১০ ডিসেম্বরকে গুরুত্বপূর্ণ করল কারা?

১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করছে বিএনপি। তার অংশ হিসেবে ২২ নভেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিক্ষোভ সমাবেশে করে তারা। সেখানে মির্জা ফখরুল ইসলাম বক্তব্য দেন।
ছবি: প্রথম আলো

ঘাট থেকে মাঠ; অফিস থেকে চায়ের দোকান—যেখানে যাও, সেখানে ‘আর্জেন্টিনা’, ‘ব্রাজিল’, ‘মেসি’, ‘নেইমার’। সবখানে নামগুলো খইয়ের মতো ফুটছে। এসব নাম আগে থেকেই ব্র্যান্ড ভ্যালু নিয়ে লোকের মাথায় এঁটে ছিল। এখন বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় নামগুলো বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।

এসব নামের মধ্য দিয়ে আরেকটি শব্দবন্ধ কয়েক দিন মানুষের মুখে ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে। সেটা হলো ‘১০ ডিসেম্বর’। ওই দিন ঢাকায় বিএনপির একটি জনসভা হওয়ার কথা। রাজনৈতিক জনসভা এ দেশে আহামরি কোনো বিষয় কখনোই ছিল না। অমুক দল তমুক জায়গায় জনসভা করবে—এটা নিয়ে সরাসরি রাজনীতি না করা লোকের মাথাব্যথা কোনোকালে ছিল না। কিন্তু আচমকা যেন কী হয়েছে। চায়ের দোকান থেকে অফিস আদালতের আড্ডায় ‘আর্জেন্টিনা’, ‘ব্রাজিল’, ‘মেসি’, ‘নেইমার’-এসবের ফাঁকে হুট করে ‘১০ ডিসেম্বর’ ঢুকে পড়ছে।

আরও পড়ুন

‘১০ ডিসেম্বর কী হবে?’ ; ‘১০ ডিসেম্বর আদৌ কি বিএনপি মিটিং করতে পারবে?’ ; ‘১০ ডিসেম্বর নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কি কোনো টেনশন আছে?’ —এই ধরনের প্রশ্ন রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মধ্যে চালাচালি হচ্ছে। অর্থাৎ ‘১০ ডিসেম্বর’-এর একটা ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ দাঁড়িয়ে গেছে। ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ এমনি এমনি দাঁড়ায় না। কেউ না কেউ তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

গত কয়েক দিন ধরে নেতাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, এই জিনিসকে ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে দাঁড় করানোর পেছনে বিএনপির হাত যতটা না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে আওয়ামী লীগের। উভয় দল প্রস্তাবিত ১০ ডিসেম্বরের জনসভা নিয়ে পাল্টাপাল্টি কথার কাদা ছুড়ে যাচ্ছে। সেই কাদা নীরিহ তারিখটার ‘গায়ে’ লেগে তার বিমূর্ত চেহারা পাবলিকের মানসপটে এমনভাবে ভূতের মতো মূর্ত হয়ে উঠছে যে তাকে নিয়ে কথা না বলে কারও উপায় থাকছে না।

বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান কয়েক দিন আগে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। তাঁর কথার মর্মার্থ হিসেবে বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা ওই দিন ঢাকায় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসমাগম ঘটিয়ে সরকারের পতন-আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেবেন। তাঁদের এই কথা যে কথার কথা না, তা প্রমাণ করতে তাঁরা গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে বড় বড় বিভাগীয় শহর এবং জেলায় জনসভা করছেন। সেই সব জনসভায় ‘গামছায় চিড়া-মুড়ি বেঁধে’ বিএনপির কর্মীরা সভার এক-দুই দিন আগেই এসে হাজির হচ্ছেন।

এই অবস্থা এক বছর আগেও কল্পনাতীত ছিল। বিএনপির পক্ষে জনসভা দূরে থাক, একটা বড়সড় মিছিল করাও কঠিন ছিল। বড়জোর তারা ঝটিকা মিছিল করতে পারত। বিএনপির অফিসের সামনেই কোনো নেতাকর্মী দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু আচমকা কী হয়েছে কে জানে, তারা এখন বিশাল বিশাল জনসভা করছে এবং সেসব জনসভায় বিএনপির নেতারা যা বলছেন, তার মোদ্দা কথা দাঁড়ায়, ১০ ডিসেম্বর একটা মারাত্মক কিছু ঘটবে। মানে একটা গণবিপ্লব টাইপের কিছু ঘটবে।

