তিনি কি ‘তালেবানি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

গত বছর ডিসেম্বরে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী ‘তালেবান’ দেশটির ৩৪ প্রদেশেই মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তৃতীয় শ্রেণির বেশি মেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজন নেই—এ বিধি চালু করে মেয়েদের পার্ক, বিউটি পারলারসহ ঘরের বাইরে যাওয়া কার্যত বন্ধ করেছে তারা। নারীশিক্ষাকে টেনে ধরার জন্য বিশ্বজুড়ে দেশটির এমন কার্যকলাপে নিন্দা জানিয়েছে অনেক বৈশ্বিক সংগঠন।

আফগানিস্তানে তালেবানের শাসনব্যবস্থা নিয়ে সেই দেশের মানুষ খুশি না বেজার, তা নিয়ে আলোচনা করা অর্বাচীনের মতো দেখায়। তবে তাদের শাসনব্যবস্থার আদলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

তালেবানি সংস্কৃতি ধারণ করে এই উপাচার্য এমন একসময় গৌরবান্বিতবোধ করেছেন, যখন দেশের এক উদীয়মান ক্রিকেটারের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেলামেশাকে ‘ফ্রি মিক্সিং’ বলে আখ্যা দেওয়া এবং কর্মজীবী নারীদের নিয়ে হেয় করে বক্তব্য দেওয়া পুরোনো কিছু ফেসবুক পোস্ট নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে। দুটি ঘটনায় স্থান–কাল–পাত্রভেদে ভিন্ন হলেও তাঁদের মন্তব্য একই মোহনায় গিয়ে মিশেছে। তাঁদের বক্তব্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, যা একই স্বপ্নে একাকার।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে চিন্তাচেতনার ওপর দাঁড়িয়ে, সেটিকেই নাড়িয়ে দিয়েছেন ‘তালেবানি’ স্বপ্নে বিভোর এই উপাচার্য, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলনীতি, এমনকি আমাদের দেশের সংবিধানপরিপন্থী বটে।

২০ সেপ্টেম্বর মহান এই উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি অডিটরিয়ামে আয়োজিত তথ্য অধিকারবিষয়ক এক সেমিনারে গিয়ে বলছেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, এখানে (বিশ্ববিদ্যালয়) ওপেন কালচার ছিল, ছেলেমেয়েরা যা খুশি, তা-ই করতে পারত। কেউ কিছু বলতে পারত না। কারণ, তাদের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আমি বলেছি, সাড়ে ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। তারা (শিক্ষার্থী) এটার নাম দিয়েছে তালেবানি কালচার। তালেবানি কালচার নিয়ে আমি খুবই গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওপেন কালচার চাই না।’ (প্রথম আলো ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

আরও পড়ুন

আমি ঠিক নিশ্চিত নই, কেন তিনি এসব কথাবার্তা তথ্য অধিকারবিষয়ক সেমিনারে বলতে গিয়েছেন কিংবা কোন পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, তা গণমাধ্যমের খবরেও স্পষ্ট নয়। তবে প্রেক্ষাপট যেটাই হোক, মাননীয় উপাচার্য যেসব শব্দচয়ন করেছেন, তাতেই তাঁর অবস্থান প্রস্ফুটিত হয়েছে।

তাঁর এমন চিন্তাধারার প্রতিফলন আমরা প্রায় বছর দুয়েক আগেই তো পেয়েছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, শাবিপ্রবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উত্তাল, তখন তিনি আরেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিলেন।

সেই সময় ভাইরাল হওয়া এক অডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সহজে কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না। (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০২২) ওই ঘটনায় ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কুশপুত্তলিকা দাহ করে বিক্ষোভ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ পৃথক বিবৃতিতে ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি উঠলে চাপের মুখে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। পরে তিনি গণমাধ্যমে তাঁর মন্তব্যের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান। (যুগান্তর, ২৪ জানুয়ারি ২০২২)

আরও পড়ুন

তবে সর্বশেষ বক্তব্যে ‘ওপেন কালচার’ শব্দদ্বয় দ্বারা তিনি সত্যিই কী বুঝিয়েছেন, তা আমার কাছে সহজবোধ্য হয়নি। এই শব্দদ্বয় যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের জন্য অপমানজনক, বেদনাদায়ক, তার দায়ভার তাঁকে নিতে হবে বৈকি। ওপেন কালচার আসলে কী? উপাচার্য কি মনে করেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে এসে ‘দৃষ্টিকটু’ কাজে লিপ্ত থেকেছে, যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে? নাকি খোলা সংস্কৃতি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের অবাধ চলাফেরা?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটির অর্থোদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া এই উপাচার্য সাধারণ মানুষদের কাছে আমাদের উচ্চশিক্ষালয় বিষয়ে একধরনের ভুল ও বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়েছেন তাঁর ওই সব অর্বাচীন বক্তব্যের মাধ্যমে। সমাজের অনেক মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাঁরা কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পা দেননি, তাঁরা এই মহান উপাচার্যের কথায় সায় দেবেন যে বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বুঝি ছেলেমেয়েরা ঢলাঢলি করে, সরাসরি যৌনতায় লিপ্ত থাকে। ফলে ‘উচ্চশিক্ষা’ সম্পর্কে সমাজে বিদগ্ধ প্রচারণা পাবে।

‘বিশ্ববিদ্যালয় মানেই যে ওপেন কালচার’—বিষয়টি যদি একজন উপাচার্য না বুঝে অপব্যাখ্যা করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকানি দেন, তাহলে এমন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার জন্য ক্ষতিকর। সারা বিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওপেন কালচার চালু রয়েছে। সেখানে ওপেন কালচার মানে চিন্তার স্বাধীনতা, ওপেন কালচার মানে নানা ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল, যার মধ্যে বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয় গড়ে ওঠে।

