উন্নয়নের শহরে সস্তা মৃত্যু ও আমাদের ‘লোকদেখানো’ শোক

টাইলসের ফুটপাতে পড়ে আছে আবুল কালামের নিথর রক্তাক্ত দেহ। তাঁকে হারিয়ে স্ত্রীর কান্না। তাঁর শিশুসন্তান বুঝতেই পারছে না কী সে হারিয়েছে। ২৬ অক্টোবর ২০২৫, রাজধানী ঢাকা।ছবি: সাজিদ হোসেন

সকাল মানে একটা দিনের শুরু। নতুন স্বপ্ন। নতুন সম্ভাবনা। নতুন যাত্রা। আবুল কালাম আজাদ ঢাকা শহরে এসেছিলেন কোন স্বপ্ন নিয়ে? বাড়ি শরীয়তপুর হলেও স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর তখন। ফার্মগেটে টংদোকানে বসে চা খেতে খেতে কোন যাত্রার কথা ভাবছিলেন তিনি। পকেটে ছিল তাঁর পাসপোর্ট। তাঁর কোনো সম্ভাবনার কথাই আমাদের আর জানার সুযোগ নেই। টাইলসের ফুটপাতে লাল রক্তের সঙ্গে গড়িয়ে গেছে তা, যে রক্ত আবুল কালামেরই।

সরি, পাঠক—এমন নির্মম বর্ণনা মানসিকভাবে কারোরই নিতে পারার কথা নয় জানি। নিজের রক্তের ওপর নিথর দেহ নিয়ে প্রাণহীন আবুল কালাম শুয়ে আছেন—এমন দৃশ্য কোনোভাবেই মাথা থেকে সরছে না। আমি নিজেও ফার্মগেটের সেই একই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে টংদোকানের চা খেয়েছি কতবার। আমার মতো অনেকেও।

আবুল কালাম টংদোকান থেকে চা নিয়ে মাত্র কাপে চুমুক দিয়েছেন। কিছু বোঝার আগেই মুহূর্তের মধ্যে মেট্রোরেলের পিলারের একটি ভারী যন্ত্রাংশ ছিটকে এসে তাঁর মাথায় পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু। আচমকা কোনো গুলি এসে তাঁর প্রাণটা কেড়ে নিল যেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই দুনিয়ায় তাঁর জীবনখাতা বন্ধ হয়ে গেল।

আরও পড়ুন

এ শহরের মানুষের মৃত্যু আসলে এমনই সস্তা। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের এ শহরের মানুষের প্রাণটাই সবচেয়ে কম দামি। একটি লোহার রড পড়েও এ শহরে মানুষের মৃত্যু হয়। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ভবনের ওপর থেকে একটি ফুলের টব পড়েও।

আপনাদের নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপুর (দীপু সানা) কথা মনে আছে। অফিস থেকে ফেরার সময় বাচ্চার জন্য মুড়ির মোয়া কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসায়। শান্তিনগর এলাকায় উড়ালসড়ক থেকে আচমকা ইট উড়ে এসে তাঁর মাথায় লাগে। এতেই মৃত্যু।

চব্বিশের জানুয়ারির ঘটনা। তখন তাঁকে নিয়ে লিখেছিলাম: ইট পড়েও এই ‘জাদুর শহরে’ মানুষ মারা যায়! এখনো জানা যায় না, সেই ইট কোত্থেকে কীভাবে উড়ে এল। আমরা শুধু জানি, একটি শিশু তার মাকে হারিয়ে ফেলল চিরতরে। আজ যেভাবে দুইটি শিশু বাবাহারা হলো। শৈশবে আবুল কালাম মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন। এতিম হয়ে অনেক কষ্টে বড় হয়েছিলেন তিনি। তাঁর দুইটি শিশুও আজ এতিম হয়ে গেল।

আবুল কালামের পকেটে পাওয়া যায় একটি পাসপোর্ট। এক সময় তিনি প্রবাসে ছিলেন। পরে দেশে ফিরে ট্রাভেল এজেন্সির কাজে যুক্ত হন। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা, ২৬ অক্টোবর ২০২৫।
ছবি: সাজিদ হোসেন

যানজটের মারি লাগা এই শহরে কত কত উড়ালসড়ক করা হলো, তাতে মারি কমে না, আরও বেড়ে মহামারিই রূপ নেয়। এরপর করা হলো মেট্রোরেল। নাগরিক জীবনে একটু স্বস্তি এনে দিল এ যান।

এই দম বন্ধ হওয়া শহরে মেট্রোরেল কি এক টুকরা আশীর্বাদও নয়! হোক না, আকাশ বন্ধ করে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি খরচে বানানো। ফলে মেট্রোরেল নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্তীয় আবেগেরও শেষ নেই। আজ সেই আবেগে রক্তের দাগ লেগে গেল।