আরও পড়ুন

১০ ডিসেম্বর নিয়ে সরকার নার্ভাস কিনা তা হয়তো তর্কসাপেক্ষ; কিন্তু বিষয়টিকে যে তারা অতি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তা তর্কাতীত। সরকার পক্ষ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বিএনপিকে তারা আর ‘ছাড়’ দেবে না। এমনকি ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে’ খালেদা জিয়াকে ফের জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকিও এসেছে। সরকার বলেছে, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তারা মাঠে থাকবে।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ইতিমধ্যে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাহারায় থাকবেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি সারা দেশে সমাবেশের নামে যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ তৈরির চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক অপতৎপরতার যোগ আছে। টার্গেট কিলিং-সন্ত্রাসসহ তাদের নানা পরিকল্পনা আছে বলেও তিনি মনে করছেন।

আরও পড়ুন

এর আগে বিএনপি বড় ধরনের কোনো সমাবেশ ডাকার পর যা যা ঘটেছে, তার আলোকে ধারণা করা যায়, ১০ ডিসেম্বরের এক দুদিন আগেই বাস ট্রাক মালিক সমিতি এবং লঞ্চ ও নৌযান মালিক সমিতি পরিবহন ধর্মঘট ডাকবে; এর মধ্য দিয়ে সারা দেশ থেকে ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে; বিভিন্ন মামলার আসামি ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির নেতাকর্মী থেকে বিএনপিমনস্কদের বাড়ি যাওয়া আসা শুরু করবে। সর্বোপরি, বিএনপির ‘বিশৃঙ্খলাকারীদের’ ‘শৃঙ্খলার’ মধ্যে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে রাজপথে থাকবেন। তবে ‘শৃঙ্খলা’ রক্ষার এই যুদ্ধ কতটা শান্তি ধরে রাখতে পারবে, সেটা আরেক গুরুতর প্রশ্ন।

‘১০ ডিসেম্বর’-জনমনে গণ-আন্দোলনের যে রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বা ভাষ্য প্রতিহত দাঁড় করাচ্ছে, সম্ভবত তাকে প্রতিহত করতে, অর্থাৎ একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে আওয়ামী লীগ বড় বড় সমাবেশ করছে। সেসব সমাবেশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজির হয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যত জোরে শোরে সভা সমাবেশ করছে ও ১০ ডিসেম্বরের সম্ভাব্য ‘অসারতা’ প্রচার করছে, জনমনে ১০ ডিসেম্বর ততই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী এক বিমূর্ত রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

দুই পক্ষ যদি নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে; অর্থাৎ বিএনপি যদি অনুমতি ছাড়াই পল্টনে সভা করে এবং তাতে সরকারপক্ষ বাধা দেয়, তাহলে একটি বড় ধরনের রক্তারক্তি আমাদের দেখতে হবে। সুতরাং ১০ ডিসেম্বর নিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি উদ্বেগে আছে, তা না। সেই উদ্বেগ ‘আমাদের’, মানে দলনিরপেক্ষ আমজনতারও আছে।

নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশস্থল নিয়ে। বিএনপি গোঁ ধরেছে, তারা নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে। গয়েশ্বর রায় বলেছেন, পুলিশ অনুমতি দিক আর না দিক, তাঁরা নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবেন। এই সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরবেন না। অন্যদিকে, সরকার বলছে, বড়জোর তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে, পল্টনে নয়।

দুই পক্ষ যদি নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে; অর্থাৎ বিএনপি যদি অনুমতি ছাড়াই পল্টনে সভা করে এবং তাতে সরকারপক্ষ বাধা দেয়, তাহলে একটি বড় ধরনের রক্তারক্তি আমাদের দেখতে হবে। সুতরাং ১০ ডিসেম্বর নিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি উদ্বেগে আছে, তা না। সেই উদ্বেগ ‘আমাদের’, মানে দলনিরপেক্ষ আমজনতারও আছে।

ধারণা করি যাঁরা সরকার সমর্থক, তাঁরাও ভাবছেন, ১০ ডিসেম্বর কী হবে? ওই সমাবেশ কি রাজনীতিতে নতুন কোনো বাঁক বদল আনবে? ওই সমাবেশ কি ঠেকানো যাবে? বিরোধী দলের সমর্থকেরা হয়তো ভাবছেন, এই ‘হয় জয়, নয় ক্ষয়’ ধরনের জনসভা কি তাঁরা শেষ পর্যন্ত করতে পারবেন? যদি পারেনও, সেটা কি সংঘাত ছাড়াই হবে? এসব প্রশ্ন দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষের মনেও আছে।

তাই উদ্বিগ্ন জনতার আড্ডায় ‘আর্জেন্টিনা’, ‘ব্রাজিল’, ‘মেসি’, ‘নেইমার’-এর চেয়ে ‘১০ ডিসেম্বর’-এর ‘ফেসভ্যালু’ মোটেও কম না।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]