভিক্ষাপাত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছে সবাই। প্রত্যাখ্যান, মানুষের তীব্র শ্লেষ-মাখানো কটূক্তি-অপমানে রক্তাক্ত হতে হতে, বৈশাখের তপ্ত গরমে ঘামে ভিজতে ভিজতে চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ত একটি বিপণিকেন্দ্রের সামনের ফুটপাতে বসে গেছেন তিনি। ওখানেও ঠাঁই নেই। প্রহরী এসে ছেই ছেই করতে লাগল। পাশে একটা কুকুরও ছিল। কুকুর বসতে পারবে, কিন্তু তিনি বসতে পারবেন না। এই মানুষের কাছে নরম ভাষায় দয়াপ্রার্থনার কোনো মূল্য নেই তিনি জানেন। এরা আসলে তাঁর কাছ থেকে কুকুরের মতোই আচরণ প্রত্যাশা করে। তাই প্রহরীর উদ্দেশ্যে প্রথম হাততালি, তারপর আদিরসাত্মক ভঙ্গিমা দেখিয়ে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগলেন। প্রহরী লাঠি মারতে উদ্যত হয়। যে দুটো হাতে তিনি তালি দেন, তার একটি দিয়ে লাঠি আটকান। শুরু হয়ে যায় পরস্পর পরস্পরকে গালাগালি, মারামারি। আশপাশের অনেকের মধ্যে কৌতূহল জাগে, দেখি কী হয়!
এই শ্রেণির মানুষের ভবিষ্যৎ কী? একবিংশ শতকের এক-চতুর্থাংশ চলে যাচ্ছে প্রায়। তবু মানুষ শুধু লৈঙ্গিক কারণেই এমন ঘোর বৈষম্যের ভেতর রয়ে গেল। পরিবার, সমাজ, দেশবিচ্ছিন্ন আলাদা একটা প্রাণীর মতোই তাদের জীবনযাপন। বহু কাঠখড় পেরিয়ে তারা এখন তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সব অধিকার পাওয়ার স্বীকৃতি কবে মিলবে?
অনেকের কাছে ঝগড়া-মারামারির এই দৃশ্য অজ্ঞাত কারণে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এই ফাঁকে ভয় পেয়ে ঘুমন্ত কুকুরটি পালিয়ে গেল। হাতাহাতি-মারামারি যখন তুঙ্গে, তখন আশপাশের দু-একজন এসে হস্তক্ষেপ করেন। একজন এসে মন্তব্য করেন, ওডা, তুই ইজাড়া মারি হাত হালা গরদ্দে কিল্লাই (তুই হিজড়া মেরে হাত নষ্ট করছিস কেন?)। তিনি পকেট থেকে ২০ টাকার একটা নোট বের করেন। কাগজের এই বস্তুর প্রতি তাঁর বিশেষ লোভ। এ রকম কয়েকটি কাগজের জন্যই সকাল থেকে কত অপমান, কত প্রত্যাখ্যান। ঠিক এ সময় একটু কৌশলী হয়ে প্রশ্ন করেন, এতিক্কিন লাডির বারির দাম বিশ টেয়া? (এতগুলা লাঠির আঘাতের দাম বিশ টাকা?) লোকটি দু-একজনের কাছে আরও কিছু টাকা চেয়ে নিলেন। সব মিলিয়ে তাঁর হাতে পড়ল দেড় শ টাকার মতো। আপাতত সমস্যা সমাধান। প্রহরী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কামরুন নাহার ওরফে কামরুদ্দিন ওরফে কাকলিও কিছু টাকা পেলেন। কিন্তু এই আপাতসমাধানের আড়ালে অমীমাংসিত রয়ে গেল এক জটিল মানবিক সমস্যা।
এই শ্রেণির মানুষের ভবিষ্যৎ কী? একবিংশ শতকের এক-চতুর্থাংশ চলে যাচ্ছে প্রায়। তবু মানুষ শুধু লৈঙ্গিক কারণেই এমন ঘোর বৈষম্যের ভেতর রয়ে গেল। পরিবার, সমাজ, দেশবিচ্ছিন্ন আলাদা একটা প্রাণীর মতোই তাদের জীবনযাপন। বহু কাঠখড় পেরিয়ে তারা এখন তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সব অধিকার পাওয়ার স্বীকৃতি কবে মিলবে? সমাজ থেকে আলাদা হয়ে নয়, সমাজের অংশ হয়ে, এর সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হবে। সব সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সব সময় একটি অচ্ছুত জাতি হিসেবেই চিহ্নিত হতে থাকবে।
তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের এই পরিণতির জন্য প্রধানত দায়ী বলে মনে হয় তাদের পরিবার। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতোই তারা জন্ম নেয়। কিন্তু পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা যখন বুঝতে পারেন নবাগত সদস্যটি পুরুষ নয়, আবার নারীও নয়, তখন তাকে তাঁরা ত্যাজ্য করেন। পরিবার থেকে ছুড়ে ফেলে দেন। যে মানুষ হয়ে জন্মেছিল, যার বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন আছে, সে হঠাৎ হয়ে যায় বাস্তুচ্যুত, হয়ে ওঠে অন্য জগতের এক প্রাণীর মতো। কিন্তু পরিবার যদি তাকে রেখে দিত, সমাজ তাকে গ্রহণে বাধ্য হতো।
আমাদের গ্রামে এ রকম উদাহরণ দেখেছি। পরিবার তাকে ত্যাজ্য করেনি। দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। প্রথমে তাকে পুরুষ মনে করে নাম রাখা হয়েছি শামসুদ্দিন। পরে তার লিঙ্গপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত পরিবার নাম দেয় শামসুন্নাহার। তো পাড়ার কেউ কেউ তাকে শামসু, কেউ কেউ তাকে শামসুনি বলত। সদা হাসিমুখের শামসুনি সামান্য কিছু খাবারের বিনিময়ে গতর খাটত। ধান কাটার দিনে তাকে দেখেছি মাঠ থেকে ধানের বোঝা আনতে। ধান ঝাড়তে। পানি সেচতে। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান ও পরবে তার অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু তাতে সমাজের কোনো ক্ষতি হয়নি। শামসুদ্দিন কিংবা শামসুন্নাহার একটি সমাজে কর্মমুখর জীবন কাটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। সেটি তার পরিবারের কল্যাণেই পেরেছে। পরিবার ছায়া আর মায়া দিয়েছে বলেই আমরা তৃতীয় লিঙ্গের কিছু কিছু সাফল্যের কথা শুনি। এমনকি জনপ্রতিনিধি হয়েছে, গণমাধ্যমেও কেউ চাকরি করছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এই লিঙ্গের জনসংখ্যা ১১ হাজার। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি। তাদের উন্নয়নের জন্য সরকার নানা কল্যাণমূলক পাইলট কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে যে পরিবার তাদের তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানদের ত্যাজ্য করেনি, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। কারণ, সুযোগ-সুবিধা পেলে ওরাও হতে পারে মানবসম্পদ। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের কারণে একটা মানবজীবন হয়ে দুঃসহ–মানবেতর হয়ে উঠবে—এটা এই যুগে কল্পনা করা যায় না। তারা কেন সমাজবিচ্ছিন্ন? তারা কেন ভিন্ন সম্প্রদায়? এ প্রশ্ন আজ উচ্চ স্বরে তোলা হোক একুশ শতকের সব মানুষের কাছে।
● ওমর কায়সারপ্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক