হুবহু চুরি ও মেধাস্বত্ব অস্বীকার কি আমাদের সংস্কৃতি

যাঁরা ঠিক করেন পাঠ্যবই কেমন হবে, তাঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বেশ নামী ও জ্ঞানী। এবার তাঁরা বেশ আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আক্রমণের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে বাদ যায়নি তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনও। আমার পরিচিত অনেককেই দেখেছি তাঁদের সারা জীবনের অর্জিত সব বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আক্রমণের তীব্রতা দেখে মনে হতে পারে বাংলাদেশের তাবৎ সমস্যার মূলে প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবই। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, বাচ্চারা কী শিখবে? এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে আমাদের শিশুরা কী শিখবে?

শিক্ষা বলতে মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই বুঝি। প্রতিষ্ঠান মানে বিদ্যালয়। মানে শিশুদের ঠিকঠাক বেড়ে উঠতে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক। আসলেই কি তাই? এই প্রশ্নের উত্তরে স্টিভেন লেভিট ও স্টিফেন জে ডুবনারের তাঁদের ‘থিংক লাইক আ ফ্রিক’ বইয়ে অসাধারণ একটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, একটি শিশু তার জেগে থাকা মোট সময়ের মাত্র ২২ শতাংশ বিদ্যালয়ে ব্যয় করে। দিনের হিসাবে তা বছরে ১৮০ দিন। ঘণ্টার হিসাবে প্রতিদিন প্রায় সাত ঘণ্টা। শৈশবের বাকি সময়টা তারা পার করে মা-বাবার সঙ্গে। তাহলে শিশুকে ঠিকঠাক মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি?

একজন শিক্ষককে তাঁর পেশাগত কারণেই বিভিন্ন রকমের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। নিতে হয় চারিত্রিক সনদ। কিন্তু মা–বাবা হতে গেলে এসবের কিছুই কি করতে হয়? কোনো যোগ্যতা কিংবা লাইসেন্স কি প্রয়োজন পড়ে? লেভিট ও ডুবনার তাই সরাসরি বলেছেন, যদি আপনি দেখেন কোনো আমেরিকান শিশু ভালো করছে না, তবে আপনার সেই শিশুর মা-বাবাকে নিয়ে বেশি কথা বলা উচিত। বিদ্যালয় নিয়ে নয়। বিদ্যালয় থেকে আমাদের চাওয়ার সীমা থাকা উচিত। তবে কি বিদ্যালয়গুলোতে কোনো সমস্যা নেই? আছে। কিন্তু সেই সমস্যা সম্বন্ধে আমরা কতটা জানি?

আরও পড়ুন

এখানে লেভিট ও ডুবনার থেকে ধার করে আরও একটা উদাহরণ দিই। তিনজন অর্থনীতিবিদ মিলে চীনের ‘গানজু’ নামের দরিদ্র একটি প্রদেশে একটি গবেষণাধর্মী নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কাজটির জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির শিশুদের। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার শিশু। এদের ভেতর অনেকেরই চশমার প্রয়োজন। কিন্তু চশমা ছিল মাত্র ৫৯ জনের। বাচ্চাদের দুই দলে ভাগ করা হলো। এক দলকে বিশ্বব্যাংকের ফান্ড থেকে পাওয়া অর্থ খরচ করে দেওয়া হলো ১৫ ডলারের চশমা। আরেক দলকে কিছুই দেওয়া হলো না। এক বছর পর দেখা গেল চশমা পরা দল চশমা না পরা দলের চেয়ে অঙ্ক শিখেছে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। লেভিট ও ডুবনার সঙ্গে আমিও গলা মিলিয়ে বলতে চাই, চশমাই হয়তো সব সমস্যার সমাধান না। কিন্তু আপনি যখন কোনো বড় সমস্যা নিয়ে ভাববেন, তখন চশমার মতো ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো ভুল না করাটাই শ্রেয়।

