যে তিন বিষয়ের সুরাহা ছাড়া ব্যাংক একত্রীকরণ সফল হবে না

বেশ কিছু দিন ধরেই ব্যাংক একত্রীকরণ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে। ব্যাংক একত্রীকরণের বাস্তবতা এবং এ ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় বিবেচনায় রাখা উচিত, তা নিয়ে লিখেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন

ব্যাংক একত্রীকরণ নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাতে বেশ কিছুদিন ধরে একটা ব্যাপক কৌতূহল এবং আলোচনার খোরাক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ব্যবসায়িক কৌশলগত এই রেওয়াজ খুব স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আগে কখনো দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ১০টি পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যাংককে একত্রীকরণ করে ৪টি (সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিণত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের ব্যাংক একত্রীকরণের বিষয়টি জনমনে বিশেষ আলোড়ন তোলেনি। কারণ, ৯ মাস একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মতো একটা বড় অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তী সময়ে অর্জিত বিজয়ের বিহ্বলতায় দেশের মানুষ যেন কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল।

সেই সময়ে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল বলে জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ বিষয়টি নিয়ে তেমন আগ্রহী ছিল না। উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকদের পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানের এই পরিণতি ছিল প্রত্যাশিত।

এই একত্রীকরণের ৩৮ বছর পর ২০১০ সালে আরেকটি ব্যাংক একত্রীকরণের ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্পঋণ সংস্থাকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে রূপান্তরের মাধ্যমে। একীভূত এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের উল্লেখযোগ্য কোনো যোগাযোগ ছিল না বলে এই একত্রীকরণের বিষয়েও বিশেষ কৌতূহল ছিল না তাঁদের মধ্যে।

ওপরে বর্ণিত একত্রীকরণের এই দুটি ঘটনার সঙ্গে বর্তমান সময়ের আলোচিত পদক্ষেপটির পার্থক্য আছে। এটি বোঝার জন্য আমাদের একটু পেছন দিকে ফিরে তাকানো দরকার। দেশে ব্যাংকের আধিক্যের পটভূমিতে কমজোরি বা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে শুরু করে নিদেনপক্ষে প্রায় এক দশক আগে। ২০১৬ সালে বেসরকারি থিংকট্যাংক ‘ঢাকা ফোরাম’ দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরামর্শ দিয়েছিল।

এরপর তৎকালীন সরকারের মেয়াদের শেষভাগে এসে ২০১৮ সালে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত নানান অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে স্বীকার করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক একত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একটা উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ব্যাংক পরিচালকদের সহায়তাও চেয়েছিলেন তিনি। পরের বছর নতুনভাবে সরকার গঠিত হলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মেয়াদের শুরুতেই এ বিষয়ে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু ব্যাংক ভালোভাবে চলতে পারছে না। এসব দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নতুন আইনও করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

সর্বোপরি পদ্মা ব্যাংকে যে রকম অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে, সে রকম যাতে আর কখনো না ঘটে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে একীভূত ব্যাংকগুলোর কোনোটিকে আবারও যাতে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণের পথে হাঁটতে না হয়।

পরপর দুজন অর্থমন্ত্রীর উপলব্ধি ও ঘোষণা এবং বিশেষজ্ঞদের ক্রমাগত পরামর্শের পরও এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চার বছরের বেশি সময় লেগে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এই প্রয়োজনীয় মেরামতি কাজটি শুরু করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন বলা যায়।

ব্যবসা কৌশলের অংশ হিসেবে ইংরেজিতে মার্জার ও অ্যাকুইজিশন (অধিগ্রহণ)—দুটি পরিভাষা প্রায় একসঙ্গে ব্যবহৃত হলেও এই দুটির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

সাধারণ পাঠকদের জন্য জানানো প্রাসঙ্গিক যে একত্রীকরণ (মার্জার) বলতে বোঝায় ব্যবসায়িক কৌশল ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে অধিকতর শক্তিশালী হওয়া, নতুন বাজার দখল করা, পরিচালন ব্যয় কমিয়ে বেশি মুনাফা অর্জন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে চুক্তির মাধ্যমে দুটি প্রতিষ্ঠানের একক মালিকানার অংশ হওয়া। এটি সাধারণত ঘটে দুই প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, যা বিশ্বব্যাপী খুব সাধারণ ও স্বীকৃত একটা ব্যবসায়িক কৌশল।

অন্যদিকে যখন কোনো প্রতিষ্ঠান অন্য একটা প্রতিষ্ঠানের সমুদয় কিংবা অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেয়, সেটিকে অধিগ্রহণ বলা হয়। অধিগৃহীত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারমালিকেরা সম্পূর্ণ মালিকানা ছেড়ে দিতে পারেন, কিংবা কোনো ক্ষেত্রে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানও করতে পারে সংখ্যালঘু অংশীদার হিসেবে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংক একত্রীকরণের বহু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়। তবে সেগুলোর প্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। ভারতের উদাহরণ ধরলে ১৯৬৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে মোট ৩৪টা ব্যাংক একত্রীকরণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসবের মধ্যে বাধ্যতামূলক এবং ঐচ্ছিক উভয় ধরনের একত্রীকরণ আছে।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় ব্যাংক খাতের উন্নয়ন এবং কাঠামোগত সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটা কমিশন গঠিত হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর এবং আলোচিত কমিশন ছিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এম নরসিংহের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে গঠিত ‘নরসিংহ কমিটি’। একই নেতৃত্বে এই কমিটি দ্বিতীয়বার গঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। উভয় কমিটির সুপারিশ ছিল দেশটির ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠিত এবং প্রয়োজনে একীভূত করে বিশ্বমানের ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিভিন্ন সবল ও দুর্বল ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে একত্রীকরণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা।

