একটি ‘অসংগতি’, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা এবং কিছু প্রশ্ন

একটি ‘অসংগতি’ বা ‘ভুল’কে অপরাধীকরণের এই প্রক্রিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
ছবি: প্রথম আলো

২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ার সময় একটি ‘গ্রাফিক কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি থাকলেও ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। এই ‘অসংগতি’ নজরে আসার পর দ্রুত তা সরিয়ে নিয়ে সংশোধনীও দেওয়া হয়। কিন্তু ছবি ও উদ্ধৃতির এই অসংগতিকে কেন্দ্র করে ‘অভূতপূর্ব’ সব ঘটনা ঘটেছে।

প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে রাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়, অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার ৩০ ঘণ্টা পর তাকে আদালতে হাজির করা হয় এবং জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠানো হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে, যার একটিতে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়েছে। একটি ‘অসংগতি’কে কেন্দ্র করে মামলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা, সরকারের মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া এবং খোদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দুনিয়ার কোনো সংবাদমাধ্যমই ভুল–ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। কোনো সংবাদমাধ্যমের কোনো প্রতিবেদন বা লেখায় কোনো ভুল হলে সংশোধনী দেওয়া হয়। এটাই বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার চর্চিত রীতি। এই রীতি অনুসরণ করেই ছবি ও উদ্ধৃতির ‘অসংগতি’ নিয়ে প্রথম আলো সংশোধনী দিয়েছিল। এরপরও কারও কোনো আপত্তি থাকলে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটি না করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তা আমলে নেওয়া হয়েছে।

একটি ‘অসংগতি’ বা ‘ভুল’কে অপরাধীকরণের এই প্রক্রিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ। জাতিসংঘসহ দেশি–বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছে, ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা কি এই অভিযোগকেই সত্য প্রমাণ করছে না?

আরও পড়ুন

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত বুধবার ভোর চারটার দিকে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে সাভারে তাঁর বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক কোনো ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৩০ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। তবে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে রমনা থানা–পুলিশ তাকে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাঁকে যেভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ‘আটক’ রাখা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে,  পুলিশ শামসকে গ্রেপ্তার করেনি, ‘অপহরণ’ করেছিল (হি সেইড শামস ওয়াজ নট অ্যারেস্টেড বাই দ্য পুলিশ, বাট ‘অ্যাবডাক্টেড’)। শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘তিনি কয়েক ঘণ্টার জন্য গুমের ভুক্তভোগী ছিলেন। ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী শুধু ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পুলিশ তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে।…’ (‘হি ওয়াজ এ ভিকটিম অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স। এজ পার দ্য ডিরেকটিভস ইস্যুড বাই দ্য সুপ্রিম কোর্ট ইন দ্য ব্লাস্ট ভার্সেস বাংলাদেশ কেস, পুলিশ কুড হ্যাভ অ্যারেস্টেড হিম উইদাউট ওয়ারেন্ট ওনলি আন্ডার সেকশন ফিফটি ফোর অব দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর।…’) [দ্য ডেইলি স্টার, ১ এপ্রিল ২০২৩]

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং বিভিন্ন সময় সেটা করাও হচ্ছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে এ আইনের অন্যতম টার্গেট ভিন্নমতালম্বী সাংবাদিকেরা। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য এ আইন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনটি স্থগিত করা এবং এই আইনে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করা এখন সময়ের দাবি।

শামসুজ্জামানকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকেরা বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি  বলেছিলেন, ‘আইন কিন্তু নিজস্ব গতিতে চলে।’ শামসুজ্জামানকে যেভাবে তুলে নেওয়া হলো এবং ‘আটক’ রাখা হলো, তা যদি আইনের ‘নিজস্ব গতি’ হয়, তাহলে সেটা খুবই আশঙ্কার বিষয়।

বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘যে মামলা করা হয়েছে বা যেটা হচ্ছে, এটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ (প্রথম আলো, ৩১ মার্চ ২০২৩)। ‘ন্যায়’ বা ‘অন্যায়’ একটি আপেক্ষিক বিষয়। তিনি যে ঘটনাকে ‘অন্যায়’ বললেন, সেটা কোন মানদণ্ডে ‘অন্যায়’? আদৌ এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে? সবচেয়ে বড় কথা, কারও বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে ‘অন্যায়’ কোন কারণ হতে পারে না। মামলার জন্য আইন অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী একাধিকবার বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য একটি সেলে পাঠানো হবে। কিন্তু প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

আরও পড়ুন

প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আটকের কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মঙ্গলবার দিবাগত রাতে একটি মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানা যায়। এই মামলার এজাহারে শুধু তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়। বুধবার রাতে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রমনা থানায় আরেকটি মামলা হয়। শামসুজ্জামানকে আগে দায়ের হওয়া মামলাটিতে নয়, পরের মামলাটিতে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, একই ঘটনায় একাধিক মামলা দায়েরের পেছনে সাধারণত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে এভাবে একাধিক মানহানির মামলা দিয়ে তাদেরকে হয়রানি করা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় হয়রানি আরও অনেক বেশি। জামিন না দেওয়া এবং বিচার শুরুর আগেই কাউকে কারাগারে পাঠানোর জন্য এই আইন একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। এ কারণেই কি প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে?

আরও পড়ুন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং বিভিন্ন সময় সেটা করাও হচ্ছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে এ আইনের অন্যতম টার্গেট ভিন্নমতালম্বী সাংবাদিকেরা। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য এ আইন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনটি স্থগিত করা এবং এই আইনে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করা এখন সময়ের দাবি।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক