ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিই কি একমাত্র পথ

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হ্রাস করার জন্য প্রতিবছর ৪ বার করে ৩ বছরে মোট ১২ বার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে সরকার। বলা হচ্ছে, আইএমএফের শর্ত অনুসারে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্যই এ মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকটের সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা

বিদ্যুৎপ্রতীকী ছবি

সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হ্রাস করার জন্য প্রতিবছর ৪ বার করে ৩ বছরে মোট ১২ বার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৭ টাকা ৪ পয়সা। তবে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। (বছরে চারবার বাড়বে বিদ্যুতের দাম, প্রথম আলো, ৩ মে ২০২৪)

বিদ্যুতের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত এমন একটি সময়ে নেওয়া হলো, যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই মানুষ ব্যাপক চাপে রয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ এবং বিদ্যুতের দাম জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় প্রতি মাসে গড়ে ৫ শতাংশ করে বাড়ানোর কারণে তা মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। (গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চাপ ‘ভোক্তার ওপরই পড়বে, প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩; বিদ্যুতের দাম বাড়ল ইউনিটপ্রতি গড়ে ৭০ পয়সা, প্রথম আলো, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। এ বছরের মার্চে আবারও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ইউনিটপ্রতি ৭০ পয়সা বাড়ানো হয়।

এভাবে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়লে গ্রাহককে একদিকে বিদ্যুৎ কিনতে বাড়তি খরচ করতে হবে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে উৎপাদিত সব পণ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর জন্যও বাড়তি মূল্য দিতে হবে। এভাবে আবাসিক, সেচ, শিল্প, শিক্ষা, হাসপাতাল, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ বাড়বে। ধান-চালসহ সেচের ওপর নির্ভরশীল সব ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সব ধরনের শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচও বাড়বে।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এভাবে কৃষি, শিল্প, সেবাসহ সব খাতে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে, যার প্রভাব ‘মাল্টিপ্লায়িং ইফেক্ট’ আকারে পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে এমনিতেই বিপর্যস্ত নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হবে।

বলা হচ্ছে, আইএমএফের শর্ত অনুসারে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্যই এই মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ভর্তুকি কেন দিতে হচ্ছে এবং সেই ভর্তুকির টাকা কোথায় যাচ্ছে, কারা পাচ্ছে?

লক্ষণীয়, ভর্তুকি কমানোর জন্য মূল্যবৃদ্ধিই একমাত্র উপায় নয়। উৎপাদন খরচ কমিয়েও তো ভর্তুকি কমানো যায়। তাহলে কী কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা কিংবা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় দূর করার চেয়ে সরকার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়েই বেশি আগ্রহী?

ভর্তুকির প্রধান কারণ, আমদানিনির্ভর ও ব্যয়বহুল তরল জ্বালানিভিত্তিক বেসরকারি মালিকানার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে। বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার খরচ সরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক বেশি। বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন যত বাড়ছে, দেশের গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তত বাড়ছে।

পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ সালে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ৬ টাকা ৬১ পয়সা, যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ সালে ৮ টাকা ৮৪ পয়সা এবং ২০২২-২৩ সালে ১১ টাকা ৩৩ পয়সা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ সালে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৭ টাকা ৬৩ পয়সা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ৮৫ পয়সা হলেও বেসরকারি খাতের আইপিপিগুলোর গড় উৎপাদন খরচ ১৪ টাকা ৬২ পয়সা ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় উৎপাদন খরচ ১২ টাকা ৫৩ পয়সা।

আরও পড়ুন

এক বছর আগে বেসরকারি খাতের আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ১১ টাকা ৫৫ পয়সা ও ৯ টাকা ৮০ পয়সা। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২২-২৩, পৃষ্ঠা ৯৮)। এ কারণেই বেসরকারি খাতের আইপিপি ও রেন্টাল মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে পিডিবির লোকসান বাড়ছে আর সেই লোকসান সামাল দিতে সরকারকে ক্রমবর্ধমান হারে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ভর্তুকির অর্থ কোথায় যাচ্ছে? বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ (ক্যাপাসিটি চার্জ) ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ খাতের জন্য দেওয়া ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো, যা ছিল ওই অর্থবছরে দেওয়া মোট ভর্তুকির ৬৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। (বিদ্যুতে ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ক্যাপাসিটি চার্জ, বণিক বার্তা, ৪ মে ২০২৪)