গরিব-ছিন্নমূল-নিম্ন আয়ের মানুষকে বাদ দিলে এ ঢাকা শহরে কে মেট্রোরেলের যাত্রী নয়? যে কারণে আবুল কালামের মৃত্যু আরও বেশি স্পর্শ করে যায় আমাদের, ক্ষুব্ধ করেও তোলে। আমাদের মধ্যবিত্ত মন আতঙ্কিত হয়। নয়তো প্রতিদিন কত আবুল কালাম কত দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেসব মৃত্যু আমাদের স্পর্শও করে না।

আবুল কালামের মৃত্যু কি কাঠামোগত হত্যা নয়? এর জন্য দায়ী কে? এ মৃত্যুর জন্য তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে আবুল কালামের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে? কোটি কোটি টাকা দিলেও একটি প্রাণের মূল্য হয় না জানি। কিন্তু এর জন্য কি কারও কোনো শাস্তি হবে না? নিছক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে চালিয়ে দিলেই দায় সারা হয়ে যাবে?

আবুল কালামের মৃত্যু কোনোভাবে মানতে পারছে না পরিবার। আসলে কীভাবে মেনে নেওয়া যায়! বোধজ্ঞান হারিয়ে এক স্বজন বলছেন, আবুল কালাম তাঁর বাচ্চাদের এতটা ভালোবাসতেন, পৃথিবীর কেউ এমনটা ভালোবাসে না। রাজকীয়ভাবে তাদের লালনপালন করতেন তিনি। আসলে পৃথিবীর সব বাবাদের কাছেই তো তাদের বাচ্চারা রাজপুত্র-রাজকন্যাই। আবুল কালামের বাচ্চারা এতটাই অবুঝ, হায়, এখনো বুঝতেই পারছে না, কী তারা হারিয়েছে! স্ত্রী বলছেন, আজকে বাসা থেকে বের হতে দিতে চাইছিলেন না। জোর করে বের হয়েছেন আবুল কালাম। মৃত্যু আসলে কীভাবে মানুষকে ডেকে নিয়ে যায়!  

উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি দেশ ও দশের ভাগ্য পরিবর্তন। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি দুর্ভাগ্যে পরিণত হয়। উন্নয়ন মানে এখানে অপ-উন্নয়ন। সেটিই তো আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখলাম। সামনেও হয়তো তেমনটি দেখে যেতে হবে।

আজকেই (২৬ অক্টোবর ২০২৫) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় খবর বের হলো, জাইকার অর্থায়নে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। আরও দুটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর খরচই সবচেয়ে বেশি—ভারতের তুলনায় পাঁচ গুণ, এমনকি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের চেয়েও বেশি। নির্মাণব্যয় এতটাই অতিরিক্ত যে মেট্রোরেলের আয়ে ঋণের কিস্তির টাকাও উঠছে না। নির্মাণব্যয় তুলতেই ৫০ বছরের বেশি লেগে যাবে৷ এত বেশি খরচে জাইকাকে দিয়েই কেন এমন মেগাপ্রকল্প করাতে হবে, সেই প্রশ্নও আছে।

আরও পড়ুন
‘এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর খরচই সবচেয়ে বেশি—ভারতের তুলনায় পাঁচ গুণ, এমনকি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের চেয়েও বেশি।’
ছবি: প্রথম আলো

আজ যে যন্ত্রাংশ ছিটকে পড়ে আবুল কালাম মারা গেলেন, সেটির নাম বিয়ারিং প্যাড। মেট্রোরেলের উড়ালপথের ও পিলারের মাঝখানে রাবার ও স্টিলের তৈরি এ বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়, যা ঝাঁকুনি প্রতিরোধের পাশাপাশি স্থাপনাটির সুরক্ষায় কাজ করে।

সেই বিয়ারিং প্যাডের কেনাকাটা নিয়ে ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বণিক বার্তা। প্রতিবেদনটি তখন জানিয়েছিল, মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশের দুটি প্যাকেজের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের মান খারাপ পাওয়া গেছে। বুয়েটের ল্যাব পরীক্ষায় বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এসব বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই। মানোত্তীর্ণ না হওয়ায় নতুন বিয়ারিং প্যাড আমদানি করতে হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে প্রায় আট কিলোমিটার উড়ালপথে সেসব বিয়ারিং প্যাড বসানো হয়ে গেছে।