আমি গবেষণার কথা বললাম। সঙ্গে সমস্যারও। এই সমস্যার সমাধানের জন্য যে গবেষণা দরকার, তা কোথায় হবে? কে করবেন? প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? না। তবে কারা করবেন? প্রশ্নটা সোজা। উত্তরটাও তাই। কিন্তু উত্তরটা সহজ হওয়ার পাশাপাশি হৃদয়বিদারক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী গবেষণা হয়? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কি জানেন ‘একাডেমিক রাইটিং’ কী? এ–সংক্রান্ত কোনো পাঠ কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ‘একাডেমিক রাইটিং’ জ্ঞান অনেকটা প্রাথমিকের অক্ষরজ্ঞানের সমান। মেধাস্বত্বের গুরুত্ব বুঝতে না পারলে এবং তার ছাপ ঠিকমতো নিজের গবেষণায় রাখতে না পারলে কিছুতেই তিনি স্নাতক হতে পারবেন না। কিন্তু আমরা কি এই সত্যের খুব কাছে?

এই প্রশ্নের উত্তর আমি কিছু উদাহরণের মাধ্যমে দিতে চাই। সাদাত হাসান মান্টো উপমহাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর বুকে একজন নামকরা গল্পকার। ১৯৪৭-এর ভারতভাগের কারণে তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশভাগ নিয়ে মান্টোর ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যের এক অনন্য অলংকার।

তাঁর একটা গল্প ছিল এমন—

‘গল্পের নাম কেরামতি

লুট করা মাল উদ্ধার করার জন্য পুলিশ তল্লাশি শুরু করল।

লোকজন ভয় পেয়ে লুট করা মাল বাইরে ফেলে আসতে লাগল। কেউ কেউ তো পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের মালপত্রও বাইরে ফেলে দিল।

এর মধ্যে একজন খুব ঝামেলায় পড়ে গেল। তার কাছে মুদিদোকান থেকে লুট করে আনা দুই বস্তা চিনি ছিল। এর মধ্যে এক বস্তা সে রাতের অন্ধকারে কোনোরকমে পাশের কুয়ায় ফেলে দিল, কিন্তু দ্বিতীয় বস্তা ফেলতে গিয়ে নিজেও বস্তার সঙ্গে কুয়ায় পড়ল।

শব্দ শুনে লোকজন ঘুম থেকে উঠে এল। কুয়ায় দড়ি ফেলা হলো। দুজন জোয়ান ছেলে কুয়ায় নামল। লোকটাকে তুলে আনা হলো। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরে সে মরে গেল।

এর পরদিন যখন লোকজন কুয়া থেকে জল তুলল, দেখল কুয়ার জল মিষ্টি!

সেই রাতেই ওই লোকের কবরে প্রদীপ জ্বলা শুরু হলো।’

(কালো সীমানা। সাদাত হাসান মান্টো। মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: জাভেদ হুসেন)

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে একটি নাটক প্রচারিত হয়েছিল। নাটকের পরিচালক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। আমি নাম বলতে চাই না। নাটকের বেশ কিছু চরিত্রও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। নামীদামি অভিনয়শিল্পী। নাটকের গল্পটা সংক্ষেপে এমন—

চিনিভর্তি ট্রাক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে একটি বড় জলাশয়ে পড়ে। স্থানীয় একজন মৌলভির দাবি ট্রাকে মানুষ ছিল। তিনি লাশের খোঁজ চান। অন্যদিকে স্থানীয় মানুষ আবিষ্কার করেন জলাশয়ের জল মিষ্টি। তাঁরা মনে করেন এটা একটা কেরামতি। দলে দলে মানুষ জল সংগ্রহ করবার জন্য লাইন ধরেন।

মান্টোর গল্পের সঙ্গে এই নাটকের গল্পের কি কোনো মিল আছে? কিন্তু নাটকের ভগ্নাংশের কোথাও মান্টোর নামটি পর্যন্ত নেই। গল্পের মূল ভাবনা, রচনা এবং পরিচালনা সবই সেই স্বনামধন্য পরিচালকের।