কাজেই দেখা যাচ্ছে, ভর্তুকির অর্থের বেশির ভাগটাই ব্যয় হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জের পেছনে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটা বড় অংশ সারা বছর অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে বিদ্যুতের একক ক্রেতা হিসেবে পিডিবি কর্তৃক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া দিতে হয়। গত বছর সক্ষমতার ৪১ শতাংশ অলস বসিয়ে রেখে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। (ব্যয় তিন গুণ, তবু কেনা হয় তেলভিত্তিক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ, প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গত ১৪ বছরে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। (‘বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ ১৪ বছরে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি’, বিবিসি বাংলা, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। প্রতিবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে এই ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে পিডিবির লোকসান। আর সেই লোকসান কমানোর কথা বলে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু লোকসান ও ভর্তুকিও কমেনি; বরং বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হয়েছে। (বিদ্যুতের দাম বাড়ল ইউনিটপ্রতি গড়ে ৭০ পয়সা, প্রথম আলো, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

কিন্তু ভর্তুকি কমানোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ না কমিয়ে দিনে দিনে আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেমন দেশে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ করতে না পারার কারণে প্রায় অর্ধেক সক্ষমতা বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। (ব্যয় তিন গুণ, তবু কেনা হয় তেলভিত্তিক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ, প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

আরও পড়ুন

এ রকম অবস্থায় গ্যাস–সংকটের সমাধান না করে নতুন গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো নতুন নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করা হচ্ছে না। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট ও ইউনিক গ্রুপের দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে, যেগুলোর সক্ষমতা ১ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট। এ ছাড়া উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে রিলায়েন্সের ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা যুক্ত হলে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় আরও বেড়ে যাবে বিপিডিবির। (বিদ্যুতে ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ক্যাপাসিটি চার্জ, বণিক বার্তা, ০৪ মে ২০২৪)

আইএমএফ সুশাসনের কথা বলে, রিজার্ভ কত রাখতে হবে, কর-জিডিপি অনুপাত কত বাড়াতে হবে, এসব বিষয়ে নানা ধরনের সুনির্দিষ্ট শর্ত দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, আইএমএফ কেন ক্যাপাসিটি চার্জ কমানোর কোনো লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় না কিংবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের ছত্রচ্ছায়ায় বিনা দরপত্রে একের পর এক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে কোনো আপত্তি করে না?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের ধারা ৯ অনুসারে, এই আইনের অধীন করা কোনো কাজের বৈধতা নিয়ে আদালতেও প্রশ্ন তোলা যাবে না। ধারা ১০ অনুসারে, এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনকালে ‘সরল বিশ্বাসে’ করা কোনো কাজের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এভাবে কোনো আইনের অধীন করা কাজকে আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করা যে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে, এটা সহজেই বোধগম্য। তাহলে সুশাসনের কথা বললেও আইএমএফ কেন দায়মুক্তি আইনটি বাতিলের শর্ত দিচ্ছে না?

আগে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গণশুনানি করতে হতো। সেখানে বিভিন্ন অংশীজন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন গণবিরোধী তৎপরতার সমালোচনা করতে পারতেন, জবাবদিহি চাইতে পারতেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করে বিইআরসির পাশাপাশি দাম বাড়ানোর ক্ষমতা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নিজের হাতে নিয়ে নেয়। (সরকারকে অপেক্ষায় থাকতে হবে না, ২ ডিসেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)

এর পর থেকে কোনো ধরনের গণশুনানি ছাড়াই স্রেফ একের পর এক নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সুবিধার জন্য এভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের ন্যূনতম জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এ বিষয়েও আইএমএফের কোনো আপত্তি দেখা যাচ্ছে না।

আইএমএফের অ্যাজেন্ডা হলো দেশের পাবলিক সেক্টর বা সর্বজনের খাতকে হয় বেসরকারীকরণ করা অথবা ভর্তুকি কমিয়ে বেসরকারি খাতের মতো মুনাফাকেন্দ্রিক নীতিতে পরিচালনা করা। এর ফলে এ খাতগুলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। কাজেই আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য গেলে আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর শর্ত দেবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো রিজার্ভ কমতে কমতে আইএমএফের কাছে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?

সরকারের পক্ষ থেকে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি, বাণিজ্যঘাটতি, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে বিদেশে পুঁজি পাচার, ঋণনির্ভর ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ ও জ্বালানি আমদানির ঘটনাগুলো যুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই ঘটছিল। আইএমএফের শর্তের কথা বলে সরকার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির দায় এড়াতে পারে না। কারণ, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আইএমএফের ‘শর্তের জালে’ ঢোকানোর ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন সরকারই করেছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল সমস্যা হলো কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়াই বিভিন্ন দেশি–বিদেশি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের ছত্রচ্ছায়ায় বিনা দরপত্রে একের পর এক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন। এর ফলে একদিকে অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো স্থানীয় উৎসের জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব না দিয়ে এলএনজি, তেল ও কয়লার মতো আমদানিনির্ভর প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এই মূল সমস্যাগুলোর সমাধান না করে বিদ্যুতের দাম যতই বাড়ানো হোক—তাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকটের সমাধান হবে না। এসবের ফলাফল হিসেবে দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবন কেবল বিপর্যস্তই হবে।

  •  কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক