আর কত শিক্ষার্থীর অপমৃত্যুর মিছিল দেখব?

এ মাসের মাঝামাঝি পরপর দুই দিন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) এক শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে) এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর শুনে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। শিক্ষক হিসেবে আমাদের তো দায় আছে বিষয়টি নিয়ে কিছু করার। এ বিষয়ে আমার মতামত তুলে ধরার পাশাপাশি আমার বর্তমান কর্মস্থল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) শিক্ষার্থীদের অপমৃত্যু ঠেকাতে কী কী করছে, তা পাঠকদের উদ্দেশ্য তুলে ধরব।

লেখা শুরু করার আগে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চিত্রটি সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য খবরের কাগজে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ ও মতামতের দিকে চোখ বুলালাম। সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি মতামত ও সংবাদের শিরোনামের কথা উল্লেখ করলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে, বিষয়টি কতটা ভয়ানক পর্যায়ে গেছে।

আরও পড়ুন

কেন এত হতাশা? কেন এত আত্মহত্যা (১ মে ২০২৩, প্রথম আলো), ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রের আত্মহত্যা (৪ এপ্রিল ২০২৩, জবি প্রতিনিধি) ও আত্মহত্যা মহামারি হয়ে উঠছে কেন? (১২ এপ্রিল ২০২২, প্রথম আলো)।

আরও ভয়ানক তথ্য হচ্ছে গত তিন বছরে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর হার ভয়ানকভাবে বাড়ছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী ও ২০২২ সালে ৪৪৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এই আত্মহত্যার হার ৫ দশমিক ৫ গুণ বেড়েছে।

আরও পড়ুন

আত্মহত্যার বিষয়টি বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যেও ঘটে এবং এর পরিধি অনেক বড় হওয়ায় শুধু শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়ে আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না হওয়া, অকৃতকার্যতা, আর্থসামাজিক সমস্যা, পারিবারিক সংকট, প্রেম-বিরহ, বখাটের অত্যাচার ইত্যাদি কারণে মানসিক চাপ থেকে বিষণ্নতা, হতাশা, একাকিত্ব—বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার এক ভয়ানক ঊর্ধ্বগতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানী, উন্নয়নকর্মী ও সচেতন মহল।

এখানে যে কারণগুলোর কথা বলা হয়েছে, বেশির ভাগেরই একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক রয়েছে। আমি সবগুলো বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করব না। শুধু পরীক্ষার ফলাফলের কারণে শিক্ষার্থীর আত্মহননের বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষক ও সহপাঠীর ভূমিকার বিষয় তুলে ধরব।

আরও পড়ুন

আমাদের বেশির ভাগ অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে শুধু সিজিপিকেই মুখ্য বিষয় মনে করছেন। এর ফলে তাঁরা জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার চেয়ে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। এর ফলে তা শিক্ষার্থীরা পারুক না পারুক, তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আকাশচুম্বী আকাঙ্ক্ষার দিকে ধাবিত করছে।

ধীরে ধীরে তাঁরা পরিপক্ব হয়ে ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা না পেয়ে সামান্য কিছুতেই মানসিক চাপ বোধ করেন। এই মানসিক চাপের কারণে পরীক্ষার প্রশ্ন একটু কঠিন হলে, একটু পারিবারিক সংকট হলে, কোনো বিষয়ে সামান্য বকাঝকা দিলে কিংবা সহপাঠীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে জড়ালে সহজেই তাঁরা হতাশা কিংবা বিষণ্নতায় ভোগেন। এর প্রভাব পড়ে প্রতিটি স্তরের পরীক্ষার ফলাফলে।

এ তো বললাম সমাজ ও অভিভাবকের ভূমিকা। এবার আসি শিক্ষকদের ভূমিকায়। কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো কারণে ভালো ফলাফল না করেন, অনেক শিক্ষক আছেন, তাকে সহপাঠীর সামনে হেয় করেন, বকাঝকা করেন, সামনের বেঞ্চে বসতে দেখলে বাঁকা চোখে দেখেন, যে প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না, তা জেনেও পড়া ধরে নাজেহাল করেন। এমনকি সবকিছুর মূল্যায়নে তাকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেখা যায়, কম সিজিপিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এসব আচরণ বেশি করা হয়। মৌখিক ও ল্যাবের পরীক্ষায় তাঁর উত্তর শুনতে, গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে কিংবা সুপারিশপত্র দিতে কার্পণ্য করা হয়। সত্যি বলতে কি, এসব শিক্ষার্থীর পক্ষে এই বিষাক্ত পরিবেশে মানিয়ে চলা তখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেখা যায়, কম সিজিপিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এসব আচরণ বেশি করা হয়। মৌখিক ও ল্যাবের পরীক্ষায় তাঁর উত্তর শুনতে, গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে কিংবা সুপারিশপত্র দিতে কার্পণ্য করা হয়। সত্যি বলতে কি, এসব শিক্ষার্থীর পক্ষে এই বিষাক্ত পরিবেশে মানিয়ে চলা তখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।

আমি এমআইটিতে দেখি, কোনো শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীদের সিজিপি বিষয়ে জানতে চান না। কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো বিষয়ে খারাপ করেন, তাহলে শিক্ষার্থীকে একা ডেকে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘আমি মনে করি এই ফলাফল তোমার মেধা, সম্ভাবনা কিংবা স্মার্টনেসের সঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে না। আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি, যাতে তুমি তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারো?’

এখানে প্রতিটি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সম্মানের ও সম্ভাবনার চোখে দেখেন, বন্ধুসুলভ আচরণ করেন। তারপরও কেউ যদি হতাশা কিংবা বিষণ্নতায় ভোগেন, শিক্ষকেরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে যোগ্য মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের দ্বারা অতি গোপনে এবং অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিষয়টি দেখভাল করেন। পক্ষান্তরে সহপাঠীরাও কেউ কোনো বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না পারলে সহপাঠীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।

প্রতিবছর এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমন্বয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়। প্রশাসন এই প্রতিবেদন দেখে করণীয় থাকলে তার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, যাতে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত হয়।

আজ দেশে ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া শিক্ষার্থীদের অপমৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে সব অভিভাবক, শিক্ষক ও সহপাঠীদের মনমানসিকতার পরিবর্তন ও সচেতন হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তা না হলে এই দায়ভার নিয়েই আমাদের মরতে হবে।

  • ড. মো. শফিকুল ইসলাম; ভিজিটিং অধ্যাপক ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), যুক্তরাষ্ট্র এবং অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
    ই-মেইল: [email protected]; [email protected]