এই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ২০টি একত্রীকরণের ঘটনায় মোট ২৮টি বিভিন্ন আকার ও প্রকৃতির ব্যাংক অন্য ব্যাংকের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এসব একত্রীকরণের সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছু ছিল বাধ্যতামূলক এবং কিছু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। কোনো ব্যাংক যখনই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়েছে, তখনই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে সেসব ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

এ ধরনের একত্রীকরণের উদ্দেশ্য ছিল জনগণ তথা আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা। নরসিংহ কমিটির সুপারিশে এ কথাও বলা ছিল যে একত্রীকরণ হতে হবে সমকক্ষ ব্যাংকের মধ্যে। দুর্দশায় পড়া ব্যাংক অধিগ্রহণে ভালো ব্যাংককে যাতে জবরদস্তি করা না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল।

তবে কমিটির সুপারিশে ব্যাংক একত্রীকরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হলেও সবল ও দুর্বল ব্যাংক একত্রীকরণের বিষয়ে পরামর্শটা মানা হয়নি বলে বিশ্লেষকদের অভিযোগ রয়েছে। ফলে একত্রীকরণের ফলাফল হয়েছে মিশ্র। গুটিকয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটেছে তার বিপরীত।

এখানে মনে রাখা দরকার, আশির দশকের পর থেকে ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশেও একাধিক কমিশন গঠন ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ খণ্ডিতভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের অনিচ্ছা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল রয়ে গেছে অধরা। উপরন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের বহুমুখী চাপে ব্যাংক খাতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনা যায়নি। ফলে প্রতিকারহীনভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ‘দুর্ঘটনা’ ও অপতৎপরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই বর্তমান পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আরও পড়ুন

এ প্রসঙ্গের অবতারণার মূল কারণ, অতি সম্প্রতি দুটি ‘অসবর্ণ’ ব্যাংকের ত্বরিত ‘একত্রীকরণ’ প্রক্রিয়া। এটা সচেতন মহল এবং ব্যাংকসংশ্লিষ্ট মানুষের মধ্যে যথেষ্ট কৌতূহল ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ, একত্রীকরণের যে পথনির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে, তাতে বেশ কিছু প্রাক্‌-করণীয় বিষয় রয়েছে। এর জন্য রয়েছে প্রশস্ত সময়সীমাও। কারণ, ব্যাংক একত্রীকরণের প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশের সর্বশেষ একত্রীকরণের সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্তিম সময়ে (ডিসেম্বর ২০০৮)। তারপরও সরকারের নির্দেশিত পথে সীমিত নেটওয়ার্কের দুটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে দুই বছর সময় লেগেছিল।

প্রয়োজনের ‘অতিরিক্ত’ ব্যাংকের দেশে একত্রীকরণের বিকল্প নেই। সে কারণে একত্রীকরণের যে পথনির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাতে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, প্রভিশন ঘাটতি, সিআরআর, এসএলআর, তারল্য সংস্থান অনুপাতসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচক ঠিক রাখা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে অনেক ধরনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে গণ্য করা যায়। একই সঙ্গে ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেও একত্রীকরণ প্রক্রিয়ার পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু এর আগে কয়েকটি অপরিহার্য বিষয়ের সুরাহা না করলে এই উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাবে না, বরং দুর্বলতা ছড়িয়ে পড়বে পুরো ব্যাংক খাতে।

প্রথম উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হবে, কোনো খ্যাতিসম্পন্ন নিরপেক্ষ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের প্রকৃতি ও পরিণতি নির্ধারণ এবং ব্যাংকের ‘আর্থিক স্বাস্থ্য’ নিরূপণ করা। জালজালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেওয়া এসব খেলাপি ঋণ ভালো ব্যাংকের ঘাড়ে না চাপিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে লুকিয়ে রাখা বেনামি ঋণের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। অর্থাৎ বেনামি ঋণগ্রহীতার পরিচয় উদ্‌ঘাটন (যা মোটেই কঠিন কাজ নয়) এবং জড়িত কর্মকর্তা ও পরিচালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। এসব ঋণ আদায় না হলে সেই ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে, তার সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ দিতে হবে।

তৃতীয়ত, একত্রীকরণের পর বিভিন্ন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের অদক্ষ জনবলের বেতন-ভাতা, তাদের ভবিষ্যৎ এবং কার্যকাল বিষয়েও একটা যৌক্তিক সমাধান থাকতে হবে।

সর্বোপরি পদ্মা ব্যাংকে যে রকম অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে, সে রকম যাতে আর কখনো না ঘটে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে একীভূত ব্যাংকগুলোর কোনোটিকে আবারও যাতে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণের পথে হাঁটতে না হয়।

  • ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার