ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আমরা যা করতে পারি

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারির ২৯ তারিখের মধ্যে আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশনও আগামী জানুয়ারি মাসের শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। পক্ষান্তরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে অনড়।

এদিকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের যথাযথ পরিবেশ বর্তমানে বিরাজ করছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনকালীন পর্যবেক্ষক প্রেরণ না করার সিদ্ধান্ত এই প্রশ্নকে আরও জোরালো করেছে। কারণ, ইইউ ব্রাসেলসে বসে হালকাভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। তারা একটি প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে প্রেরণ করেছে, যারা গত ৬ থেকে ২৬ জুলাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে সুপারিশ প্রণয়ন করেছে, তার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নির্বাচনী পরিবেশের যথার্থতা নিয়ে এর আগে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা গত মে মাসের ২৪ তারিখে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বিচারকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। সম্প্রতি গণমাধ্যমকেও এর আওতায় আনার কথা বলেছেন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর এর প্রয়োগ নিয়ে অনেকের মনেই অনেক সন্দেহ ছিল। সব সন্দেহের অবসান ঘটাতে এবং বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য যে শুধু কথার কথা নয়, তা প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্র ২২ সেপ্টেম্বর ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরু করেছে বলে ঘোষণা দেয়।

প্রসঙ্গত, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সমতল নির্বাচনী মাঠের অভাবের বিষয়ে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা দেশের ভেতর থেকে অনেক দিন থেকেই সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন। আমরা নাগরিকেরা প্রশাসন, বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কথা বলে আসছি। নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাহীনতার প্রশ্নও আমরা তুলেছি। সর্বোপরি দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসংবলিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী যে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা, তা-ও আমরা জোরালোভাবে বলে আসছি। দুর্ভাগ্যবশত ক্ষমতার রাজনীতিতে বিভোর ব্যক্তিরা আমাদের কথায় কর্ণপাতও করেননি।

পরিশেষে, যাঁরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারেন, তাঁদের সদাচরণের কারণে আমরা যদি আসন্ন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে পারি, তাহলে শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞাই নয়, এর অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরিণতিও এড়াতে পারব বলে আমরা মনে করি। এর ফলে এমনকি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পথও সুগম হতে পারে। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমরা গভীর খাদে পড়ে যেতে পারি।

আপাতদৃষ্টে ইইউর পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণার পরও ক্ষমতাসীনদের টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। অন্তত প্রকাশ্যে তারা বলছে যে বিদেশিদের এসব সিদ্ধান্ত তাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না, যদিও ভেতরে-ভেতরে একটা অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি বিচারকেরাও এই ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করছেন বলেই মনে হয়। আবার অতি উৎসাহী কেউ কেউ বিদেশিদের ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগও করছেন।

আমাদের আশঙ্কা যে ক্ষমতাসীন এবং তাদের সহযোগীদের উদাসীনতা এবং অতি উৎসাহ শুধু অর্বাচীনতারই পরিচায়ক নয়, বরং আত্মঘাতীও। তারা অনুধাবন করতে পারছে না যে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে ইউরোপ-আমেরিকার আগ্রহের অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তারা আমাদের দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন-সহযোগী। বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। ইউরোপ-আমেরিকা আমাদের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তারা আমাদের রেমিট্যান্সেরও বড় উৎস। তাই একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল বাংলাদেশ তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ভূরাজনীতির কারণেও একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তাদের কাম্য।

আরও পড়ুন

উপরন্তু গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন ইউরোপ-আমেরিকার অতি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। বস্তুত এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম স্তম্ভ। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আমাদের র‌্যাব এবং সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টও সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এ ছাড়া ভোটাধিকার আন্তর্জাতিক আইন ও অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা স্বীকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার, এটি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। আর পাকিস্তানিরা আমাদের ভোটাধিকার হরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল বলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের সহায়তায় আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে।

আমরা আরও অনুধাবন করতে পারি না যে হুট করে যুক্তরাষ্ট্র কারও বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগ করেনি। দালিলিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, সব সিদ্ধান্তের জন্য আদালত ও আইনসভার মাধ্যমে তাদের দায়বদ্ধ হতে হয়। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তাদের কিছু করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ যেসব নির্বাচনী কর্মকর্তা, বিচারক, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা গত নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এবারও তা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন এবং অন্যদের তা করার জন্য প্ররোচিত করছেন, তাঁদের জন্য পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে।

এ ছাড়া যাঁরা বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণের এবং যেকোনো উপায়ে একটি একতরফা, বিতর্কিত নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারছেন না যে নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই প্রথমবারের মতো ভিসা নীতি প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। এখন পর্যন্ত মনে হয় যে তাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে তারা পিছপা হবে না।

এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের বিদেশি বন্ধুরা তাঁদের নানা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের একটি বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করছেন, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় গুরুতর গলদ রয়েছে। বস্তুত তাঁরা আমাদের জন্য জেগে ওঠার একটি ঘণ্টাধ্বনি বাজাচ্ছেন। তবে তাঁরা বলে দিচ্ছেন না, কীভাবে সেই গলদ দূর করতে হবে। সেই দায়িত্ব আমাদের।

আরও পড়ুন

তাই আসুন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে, যাঁরা আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাণ দিয়েছিলেন এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কার্যকর এবং একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করি। আর এ আলাপ-আলোচনার লক্ষ্য হতে হবে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, যার সূচনা হবে এমন একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে, যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে এবং আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক করবে।

পরিশেষে, যাঁরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারেন, তাঁদের সদাচরণের কারণে আমরা যদি আসন্ন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে পারি, তাহলে শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞাই নয়, এর অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরিণতিও এড়াতে পারব বলে আমরা মনে করি। এর ফলে এমনকি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পথও সুগম হতে পারে। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমরা গভীর খাদে পড়ে যেতে পারি।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

আরও পড়ুন