পদ্মা সেতু ও আগামী নির্বাচন সমাচার

বাংলাদেশে এ সময় দুটি বিষয় নিয়েই চর্চা এবং মাতামাতি হচ্ছে। এর মধ্যেই আপাতত হারিয়ে গেছে মূলত প্রতিনিয়ত বাড়তি দ্রব্যমূল্য; উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে সিলেটের বন্যা এবং বন্যাত্তোর ব্যবস্থাপনা এবং সর্বশেষ গ্যাস ও জ্বালানির স্বল্পতায় লোডশেডিং। এ দুটি বিষয়ের একটি হলো প্রমত্ত পদ্মার বুকে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ট্রান্স পদ্ধতিতে তৈরি পদ্মা সেতু।

অ্যাপ্রোচ রাস্তাসহ প্রায় ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু। আর রয়েছে সংযোগে অত্যাধুনিক লিংক রোড বা সংযোগ রাস্তা। বহু বিতর্ক, শঙ্কা ইত্যাদির মধ্যে প্রায় পাঁচ বছরে অবশেষে গত ২৫ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সেতুর উদ্বোধন করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে তাঁর একাগ্রতা এবং দৃঢ়তা ও সাহসের কারণে এ সেতুর কাজ শেষ এবং উদ্বোধন হয়েছে।

এভাবে এত বড় সেতু নির্মাণে বিশ্ববাসী হতবাক হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সেতু সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয়েছে, যদিও সেতুর নিচের তলার রেলসেতুর খরচটি আলোচিত হয়নি। নিজেদের টাকায় নির্মিত সেতুর ব্যয় করা অর্থ কত বছরে উঠবে, সেই বিতর্ক আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়। কারণ, এ সেতু যেমন দক্ষিণের ২১ জেলার দুয়ার খুলে দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও ভূরাজনীতির আঞ্চলিক পরিমাপে স্তর বাড়িয়েছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে।

পদ্মা সেতু নিয়ে এতগুলো বছর হইচই, আলোচনা, তর্ক–বিতর্ক এবং এমনকি এ নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনও সরগরম ছিল। সাধারণ জনগণের মনে দারুণ ঔৎসুক্য ও উত্তেজনা ছিল। নাম হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু, সত্যই তো স্বপ্ন, বিশেষ করে যারা জীবন বাজি রেখে পদ্মা নদী পার হয়ে বাড়ি যেতেন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বা ব্যবসা–বাণিজ্যে অবদান রাখতেন।

কাজেই তাঁদের উন্মাদনা বা উত্তেজনা স্বাভাবিক। তবে স্বাভাবিকতার সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ অথবা বিভিন্ন ব্যবহার সমাজকে কী সংকেত দিয়েছে বা দিচ্ছে, সেটা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু কিছু মানুষের ভিন্ন ধরনের উন্মাদনা অথবা বিকৃত উন্মাদনার উল্লেখ না করলেই নয়—যা দেখলাম বা পড়লাম, সেগুলো নিয়ে আমাদের সমাজবিদেরা চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারেন। এসব বিকৃত রুচির পরিচয় আমাদের সমাজে পচন ধরার আলামত কি না জানি না।

সমাজে যে পচন ধরেছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিশ্লেষণেই দেখা যায়। এ ব্যবস্থায় নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়ার অভাবের কারণেই ছাত্র দ্বারা শিক্ষক নিগৃত হন। এমনতর নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যত রাজনৈতিকীকরণ করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি স্কুলেও রাজনীতি প্রবেশ করানো হয়েছে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার স্থান হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের অনেককেই শিক্ষক কাম রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয়। এসব শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতাদের দাপটই বেশি।

তাদের দাপট শুধু বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজেই নয়, জাতীয় পর্যায়েও প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। অবশ্য সরকারি দলের সমর্থক হলে তো কথাই নেই। মাত্র কয়েক দিন আগে সরকারি দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতা দলবল নিয়ে পদ্মা সেতুতে সেলফি তুলে বলেছে যে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এই সেলফি তুলেছে। জানি না আমাদের মতো সাধারণ কেউ অনুমতি চাইলে অনুমতি মিলবে কি না!

