‘বেচাকেনা কমি গেইচে। সবকিছুর দাম বাড়ি গেইচে। আগে যা বেচাকেনা হইচে, এলা তার অর্ধেক হয়। সিগারেট ছাড়া কোনো কিছুই আগের মতো বেচি হয় না। যারা ১০টা ডিম আগে কিনত, তারা ৪টা ডিম কেনে। মানুষ চাউলও কম কেনে। বেচি না হইলে হামরা বাঁচি কেমন করি?’ গত ১৪ আগস্ট রংপুরের পার্ক মোড় এলাকায় এক মুদিদোকানি কথাগুলো বলছিলেন।
রংপুরের আশরতপুর কাঁচাবাজারে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের কাছ থেকে জানলাম, দোকানে আগের চেয়ে অর্ধেক সবজি বিক্রি হচ্ছে। একজন বললেন,Ñ ‘মাইনষেরটে টাকা নাই। কী দিয়া সবজি কেনবে? সবজি বেচাইতে না পারি হামার অবস্থাও খারাপ। হামারও আয় কমি গেইচে।’
চাল বিক্রি কমে গেছে, সবজি বিক্রি কমে গেছে। গাড়ি-বাড়ি, বিলাসী জিনিসপত্র বেচাকেনা কমে যাওয়া আর চাল-সবজি বিক্রি কমে যাওয়া এক কথা নয়। চাল-সবজি বিক্রি কমে যাওয়া মানে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
আগে কেউ চাল নষ্ট করতেন না। যাঁর যতটুকু চাল প্রয়োজন, ততটুকুই কিনতেন। চালের বিকল্প হিসেবে কোনো পণ্য তাঁরা কিনছেন, তা-ও নয়। চাল কম কেনার অর্থ অনেকেই তিন বেলা খাচ্ছেন না কিংবা কম খাচ্ছেন। এ কারণে সবজির প্রয়োজন হচ্ছে না।
পার্কের মোড়ে মারুফ মাল্টিমিডিয়া নামে স্টেশনারির দোকানের মালিক মারুফ বলেন, ‘কাগজের দাম বাড়তেই আছে। ফটোকপি করি কোনো টাকা লাভ করার উপায় নাই। মানুষ জরুরি ছাড়া কোনো কিছুই কিনবার আইসে না। বেচাকেনা অর্ধেকে নামছে।’ পাশেই সঙ্গে থাকা একজন শিক্ষক বললেন, তিনিও খুব হিসাব করে সংসার চালাচ্ছেন। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া একজন বেসরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং একজন সরকারি কর্মকর্তা কথা বলছিলেন। তাঁরা দুজনে একমত যে তাঁদের চাকরির শুরুতে যেমন টাকার টানাটানি ছিল, কর্মজীবন শেষে এসেও ওই টানাটানি আছে।
হারুন নামের এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘অভাবে পড়ি অ্যালা কম খাই। রিকশামালিককে আগে দিছি ২০০ টাকা। অ্যালা দেই ৩০০ টাকা। মানুষ রিকশায় আর উঠপার চায় না। কামাই কমি গেইচে।’ রংপুরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন একজন অশীতিপর ব্যক্তি। তিনি বললেন ‘অবস্থা ভালো নোয়ায়। বউ-ছাওয়া, বেটা-নাতি কাঁইয়ো ভালো নাই।’
প্রান্তিক জনপদে কৃষিসামগ্রী পৌঁছাতে ব্যয় বেশি। আবার উৎপাদিত খাদ্যশস্য ঢাকায় পৌঁছাতেও খরচ বেশি। ফলে তাঁদের জন্য টিকে থাকা কঠিন। তাঁদের জন্য সরকারের বিশেষ ভাবনা অত্যন্ত জরুরি। দারিদ্র্যপীড়িত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কথার শেষে তাঁরা বলেছেন, ‘আল্লাহই ভরসা। আর কোনো ভরসা নেই।’ তবে কি তাঁরা রাষ্ট্রের কোনো আনুকূল্য পাবেন না?