যদি এই শিক্ষক মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা ওপেন কালচারে অভ্যস্ত হয়ে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম খুইয়েছেন কিংবা ছেলেমেয়েরা অবাধ মেলামেশায় শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করেছে, তাহলে তার প্রমাণ তাঁকে দিতে হবে বৈকি।

‘বিশ্ববিদ্যালয় মানেই যে ওপেন কালচার’—বিষয়টি যদি একজন উপাচার্য না বুঝে অপব্যাখ্যা করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকানি দেন, তাহলে এমন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার জন্য ক্ষতিকর। সারা বিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওপেন কালচার চালু রয়েছে। সেখানে ওপেন কালচার মানে চিন্তার স্বাধীনতা, ওপেন কালচার মানে নানা ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল, যার মধ্যে বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয় গড়ে ওঠে। বদ্ধ কালচারে কখনো উচ্চশিক্ষা হয় না, সেটি হয় সম্প্রদায়কেন্দ্রিক শিক্ষা কিংবা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক চেতনার লালন।

অধ্যাপক ফরিদ যে দৃষ্টিতে ওপেন কালচার বুঝিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতেও ছিল না, বর্তমানেও নেই। বরং একটা সময় বলতে শোনা যায়, অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনদেরই সহপাঠীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন, এই ‘ওপেন কালচার’ই বাংলাদেশের অস্তিত্বকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীরা ওই ওপেন কালচারে বেড়ে উঠে শিক্ষকদের বন্ধুর মতো পাশে পেতেন, নিজেদের জ্ঞানের পরিধি সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেতেন।

আরও পড়ুন

মাননীয় উপাচার্য হয়তো জানেন না, বিশ্ববিদ্যালয় আর কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে তফাত কোথায়। নার্সারি কিংবা স্কুলের পড়াশোনা করতে পিতা–মাতার যে শাসন-আদেশ পেয়ে সন্তানেরা এগিয়ে যায়, সেটি যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে প্রয়োজন পড়ে না, সেটি মনে হয় উপাচার্য ভুলে গিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই তো একজন শিক্ষার্থী বিশ্বমানব হওয়ার শিক্ষা পাবেন। নিজের পড়াশোনা নিজের তাগিদে করবেন, নিজের ক্যারিয়ার নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়বেন আর এটাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন কালচার। চিন্তার দাসত্বে যে মুক্তি নেই, সেটি উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকা চাই।

দেশের বাইরে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ও গবেষণার সুযোগ মিলেছে। পিএইচডির সময় এমনও রাত গিয়েছে ল্যাবে গবেষণা করেই। কে কখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন, ল্যাবে কাজ করছেন, সেটির কোনো সময়সীমা নেই। মধ্যরাতেও দেখেছি, ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সেরে বাসায় ফিরছেন। কখনো তাঁদের শুনতে হয়নি, ওপেন কালচার তাঁদের নষ্ট করে দিয়েছে। আর নষ্ট পরিবেশ নেই বলেই সেগুলো আজও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি অব্যাহত রেখেছে।

আমি নিশ্চিত অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই রকম শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ থাকলে তিনি আজ ‘ওপেন কালচার’ শব্দ দিয়ে রাত সাড়ে ১০টায় শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দী করার চিন্তা করতে পারতেন না। ছেলেমেয়েদের পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ থাকলে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনরা এসব কথা বলার সুযোগই পেতেন না।

আজ এসব কথা বলার পাচ্ছেন। কারণ, এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল ‘সনদ’ প্রদানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক মানব গড়ার অঙ্গীকার নেয়নি। তিনি নোংরা যুক্তি দিচ্ছেন। কারণ, তাঁরা ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার শিক্ষার্থীদের কাঁধে ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও সংকুচিত করার চেষ্টা করছেন কিংবা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের ঘরমুখী রাখার কৌশল নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

শুধু শাবিপ্রবি নয়, দেড় দশক ধরে এ চিত্র বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত হচ্ছে। অঘোষিত সান্ধ্য আইনের আদলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত অধ্যাদেশবিরোধী। এরপরও শিক্ষার্থীরা সেটিকে মেনে নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে আসছেন।

তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রতিকূল পরিবেশ হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। তবে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ যে তালেবানি চর্চার কথা বলেছেন, তা ভয়ানক ইঙ্গিত। তিনি যেটি চর্চা করে গৌরববোধ করছেন, সেটি আদৌও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর সঙ্গে যায় না।

এই দেশের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষায় নিজেদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটাতে যায়, মস্তিষ্ককে তালেবানি শাসনে শিকলবন্ধী করার জন্য যায় না। মুক্তচেতনা তৈরি না হলে যে উচ্চশিক্ষার সোপান পেরোনো কঠিন, তা শাবির উপাচার্য বুঝতে সক্ষম হননি। আর হননি বলেই গত বছর ১৩ জানুয়ারি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তোলার কারণে শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার স্বাদ দেন। ‘ওপেন কালচার’ শব্দদ্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ভুলভালভাবে উপস্থাপন করছেন।

তালেবানি চিন্তা ধারণ করে, স্বাধীন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন উপাচার্য আদৌও কতটা প্রয়োজন, তার সিদ্ধান্ত সরকার নিক। তবে উপাচার্যের এমন চিন্তাশীলতা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বোঝা, মুক্তজ্ঞানচর্চায় অন্তরায়—সেটি বোঝার সক্ষমতা আমাদের থাকা চাই।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]