যেকোনো সংক্ষুব্ধ প্রার্থীর আদালতের শরণাপন্ন হওয়া দুঃস্বপ্ন হবে। পেপার ট্রেইল অত্যাবশ্যকীয়, যদি ইভিএমের স্বচ্ছতাকে সন্দেহাতীত করতে হয়। পরিশেষে আমার নিজস্ব মতামত, রিপোর্ট এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে পৃথিবীতে এখনো সাধারণত এমন মেশিন তৈরি হয়নি, যা কেন্দ্র ও বুথ দখল ঠেকাতে পারে। ইভিএম দখলের পদ্ধতি ইতিমধ্যেই ব্যাপক হারে আলোচিত। কাজেই ইভিএম কেন্দ্র দখল ঠেকাবে, এমন দাবি ধোপে টেকে না। বেড়ায় খেত খেলে তা ঠেকানো সহজ নয়।

এসব নিছকই সামান্য বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের সমাজের যে অবক্ষয় হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা এমন কাজে লিপ্ত, তারা অজ্ঞ বা মূর্খ, তেমন নয়। কথিত শিক্ষিত সমাজ থেকেই এমন দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষের শিক্ষা শুধু বই মুখস্থই নয়, এর বাইরের সামাজিক শিক্ষাগুলো আমাদের পরিবারে যেমন নেই, তেমনি শিক্ষাঙ্গনেও নেই।

২.

দ্বিতীয় যে বিষয়টি এখন খুব বেশি চর্চিত হচ্ছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমেই ঝড় উঠছে, সেটা হলো আগামী নির্বাচনের গুরুত্ব এবং কোন পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হবে। আগামী নির্বাচন কতখানি সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে গণতান্ত্রিক বিশ্ব, বিশেষ করে নানাবিধ কারণে পশ্চিমা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে, তার আলামত পরিষ্কার।

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতেরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাঁদের অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনা এমন কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তাঁরা শুধু সাহায্য–সহযোগিতার কথাই বলেননি বরং নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে কমিশনের একাধিকবার বৈঠক করেছিলেন।

তা ছাড়া ইউএনডিপিসহ কয়েকটি দেশ সংস্কার বিষয়ে প্রচুর সহযোগিতা করেছিল। জাতিসংঘসহ প্রায় ৫০০ পর্যবেক্ষক নিয়োজিত করেছিল। অবশ্য এর পরের দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ভিন্নতর হওয়ায় এবার এখন থেকে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলে মনে হয়।

আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যে নির্বাচন কমিশন সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে কি না বা নিশ্চিত করতে কতখানি অগ্রসর হতে পারবে? এখনই ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান পরিষ্কার নয়। কমিশনের সিদ্ধান্তে জটিলতা তৈরি করবে সরকারি দলের ইভিএম ব্যবহারের দাবি। আরেকটি বড় দল এবং শরিকসহ দলগুলো ইভিএমের পক্ষপাতি নয়।

মানে বেশির ভাগ দলই চাইছে না। তা ছাড়া ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই বলে মনে হয় এবং এত অল্প সময়ে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন হবে প্রায় তিন লাখ ইভিএম। এই ইভিএম অত্যন্ত স্পর্শকাতর ডিজিটাল, যার রক্ষণাবেক্ষণই নয়, এর গুদামজাত করে রাখাও একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা।

বর্তমানে ব্যবহৃত ইভিএমের অন্যান্য সমস্যা বাদেও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে আঙুলের ছাপ মেলানো। আমাদের জনগোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠ ভোটারদের আঙুলের ছাপে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, যার কারণে মেলানো কষ্টকর এবং অনেক সময় অপচয় হয়। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোট গ্রহণে দেরির কারণে বহু ভোটার ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করেছেন। নির্বাচন নির্বিঘ্নে হওয়া সত্ত্বেও ভোটের হার পর্যবেক্ষণই এর প্রমাণ।

ইভিএমের বড় ধরনের ত্রুটি, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো পেপার ট্রেইল, যা ছাড়া ইভিএমের ভোট গ্রহণের সন্দেহ দূর করার উপায় নেই। এমনকি রেজাল্ট চ্যালেঞ্জ করারও উপায় নেই।

আরও পড়ুন

যেকোনো সংক্ষুব্ধ প্রার্থীর আদালতের শরণাপন্ন হওয়া দুঃস্বপ্ন হবে। পেপার ট্রেইল অত্যাবশ্যকীয়, যদি ইভিএমের স্বচ্ছতাকে সন্দেহাতীত করতে হয়। পরিশেষে আমার নিজস্ব মতামত, রিপোর্ট এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে পৃথিবীতে এখনো সাধারণত এমন মেশিন তৈরি হয়নি, যা কেন্দ্র ও বুথ দখল ঠেকাতে পারে। ইভিএম দখলের পদ্ধতি ইতিমধ্যেই ব্যাপক হারে আলোচিত। কাজেই ইভিএম কেন্দ্র দখল ঠেকাবে, এমন দাবি ধোপে টেকে না। বেড়ায় খেত খেলে তা ঠেকানো সহজ নয়।

যাহোক, আশা করব যে নির্বাচন কমিশন সব বিষয়ের সমীক্ষা নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেবে না, যা তাদের জন্য আত্মঘাতী হয়। তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করার প্রয়াস।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]