‘রেইনকোট’ পরা মোতালেবদের যদি সবখানে দেখা যেত!

মোতালেব শিকদার

‘রেইনকোট’ শব্দটিই বলে দেয় জিনিসটা বঙ্গভূমির বাইরের। তবে ‍বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বেশ কার্যকর এই পোশাক শহুরে মানুষের কাছে দিনকে দিন ভালোই কদর কাড়ছে। তাই বলে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ কি বৃষ্টি এলে আত্মসমর্পণ করে? মোটেও না। বৃষ্টির দিনে মাথার ওপর বড় আকারের কচুপাতা, কলাপাতা নিয়ে চলাচল করা মানুষের দেখা এখন হয়তো সেভাবে দেখা পাওয়া যাবে না, কিন্তু প্রকৃতির এমন ‘ছাতার’ ব্যবহার গ্রামাঞ্চলে বহু পুরোনো। কাপড়ের ছাতা তো আছেই। আর বাংলার কৃষকের জীবনজুড়েই তো আছে ‘মাথাল’; বৃষ্টি থেকে বাঁচায়, রোদও ঠেকিয়ে দেয়। মাথায় কাপড় বেঁধে, এমনকি পলিথিন বেঁধে বহু শ্রমজীবী বৃষ্টিবাদলায় তাঁদের শ্রম জারি রাখেন।

কিন্তু রিকশাচালক মোতালেব শিকদার বৃষ্টি থেকে রক্ষায় নেন বেশ ভিন্ন এক ব্যবস্থা। পুরো শরীর পলিথিন দিয়ে এমনভাবে মুড়ে নেন, প্রথম দেখায় আলখাল্লা বলে ভ্রম হয়! আর মাথায় থাকে ক্যাপ। বোঝাই যায়, বৃষ্টির দিনেও শ্রম না দেওয়ার উপায় নেই সত্তর বছর ছোঁয়া শ্রমজীবী মানুষটির।

আরও পড়ুন

বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মোতালেব শিকদারের ‍বৃষ্টিরোধক ব্যবস্থাকে রেইনকোটের ‘বঙ্গীয় সংস্করণ’ বলা যায় বটে, কিন্তু এই রেইনকোটের নিচে তাঁর গরিবি এতটুকু চাপা পড়ে না। বরং এই কিম্ভূত সাজ তাঁকে গরিব হিসেবে আরও প্রকট করে তুলে ধরে; যা চোখে না আটকে যায় না। না বললেও বুঝতে বাকি থাকে না, তাঁর জীবন চলে দৈনিক শ্রমের ভিত্তিতে। আজ কাজ করা নেই তো কাল হাঁড়িতে চাল ফুটবে না। সুতরাং বৃষ্টির সকালে বাঙালির চিরকেলে আলস্য পেয়ে বসলে তাঁর চলে না; কাজ থেকে ডুব দেব কিংবা এমন দিনে ইলিশ-খিচুড়ি হলে বেশ হয়—এমন ভাবনা মনে আনাও যেন পাপ!

তিন দশকের বেশি সময় ঢাকা কাটিয়ে দেওয়া মোতালেব শিকদারের এই ফেসবুকীয় সময়ের ‘দেখনদারি’র সঙ্গে একেবারে যে মোলাকাত হয়নি, তা নিশ্চয়ই নয়। তাঁর রিকশায় সওয়ারি হই ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ ফেসবুকে কদমের শোভা ছড়িয়ে দেওয়া, কাব্যের অর্গল খুলে দেওয়া, ইলিশ-খিচুড়ির মাহাত্ম্য তুলে ধরা আপনি, আমি—আমরাই। জলজট ঠেলে, নোংরা মাড়িয়ে, যানজট পেরিয়ে মোতালেব শিকদাররা আমাদের নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে দেন। আমরা রিকশায় বসে বসে মুঠোফোনে ফেসবুকের আঙিনায় ঢুঁ দিই, লাইক-কমেন্টের হিসাব কষি কিংবা গান শুনি, ভিডিও দেখি, নয়তো মুঠোফোনে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাতেলা ঝাড়ি। মোতালেব শিকদারদের দিকে একদণ্ড তাকানোর ফুরসত কোথায়! এই ‍বৃদ্ধ রিকশাচালকও ‘নোটিশে’ আসতেন না, যদি না তাঁর আলখাল্লার মতো ‘গরিবের রেইনকোট’টি আলাদা করে ‍দৃষ্টি না কাড়ত।

এই বৃষ্টির দিনেও তিনি বেশি ভাড়া চাননি এক টাকাও। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাত বাড়াও’ মনে এল কি? না। বরং মনে হলো, গরিবিতে জীবন আটকে থাকলেও সততাকে সতত ‘মুক্ত বিহঙ্গ’ করেই রেখেছেন মোতালেব শিকদার; আমৃত্যু সেই বিহঙ্গ কোনো শিকলে বাঁধা পড়বে না...। আহা! ‘গরিবের রেইনকোট’ পরা এমন মোতালেব শিকদারদের যদি সবখানে দেখা যেত!

