আসুন, আপাতত বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন নিয়ে কথা বলি

বাতাবিলেবুর উৎপাদন ভালো হচ্ছে। রপ্তানিও হচ্ছে। এটা কোনো প্রোপাগান্ডা নয়। কারণ, বাতাবিলেবু ও এর চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো-খালাতো ভাইবোনদের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প নিয়েছে।

প্রকল্প এ বছরেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। তাই এক বছর মেয়াদ বেড়েছে। প্রকল্প সফল হলে মেলা লাভ। উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়বে, ভিটামিন সি গ্রহণের অভ্যাস তৈরি হবে, বেকারত্ব হ্রাস পাবে, আমদানিনির্ভরতা কমে ৪০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে—ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রয়োজন-উপকারিতার কথা বাদ দিন। আমাদের খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকেরাও বাতাবিলেবু খুব ভালোবাসতেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘খুকী ও কাঠ্‌বেরালি’তে লিখেছেন, ‘কাঠ্‌বেরালি! কাঠ্‌বেরালি! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?/ বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?’

জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘সারারাত চিতা বাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে/ নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে/ সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল/ এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে; কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে; নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামল—।’

আরও পড়ুন

কিন্তু আড্ডায়-আলোচনায় বাতাবিলেবুর যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাতাবিলেবু লিখে একটা সার্চ দিন, বিস্মিত হবেন। প্রথম দিকেই আসবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে একটি খবরের লিংক।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৬০টি, টেলিভিশন ৩৬টি। লোকজন মজা করে বলেন, বিটিভি, রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) থেকে শুরু করে অনেক সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে পাঠক-দর্শক-শ্রোতারা নাকি বাতাবিলেবুর ফলনের খবর পাচ্ছেন, সত্যিকারের খবর উধাও।

কৌতূহল থেকে ৬ ডিসেম্বরের বিটিভি ও বাসসের সংবাদসূচি দেখলাম। বিটিভির প্রধান খবরগুলো হলো, ১. পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর, ২. বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে বিশৃঙ্খলার ষড়যন্ত্র করছে, ৩. পিসিটি পরিচালনা চুক্তি বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে, ৪. বিএনপি নিজেরাই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দল, তাই মানবাধিকার দিবস নিয়ে কর্মসূচি দেওয়া তাদের মানায় না।

আরও পড়ুন

মোদ্দাকথা হলো অনেকের কাছে বাতাবিলেবুর সমার্থক হলো অধিকাংশ টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের খবর বা ব্রিজ-কালভার্ট-ভবন ইত্যাদি। ভেবে দেখুন, বাতাবিলেবুর সমার্থক হিসেবে তাঁরা কিন্তু এলাচি লেবু, জারা লেবু, কলম্বো লেবু, সাতকড়া, আদা জামির, মাল্টা, কমলা পর্যন্তও নিতে পারতেন। কিন্তু ওসব কেউ ভাবছেন না। তাঁরা বাতাবিলেবুর বিপরীত শব্দ বলতে বোঝেন, ‘মৃত ব্যক্তিকে দৌড়ে পালাতে দেখেছে পুলিশ’ ধরনের খবর—কী আশ্চর্য!

খোঁজখবর নিয়ে যা দেখলাম, এই চল শুধু আমাদের দেশেই নয়। সারা বিশ্বেই কমবেশি আছে, বহুকাল ধরে। জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্ম-এর কথা ভাবেন। আমরা বইখাতার দিকে না গিয়ে বরং পত্রপত্রিকা, সংবাদমাধ্যমে থাকি। দিন দু-এক আগে নিউজ লাইন ম্যাগাজিনে আল হুদুদ নামের বিদ্রূপাত্মক সংবাদমাধ্যমের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইসাম উরাকাইতের একটা ফিচার পড়ছিলাম (ইন ক্র্যাকিং জোকস, আ স্যাটায়ার পাবলিকেশন টেকস এইম অ্যাট অথরিটারিয়ান’স গ্রিপ)। গল্পে গল্পে ওখানে তিনি একটা শিরোনামের কথা বলেছেন, ‘আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে তরুণকে পুলিশের গুলি’।

গবেষণা বলে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সরকার সংবাদমাধ্যমের নির্মম বিদ্রূপের শিকার হয়। সুরক্ষা থাকায় এসব দেশের সাংবাদিকদের কাউকে গুনতে হয় না। তাই বলে ঠারেঠোরে সরকারকে খোঁচা মারায় চীন, রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। ওসব দেশে এখনো রসিকতা করা যায়। কিন্তু রসিকতার পর কী হবে, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না।