আরেক রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর কথাতেও দুঃসহনীয় কষ্টের চিত্র। তিনি বলছিলেন, ‘মাথা ভনভন করি ঘোরে। বসি থাকার উপায় নাই। বসি থাকলেই দুই টাকা আয় কমি যাইবে। মার ওষুধ কেনা নাগে, চাউল-ডাইল সোগ কিনি খাওয়া নাগে। কিস্তির টাকা না দিলে বিপদ। সকাল ১০টা থাকি রাইত ১০টা পর্যন্ত রিকশা চালাই। কোনো কোনো দিন তারও বেশি। খবর নিয়া দ্যাখো বাহে, অবস্থা খুব খারাপ।’
দেশে যখন জ্বালানির দাম বাড়ে, তখন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঢাকা থেকে দূরবর্তী জেলাগুলোর মানুষ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার মানুষেরা কম টাকায় ঢাকায় আসেন। ওই সব এলাকায় পণ্য আনা-নেওয়ার ব্যয়ও কম। এ কারণে ওই এলাকার সঙ্গে দূরবর্তী অঞ্চলের হিসাব করলে চলবে না। ফলে এসব সংকটের সময় ঢাকার সঙ্গে দূরবর্তী জেলার মানুষেরা দ্রুতই গরিব হয়।
সংকটে গরিব মানুষের ভয়াবহতা বেশি। দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে বাস করে অনেকেই। দারিদ্র্যসীমার নিচে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের অবস্থা আরও কত খারাপ, তা কল্পনা করাও কঠিন! এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। রংপুর বিভাগে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। করোনার করাল থাবার আগের হিসাব অনুযায়ী প্রায় এক কোটি গরিব মানুষ রংপুর বিভাগেই বাস করে। করোনাকালীন এই সংখ্যা বেড়ে গেছে। জ্বালানির মূল্য বাড়লে এসব মানুষের ওপর চাপ বেশি পড়ে। প্রান্তিক এসব জেলায় সরকারের বিশেষ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
যাঁরা উচ্চবিত্ত, তাঁদের কথা আপাতত বাদ দিলাম। যাঁরা মধ্যবিত্ত, তাঁদেরও টানাটানির দিকেই যেতে হয়েছে। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন অনেকেই। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিণত হচ্ছেন নিম্নবিত্তে।
বিত্তহীনেরা হতদরিদ্রে পরিণত হচ্ছেন। হতদরিদ্ররা কি করবেন? কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুরে গত এক বছরে প্রায় সাত-আটবার বন্যা হয়েছে। করোনার সময়ে এ অঞ্চলে নতুন করে অসংখ্য মানুষ বেকারে পরিণত হয়েছেন। এমন বাস্তবতায় নতুন সংকট তাঁরা সামাল দিতে পারবেন না। সরকার অঞ্চলভিত্তিক কিংবা শ্রেণিভিত্তিক অসহায়দের জন্য সংকটকালীন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তারও কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না।
রংপুর জেলার ইতিহাসগ্রন্থে আবদুস সাত্তারের লেখা সূত্রে জানা যায়, ১১৭৬ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় আখিরা নদী কেটে করতোয়া নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয় নৌপথে খাদ্য রংপুরের মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন পর্ব আমাদের শোষিত হওয়ার পর্ব। ব্রিটিশরা এ দেশ শাসন করতে এসেছিল শোষণ করারই জন্য।
তারপরও দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষের পাশে ব্রিটিশরা দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বর্তমান ভয়াবহ সংকটে অসহায়দের পাশে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে এবং জ্বালানি দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সমালোচনা আছে। কিন্তু বিত্তহীন অতিদরিদ্রদের নিয়ে কথা হচ্ছে খুব কম।
প্রান্তিক জনপদে কৃষিসামগ্রী পৌঁছাতে ব্যয় বেশি। আবার উৎপাদিত খাদ্যশস্য ঢাকায় পৌঁছাতেও খরচ বেশি। ফলে তাঁদের জন্য টিকে থাকা কঠিন। তাঁদের জন্য সরকারের বিশেষ ভাবনা অত্যন্ত জরুরি। দারিদ্র্যপীড়িত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কথার শেষে তাঁরা বলেছেন, ‘আল্লাহই ভরসা। আর কোনো ভরসা নেই।’ তবে কি তাঁরা রাষ্ট্রের কোনো আনুকূল্য পাবেন না?
তুহিন ওয়াদুদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক [email protected]