কথায় কথায় জানা গেল, তাঁকে যেহেতু কী বৃষ্টিমুখর কী রোদঝলমল দিন—রোজই রাজপথে রিকশার প্যাডেল ঠেলতে হয়, তাই নিজের মতো করে প্রস্তুতি নেন তিনি। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েন। কোনো কোনো দিন দুপুর গড়ালে হাজারীবাগের ভাড়া বাসায় ফেরেন। দুটো খেয়ে, একটু গড়িয়ে আবার রিকশার সিটে চেপে বসেন।

এই বয়সেও কেন তাঁকে কাজ করেই ভাত জোটাতে হয়? মোতালেব শিকদার বললেন, একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা উচ্চমাধ্যমিকে ভালো না করায় আর পড়েনি। এখন ফুডপান্ডার ‘ডেলিভারি বয়’। বিয়েও করেছে। সে যা আয় করে, তাতে চলে না। বলা চলে, বাপ-বেটা যাঁর যাঁর পরিবারে দেখভাল করেন। পাশাপাশি টিনশেডের ‍দুটি ঘরের ভাড়া আট হাজার টাকা, তাঁরা আধাআধি করে দেন। জিনিসপত্রের দামের কথা নতুন করে আর বলার কিছু নেই। দুই দিন আগে যে পণ্য যে টাকায় কিনেছিলেন, সেটাই আজ তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। সুতরাং ঘরে বসে থাকার উপায় নেই।

আরও পড়ুন

মোতালেব শিকদারের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার ছোট নীলগঞ্জে। তাঁদের যৌবনে, এমনকি এই ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও গ্রামে সেভাবে কোনো কাজকর্ম ছিল না বলে জানালেন। অভাবের সংসারে লেখাপড়া করা হয়নি। তাই গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কয়েক এলাকাবাসীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। বেছে নেন রিকশাচালনা। এর মধ্যে কয়েক দফা ঠাঁই বদল হয়েছে, পেশার বদল আর হয়নি।

এখন আমতলী এলাকায় অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে। অটোরিকশাসহ অনেক যানবাহন চলে। চারদিকে বহু দোকানপাট হচ্ছে। মোতালেব শিকদার আফসোস করে বললেন, এখনকার মতো অবস্থা থাকলে ঢাকায় হয়তো তিনি আসতেন না। সারাটা জীবন রোদ-বৃষ্টি গায়ে মেখে যা আয়রোজগার করেছেন, তা ভাত-কাপড়ের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন শুধু। এরপরও একটা ‘সম্পদ’ অবশ্য করতে পেরেছেন, তা হলো তাঁর রিকশাখানি। এটা বছর দশেক আগে নিজের টাকায় কেনা। তাই ভাড়া দিতে হয় না। শরীর সেভাবে না চলতে চাইলে একটু রয়ে-সয়ে আধবেলা রিকশা টেনে ঘরে ফিরে যেতে পারেন, এই স্বস্তিটুকু আছে। আর? ম্নান হেসে মোতালেব শিকদার বললেন, কারও কাছে হাত পাতেননি কখনো; এখনো পাততে হয় না।

জিগাতলা থেকে বসুন্ধরা মার্কেটের পেছনে রিকশা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০ টাকা বেশি দিতে চাইলে মোতালেব শিকদার ‘লাগবে না’ বলে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন। তখন খেয়াল হলো, এই বৃষ্টির দিনেও তিনি বেশি ভাড়া চাননি এক টাকাও। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাত বাড়াও’ মনে এল কি? না। বরং মনে হলো, গরিবিতে জীবন আটকে থাকলেও সততাকে সতত ‘মুক্ত বিহঙ্গ’ করেই রেখেছেন মোতালেব শিকদার; আমৃত্যু সেই বিহঙ্গ কোনো শিকলে বাঁধা পড়বে না...। আহা! ‘গরিবের রেইনকোট’ পরা এমন মোতালেব শিকদারদের যদি সবখানে দেখা যেত!

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]