আমরা জানি না, বসানো হয়ে যাওয়া নিম্নমানের বিয়ারিং প্যাডগুলো খুলে ফেলা হয়েছিল কি না। নতুন করে উন্নত মানের বিয়ারিং প্যাড বসানো হয়েছিল কি না। সেগুলো বুয়েটের ল্যাব পরীক্ষায় যাচাই করা হয়েছিল কি না। অভিযোগ আছে, ত্রুটিপূর্ণ বিয়ারিং প্যাডগুলোই ব্যবহার করা হয়েছিল। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাইয়ের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, গত বছর ফার্মগেটে আজকের ঘটনাস্থলের কাছাকাছিই আরেকটি জায়গায় একইভাবে বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়েছিল। ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। তবে ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এমন দুর্ঘটনা রোধে সে তদন্ত প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে হয় কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না, নয়তো তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয় না। এটাই তো এ দেশের চিরায়ত নিয়ম!  

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিয়ারিং প্যাডটি বসানো হয়েছে মেট্রোর নিরাপদ চলাচল ও স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা নিচে পড়ে মানুষ মারা গেলে তো বলতে হবে এর নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে। মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে দামি জাপানি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাহলে তাঁদের নকশায় কি কোনো ত্রুটি ছিল।

আরও পড়ুন
আবুল কালামের স্ত্রী ও শাশুড়ির আহাজারি। তাঁদের কোলে আবুল কালামের দুই শিশুসন্তান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৬ অক্টোবর ২০২৫।
ছবি: সাজিদ হোসেন

কথা হচ্ছে, বিশ্বের উন্নত দেশের তুলনায় বেশি খরচে বানানো মেট্রোরেলের যন্ত্রাংশ কেনাকাটা নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে। কেন সবচেয়ে দামি বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে নকশায় ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাহলে এত টাকা কিসের পেছনে খরচ হলো? এ টাকা তো এ দেশের জনগণেরই। যে আবুল কালামদের টাকায় এ দেশের উন্নয়ন হয়, সেই আবুল কালামদেরই কেন মরতে হয় এসব উন্নয়নের নিচে চাপা পড়ে?

আবুল কালামের মৃত্যু কি কাঠামোগত হত্যা নয়? এর জন্য দায়ী কে? আবুল কালামের মৃত্যুর জন্য তাঁর পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার। কোটি কোটি টাকা দিলেও একটি প্রাণের মূল্য হয় না জানি। তাই বলে হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত মেট্রোরেলের বলি হওয়া একটা প্রাণের মূল্য মাত্র ৫ লাখ টাকা! তাছাড়া ক্ষতিপূরণ দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে? এর জন্য কি কারও কোনো শাস্তি হবে না? নিছক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে চালিয়ে দিলেই দায় সারা হয়ে যাবে?

জানাজার জন্য আবুল কালামের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল নারায়ণগঞ্জে। দিনের শুরুতে ঘর থেকে বের হয়ে একটা তরতাজা মানুষ, দিন শেষে ফিরে যাচ্ছেন প্রাণহীন লাশ হয়ে।

ফ্রিজার ভ্যানে স্বামীর মৃতদেহের পাশে বসে শোকে কাতর আবুল কালামের সদ্য বিধবা স্ত্রী আইরিন আক্তার সংবাদমাধ্যমকে ফোনে বলছেন: ‘এটি সাধারণ কোনো মৃত্যু নয়। এটা হত্যার চেয়েও বেশি। এখানে কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা স্পষ্ট। ক্ষতিপূরণ তো আমাদের ব্যথা ভুলিয়ে দেবে না বা তাকে ফিরিয়েও আনবে না। সে তো আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে, আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া চাই। আমি বিচার চাই।’

আইরিন আক্তার কি আদৌ বিচার পাবেন? আমরা কি জানতে পারব, কারা প্রকল্পের হর্তাকর্তা ছিলেন, কারা ঠিকাদার বা কারা পরামর্শক ছিলেন, কারা মেট্রোরেলের ওই জায়গার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন, কাদের অবহেলা ছিল? কারা প্রকল্পের ওই অংশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? নকশায় ত্রুটি হয়ে থাকলে কারা করেছেন? কেনাকাটা অনিয়ম হয়ে থাকলে কারা করেছেন? কাদের পকেট ফোলাতে অতিরিক্ত খরচে এ মেট্রোরেল বানানো হলো? সেই ‘গুণপুত্ররা’ কি অধরাই থেকে যাবেন? হ্যাঁ, সেটিই তো হওয়ার কথা। কারণ, এটিও এ দেশের চিরায়ত নিয়ম। আর আমরা আরেকজন আবুল কালামের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে থাকব কিংবা নিজেরাও হতে পারি সেই আবুল কালাম।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]

    *মতামত লেখকের নিজস্ব