এই রকম অন্যের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো কাজ করাটা দোষের নয়। কিন্তু চিন্তাটা যে নিজের নয়, সেটা স্বীকার না করাটাই দোষের। প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় একে বলে প্লেজারিজম। বাংলায় কুম্ভীলকবৃত্তি বা চুরি। আমরা যারা দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছি, তারা সবাই প্লেজারিজমের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে পরিচিত। আপনি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাজই জমা দেন না কেন, তা টার্নিটিন নামের একটি সফটওয়্যার দিয়ে চেক করা হয়। আর সেই সফটওয়্যার মোটামুটি জানিয়ে দেবে লেখার কোন অংশ কোথা হতে নেওয়া। লেখার কতটুকু মৌলিক এবং কতটুকু কুম্ভীলকবৃত্তি অনুসরণ করে লেখা। আমাদের সরকারি অর্থায়নে চলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর চল খুব একটা নেই। তাই দেশের বাইরে পড়তে গিয়ে আমাদের গলদঘর্ম হতে হয়। অনেককে হারাতে হয়েছে ছাত্রত্ব। আমরা চুরি এবং মৌলিক চিন্তার পার্থক্য করতে পারি না। অথচ এই শিক্ষা জ্ঞানার্জনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

নৈতিকতা ও সততার সবচেয়ে বেশি শিক্ষা দেওয়া হয় ছোটবেলায়। সকালে উঠিয়ে শিশুদের একমাত্র কাজ, মনে মনে বলা সারা দিন যেন তারা ভালোভাবে চলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নেওয়া কোনো শিক্ষার্থীকে এ রকম নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় না। বিসিএস দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দেশ গড়বার কাজে যোগ দেবেন, তাঁর ‘আমার পণ’ কে লিখেছেন, সেই তথ্য জানা থাকলেই কাজ চলে যায়। আমরা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের বইগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি। কারণ, এই বইগুলো নিয়ে কিছু একটা মতামত প্রকাশ করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ হওয়া কোনো গবেষণাপত্র কতটা মৌলিক বা যৌগিক, তা নিয়ে মতামত প্রকাশ যথেষ্ট শ্রমসাপেক্ষ। অনেক বেশি রাজনৈতিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্ররা কী শিখছেন এবং শিক্ষকেরা কী শেখাচ্ছেন, সেখানে আমাদের কতটা মনোযোগ? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তো আমরা প্রাথমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি চিনি। তাঁদের অনেককেই আমরা টেলিভিশন টক শোতে নিয়মিত দেখে থাকি। শিক্ষকেরা তাঁদের শ্রেণিকক্ষে প্রতিদিন যে ক্লাস লেকচার দিচ্ছেন, তার কতটা মৌলিক? মৌলিক না হলে ওনার জ্ঞানের উৎস কোথায়, এটা কি ওনারা ছাত্রদের জানাচ্ছেন? এটা তো একটা সংস্কৃতির মতো। এই সংস্কৃতির কি তাঁরা চর্চা করছেন। মেধাস্বত্বর গুরুত্ব কি আমরা বুঝতে পারছি? বাজার থেকে আমরা যখন কোনো অনুবাদগ্রন্থ কিনি, কখনো কি যাচাই করি অনুবাদক এই গ্রন্থের অনুবাদের জন্য মূল লেখকের অনুমতি নিয়েছেন কি না? এই বিষয়ে নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলতে পারি।

ট্রাকের টুলবক্সের গায়ে একটি কথা প্রায়ই লেখা থাকে। ‘না দেখিলে চুরি, দেখিলে মশকারি।’ মানে অন্যের টুলবক্স থেকে এটা–সেটা মালিকের চোখের আড়ালে সরিয়ে ফেললে তা চুরি। কিন্তু চোখের সামনে এই সরানোর কাজটা ধরা পড়লেই চোর দাবি করেন, তিনি এটা মজার ছলে নিচ্ছিলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে তথ্য সূত্র হিসেবে আমরা কি দেখিনি ‘ইন্টারনেট’-এর নাম? রোমাঞ্চ উপন্যাসের গায়ে কি দেখিনি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা? অন্যের মতামত কি চালিয়ে দিইনি নিজের মত বলে?

কুম্ভীলকবৃত্তি এবং মেধাস্বত্ব অস্বীকার করা কি আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠছে?

মেধাস্বত্ব স্বীকার করা। দেওয়া। পাওয়া। এর সবই একটা সংস্কৃতির অংশ। এ বিষয় নিয়ে চুরি তো দূরের কথা, মশকারি করবারও কোনো সুযোগ নেই।

  • রিনভী তুষার লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]