অগ্নিকাণ্ডে রাজধানীতে বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেট পুড়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে ‘নাশকতা’ শব্দটি জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছিল। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা বলেছেন, এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তদন্ত করে দেখা হবে। তাঁরা এটুকু বলেই থেমে থাকেননি। এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা কবে কোথায় আগুন লাগিয়েছেন, মানুষ পুড়িয়েছেন, তার পরিসংখ্যানও তুলে ধরেছেন। এর জবাবে বিএনপির নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগের লোকেরাই আগুন লাগিয়েছে।
সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী নাশকতা শব্দের অর্থ ধ্বংস, সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ, অন্তর্ঘাত ইত্যাদি। ইংরেজি স্যাবোটাজ শব্দটি যুদ্ধ, ধর্মঘট, অন্তর্ঘাত, নাশকতা, কূটঘাত, অন্তর্ঘাত করা, কূটঘাত করা; মেশিন, সরঞ্জাম ইত্যাদির ইচ্ছাকৃত ক্ষতি অর্থে ব্যবহার করা হয়।
৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে আগুন লেগে তিন হাজারের মতো দোকান ভস্মীভূত হয়। ১১ দিনের মাথায় নিউ সুপার মার্কেটের তিনতলার ২৫০টি দোকান পুড়ে যায়। এই অগ্নিকাণ্ডে দুই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। এই সময়ে তাঁদের পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তা জরুরি ছিল। সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন সাধ্যমতো সহায়তাও করেছে।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কী করেছে? বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যখন চৌকি পেতে ফের বেচাকেনা শুরু করেছেন, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা নাশকতার সুলুকসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রধান গোলাম কাদের ছাড়া অন্য কোনো দলের শীর্ষ নেতাকে ঘটনাস্থলে যেতে দেখিনি। এমনকি বাম দলের নেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁরা ভাবেন, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙতে না পারলে আগুন সমস্যার সমাধান হবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি আবার অগ্নিসন্ত্রাসের পাঁয়তারা করছে। তিনি মার্কেটগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, সব অগ্নিসন্ত্রাসের হোতা আওয়ামী লীগ। তাঁর অভিযোগ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই আওয়ামী লীগ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতা যদি মনে করে থাকেন, দলের নেতা–কর্মীরা পাহারা দিলেই আগুন লাগা বন্ধ হবে, তাহলে এতদিন তাদের সেখানে পাঠালেন না কেন? দুই দলের আগুন–বিতর্কের পেছনেও আছে আগামী নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক, ঝগড়াবিবাদ, হানাহানি—সবই যেন এ দেশে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে রাজনীতিকেরা একবার সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা যুক্ত করেন, আরেকবার বাতিল করেন। সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু বলেছিলেন, সংসদ চাইলে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডের পেছনে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে, তখন দেখা যাক প্রকৃত অবস্থাটি কী? প্রথম আলো ফায়ার সার্ভিসের বরাতে জানিয়েছে, দেশে আগুন লাগার বড় কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনার ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। (প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল ২০২৩)
ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, আগুনের ঘটনার দ্বিতীয় বড় কারণ বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা। ২০২২ সালে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে এ কারণে। প্রায় ১৪ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে চুলা থেকে। সেটি বৈদ্যুতিক, গ্যাস বা মাটির চুলা হতে পারে। গ্যাস সরবরাহ লাইনও আগুনের ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ। ২০২২ সালে ৩ শতাংশের কিছু বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে ৭১ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। এর বাইরে ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি, খোলা বাতির ব্যবহার, যানবাহনের দুর্ঘটনার আগুন ইত্যাদি অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ। সব মিলিয়ে কারণ পাওয়া গেছে ১৯টি।
বঙ্গবাজারের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্তে উঠে এসেছে আগুনের কারণ, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা অথবা মশা দূর করার জ্বলন্ত কয়েল। ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। তবে মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোক রাত তিনটার দিকে ব্রিজ ভাঙার কাজ করছিলেন। ব্রিজের ওখানে আমাদের কারেন্টের লাইন আছে, সেটা তাঁরা খেয়াল করেননি। ওই লাইনের ওপর বুলডোজার চালানোর সময়ই আগুনের সূত্রপাত হয়।’
ঢাকায় গত দেড় মাসে (১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল) ফায়ার সার্ভিস সাড়া দিয়েছে, এমন অগ্নিদুর্ঘটনা ছিল ১৬টি। এর মধ্যে সাতটির কারণ জানা গেছে। চারটি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। দুটি ঘটনা ঘটে গ্যাসলাইনের মাধ্যমে নির্গত হওয়া গ্যাস জমে থেকে। এসব ঘটনা হলো মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণ। এতে ৩২ জনের মৃত্যু হয়। এর বাইরে রামপুরার একটি ভবনে সিগারেট থেকে আগুন লেগেছিল বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। অনেক সময় দেখা যায়, বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থার সরঞ্জামের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গত রোববার রাতে ঢাকার ওয়ারী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের পর একটি ভবনে আগুন লেগে যায়। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। এর আগে ১ এপ্রিল ওয়ারীর জয়কালী মন্দিরের কাছে সুইপার কলোনিতে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে নাশকতার তথ্য কোথায় পেলেন সরকারি দলের নেতারা? ফায়ার সার্ভিসের তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে আগুন লাগার প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দলের কেউ নাশকতা করলে সরকারের দায়িত্ব তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। সেটি না করে যদি তারা হাওয়ায় তলোয়ার ঘুরাতে থাকে, তাতে আগুনও নিভবে না, কারণও জানা যাবে না। এ কথা স্বীকার করতে হবে আমাদের মার্কেটগুলোর অবকাঠামো অন্তত দুর্বল। পরিষেবার লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সরকারের নাশকতা আবিষ্কারের নানা কাহিনি আছে। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে পড়ার দায়ে বিএনপির নেতাদের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আবার বিএনপির আমলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজমিয়া কাহিনি সাজানো হয়েছিল।
গত বছর নিউমার্কেটে ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের সময় পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুরের ঘটনার পর প্রথম আলোতে লিখেছিলাম, ‘মারল ছাত্রলীগ, রিমান্ডে বিএনপি নেতা।’
সেবারে সংঘর্ষের দুই পক্ষই প্রকাশ্য ছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে বের করার চেয়ে বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে পাঠানোকে উত্তম কাজ মনে করেছে। এবারও সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে যেখানে বেরিয়ে এসেছে, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে, সেখানে নাশকতা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের নেতারা।
অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, ঈদের আগে আগুন–বিস্ফোরণ যাই হোক না কেন, এর ভেতরে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা নাশকতা ও ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজেছেন। কিন্তু ঈদের পর ঢাকা শহরে যে গ্যাসের সরবরাহ লাইনের ছিদ্র দিয়ে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় কোনো পক্ষই ষড়যন্ত্র ও নাশকতা খোঁজেননি। ঈদের ছুটিতে নাশকতা ছুটি নিলে সেটা আনন্দেরই খবর বটে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি