পিতৃপরিচয়হীন শব্দটি কি পিতৃতান্ত্রিক নয়

শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ফরম পূরণে মাকে আইনগত অভিভাবক হিসেবে যুক্ত করার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাবা, আইনগত অভিভাবক ও মা যে কেউ অভিভাবক হতে পারবেন। আগে মায়ের কোনো অধিকার ছিল না। প্রশ্ন জাগে ‘আইনগত অভিভাবক’ কারা?

অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ অনুযায়ী মা কখনোই সন্তানদের অভিভাবক নন, মা কেবল হেফাজতকারী। বাবা, দাদা বা তাদের উইলে উল্লেখিত ব্যক্তি আসল অভিভাবক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফরম পূরণের ক্ষেত্রে কে অভিভাবক হবেন তার উল্লেখ আইনে নেই। সুতরাং আইন অনুযায়ী মা অভিভাবক নন, হেফাজতকারী। নতুন আইনে যেখানে মাকে অভিভাবক পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে।

তবে এ ঐতিহাসিক রায় যখন পাওয়াই গেল, তখন সেটা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়ে জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট, ভিসা, যানবাহন, হল-হোস্টেলে বসবাস, বিভিন্ন পরীক্ষা-প্রশিক্ষণ বা যেকোনো আবেদনপত্র ইত্যাদি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংযুক্ত হলে তা আরও বেশি যুগান্তকারী হতো।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পিতৃপরিচয়হীন শব্দটা নিয়ে। শব্দটির মধ্যে সমস্যা রয়েছে। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, পিতৃপরিচয়হীন সন্তান, যৌনকর্মীদের সন্তান যঁাদের বাবার পরিচয় নেই, তাঁরা শুধু মায়ের নাম দিয়েই ফরম পূরণ করতে পারবেন। পিতৃপরিচয়হীন শব্দটি যেন স্বামী পরিত্যক্ত, অমুকের বিধবা, ধর্ষণের শিকার, কুলটা, তালাকপ্রাপ্ত, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ইত্যাদি মনে করিয়ে দেয়। যে মা অবর্ণনীয় কষ্টে দশ মাস সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, স্তন্যপানে লালন করেন, জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারে লড়াই করেন, তিনি যেন সন্তানের ভালোমন্দ দেখার কেউ নন!

উপার্জনক্ষম হয়েও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন, বৈষম্য, বঞ্চনা, অবহেলা মুখ বুজে মেনে নিতে পারেন না অনেক নারী। এখনো সন্তানের মুখ চেয়ে স্বনির্ভর নারীদের নির্যাতন সহ্য করতে দেখা যায়। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা তাদের শরীরের অংশ সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে যান বা হতে চান।আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীরা যেখানে সন্তানের জন্য পিতার খোরপোষেরও তোয়াক্কা করেন না, সেখানে তাঁর সন্তানকে পিতৃপরিচয়হীন বলা যেতেই পারে। তবে পিতৃত্ব ব্যতিরেকে পিতৃপরিচয় কোনো অর্থ বহন করে না।

একজন একক মা যাঁর বৈধ স্বামী ছিল, যেকোনো কারণেই হোক তাঁদের বিচ্ছেদ হতে পারে, স্বামীও তালাক ঠুকতে পারেন, স্ত্রীও। এখন তঁাদের সন্তানকে হয়তো পিতৃপরিচয়হীন বলা যাবে না কিন্তু যে পিতা সন্তান জন্মের পরপরই বা জন্মের আগেই চম্পট দেন, সে সন্তানের মায়ের কাছে তাঁর পিতৃপরিচয় বাঞ্ছনীয় নয়। সন্তানহীন যে একক পুরুষ (যেমন বলিউডের করণ জোহর) শিশু দত্তক নেন, তিনি তো জৈবিকভাবে ওই শিশুর পিতা নন। কিন্তু পিতৃত্বের যত আবেগ সব তাঁর আছে।

পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব এগুলো যথাক্রমে বক্ষজাত বা গর্ভজাত-এর পরিচয় বহন করে না। এগুলো গুণবাচক শব্দ। জৈবিক পিতা–মাতা না পেয়েও কোনো শিশু তার পালক পিতা–মাতার পিতৃপরিচয় ও মাতৃপরিচয়ে গৌরববোধ করতে পারে। দত্তক নেওয়া অবিবাহিত নারীর (যেমন বলিউডের সুস্মিতা সেন) সন্তানদের পিতৃপরিচয় কীভাবে তুলে ধরা যাবে?

আরও পড়ুন

উপার্জনক্ষম হয়েও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন, বৈষম্য, বঞ্চনা, অবহেলা মুখ বুজে মেনে নিতে পারেন না অনেক নারী। এখনো সন্তানের মুখ চেয়ে স্বনির্ভর নারীদের নির্যাতন সহ্য করতে দেখা যায়। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা তাদের শরীরের অংশ সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে যান বা হতে চান। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীরা যেখানে সন্তানের জন্য পিতার খোরপোষেরও তোয়াক্কা করেন না, সেখানে তাঁর সন্তানকে পিতৃপরিচয়হীন বলা যেতেই পারে। তবে পিতৃত্ব ব্যতিরেকে পিতৃপরিচয় কোনো অর্থ বহন করে না।

একাত্তরে হানাদার বাহিনীর যৌন নির্যাতনে যেসব নারীর সন্তান পিতৃপরিচয় সংকটে পড়েছিল, বঙ্গবন্ধুর পিতৃহৃদয় সেদিন সেসব সন্তানের পিতা হয়ে উঠেছিল। তাই যদি কোনো একক মায়ের সন্তান মায়ের কোনো বন্ধু বা দ্বিতীয় স্বামীতে পিতৃত্বের করুণাধারা প্রত্যক্ষ করে, তবে সেই পুরুষ হেফাজতকারীর মর্যাদা পেতে পারেন কিন্তু অভিভাবক মা-ই।

আরও পড়ুন

আইনটিতে পিতৃপরিচয়হীন শব্দটার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যৌনকর্মীদের জন্য অদ্যাবধি ঠিক আছে। কিন্তু অত্যাচারী স্বামী পরিত্যাগ করা বা স্বামী কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হওয়া একক মা, দত্তক গ্রহীতা নারী, অবিবাহিত মা, ধর্ষণের শিকার মা, যদি কোনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (নারীরূপী) কোনো অনাথ শিশুকে মাতৃস্নেহে মানুষ করেন সেই মা—এদের সন্তানদের জন্য পিতৃপরিচয়হীন শব্দটার কোনো প্রয়োজনই নেই।

শব্দটা মা এবং সন্তান দুজনের জন্যই অপমানজনক। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন সংশোধিত না হওয়া অবধি পিতৃতান্ত্রিক অভিভাবকত্ব ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। এই সন্তোষজনক নতুন আইনের ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয়হীনের পরিবর্তে ‘পিতার অবর্তমানে’ শব্দবন্ধটি মন্দের ভালো।

  • উম্মে মুসলিমা সাহিত্যিক। ইমেইল: [email protected]