পরে ওই ওয়েবসাইটে ঢুকে আরও কিছু খবরের সন্ধান পাওয়া গেল। যেমন ‘এরদোয়ান অ্যান্ড এমবিএস সাইন কাউন্টার-জার্নালিজম অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এরদোয়ান ও এমবিএসের মধ্যে সাংবাদিকতা প্রতিরোধ চুক্তি স্বাক্ষর)। খবরের ভেতরে এরদোয়ানকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, ‘মূর্খগুলো আমাদের জ্বালিয়ে মারল। সে কারণে আমরা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ও আমার ভাই মোহাম্মদ বিন সালমান এখন থেকে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও উধাও করে দিতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আইনগত ও বেআইনি উপায়গুলো একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করব...।’

আবার এমবিএসকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, ‘আমার ভাই রিসেপ সাংবাদিকদের ছেঁচা দেওয়ায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর এই কাজে আমি, আমার দল, দূতাবাস সব সময় সহায়তা করব। আমাদের লক্ষ্য হবে সাংবাদিক পেলেই এক হাতে পিস্তল ও অন্য হাতে হাড়কাটা করাত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া।’ এই আল হুদুদকে বলা হচ্ছে মার্কিন অনলাইন নিউজ পেপার অনিয়ন এর আরব সংস্করণ।

ওরা আবার লিখেছে, ‘জাতিকে সার্কাস দেখানোর ঘোষণায় বাইডেনের জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী।’ পিউ রিসার্চ সেন্টারের কোনো এক ফেলো রিচার্ড হুইলানকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে আচমকা বাইডেনের জনপ্রিয়তা মেলা বেড়ে গেছে। কারণ, তিনি পুরো জাতিকে বিপজ্জনক অ্যাক্রোব্যাট, চমকে যাওয়ার মতো জাদু ও সত্যিকারের হাতি দেখাবেন। পঞ্চাশটা রাজ্যের লোক যত খুশি তত পপকর্ন, চিনাবাদাম ও হাওয়াই মিঠাই খেতে পারবেন।’

আরও পড়ুন

গবেষণা বলে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সরকার সংবাদমাধ্যমের নির্মম বিদ্রূপের শিকার হয়। সুরক্ষা থাকায় এসব দেশের সাংবাদিকদের কাউকে গুনতে হয় না। তাই বলে ঠারেঠোরে সরকারকে খোঁচা মারায় চীন, রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। ওসব দেশে এখনো রসিকতা করা যায়। কিন্তু রসিকতার পর কী হবে, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না। যেমন রাশিয়ায় বরিস ইয়েলেৎসিনের আমলে কুকলি নামের একটা পাপেট শো হতো। একটা পর্যায়ে ইয়েলেৎসিনের পরিবার বিদ্রূপের মাত্রাটা একটু কমাতে বলল।

এরপর এলেন পুতিন। তিনি ওই শোতে তাঁর চরিত্রের পুতুলটাকে সরাতে বললেন। পুতুলের পরিবর্তে তারা একটা অশরীরী গলা শোনাতে শুরু করল। পুতিন ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ওই চ্যানেলই বন্ধ করে দিলেন। এই বাংলাদেশেও এমন কত উদাহরণ আছে। এবিএম মূসা আত্মজীবনীমূলক আমার বেলা যে যায় বইয়ে আইয়ুব খানের আমলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার খবরদারি এড়িয়ে কীভাবে খবর ছাপতেন, সেই উদাহরণ দিয়েছেন।

১৯৫৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার। মানুষ শোনেননি। ১৪৪ ধারা ভেঙে পথে নেমেছেন, তাঁদের লাঠিপেটাও করা হয়েছে। পত্রপত্রিকাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, শহীদ দিবস বা লাঠিপেটার কথা বলা যাবে না। পরদিন বিশাল শিরোনামে অবজারভার-এ খবর ছাপা হয়, ‘টুয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি অবজার্ভড। স্টুডেন্টস ট্রাই টু ব্রিং আউট প্রসেসন। নো লাঠিচার্জ, টেন ইনজুরড’ (২১ ফেব্রুয়ারি পালিত। ছাত্রদের মিছিল বের করার চেষ্টা। লাঠিপেটা হয়নি, ১০ জন আহত)। শহীদ দিবস, লাঠিচার্জে আহত হওয়ার প্রসঙ্গ বাদ।

আরও পড়ুন

ছোট্ট একটা খবর দিয়ে শেষ করি। নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক জোট সিভিকাস ৬ ডিসেম্বরই তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘পিপল পাওয়ার আন্ডার অ্যাটাক’ প্রকাশ করেছে। ১৯৮টি দেশের ওপর করা ওই প্রতিবেদন বলছে, রাজনৈতিক, আইনগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে নাগরিকেরা তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় তুলে ধরেন। এই পরিসরগুলো মুক্ত, সংকীর্ণ, বাধার সম্মুখীন নাকি বন্ধ, তা যাচাই করাই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য। এতে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এই পরিসরগুলো ‘বন্ধ’ হয়ে গেছে। তো চলুন, বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন নিয়ে আলোচনা হয়ে যাক। ফলটা কিন্তু সত্যি ভালো, তার ওপর চড়াও হবেন না, প্লিজ।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল [email protected]

আরও পড়ুন