চীনকে যুক্তরাষ্ট্র হারাতে পারবে না, সেই চেষ্টা করাও ঠিক নয়

এপ্রিল মাসে বেইজিং সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনছবি: রয়টার্স

চীনের বিরুদ্ধে ওঠা চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য উৎপাদন বা ওভার-ক্যাপাসিটির অভিযোগ এখন বিশ্বব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উত্তপ্ত আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

গত এপ্রিলে চীন সফরকালে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘অস্বাভাবিক সরকারি ভর্তুকির বদৌলতে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত সস্তা চীনা পণ্যে যখন বিশ্ববাজার ছেয়ে যাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকান ও অন্যান্য বিদেশি সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, এক দশক আগে ঠিক একই গল্প আমাদের সামনে এসেছিল।

ইয়েলেনের বক্তব্যকে অংশত সঠিক ধরে নিয়ে বলা যায়, চীন ও আমেরিকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের রপ্তানি প্রতিযোগিতাকে দুর্বল করেনি, বরং জোরদার করেছে।

২০২৩ সালে সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে তার ১৪ শতাংশ ছিল চীনের। তার মানে ২০১৭ সালের (অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর আগে) চেয়ে ২০২৩ সালের রপ্তানি ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।

আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ২০২৩ সালে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় ৮২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

আরও পড়ুন

এক দশক আগে চীনে বাণিজ্য উদ্বৃত্তের যে ঘটনা ঘটেছিল, তার পেছনে মূলত চীনা মুদ্রা রেনমিনবির (আরএমবি) অবমূল্যায়ন কাজ করেছিল।

আজকের পরিস্থিতিও কিন্তু অনেকটা একই রকম। আমার গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে ডলারের বিপরীতে আরএমবি ১৬ শতাংশ অবমূল্যায়িত অবস্থায় ছিল। এটি চীনের উচ্চ রপ্তানি ও বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পেছনে কাজ করেছিল।

আমার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পেছনে প্রধান যে কারণটি কাজ করেছে, সেটি হলো গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির হার চীনের তুলনায় ১০ শতাংশ পয়েন্ট বেশি ছিল।

ক্রয়ক্ষমতা-সমতার দিক থেকে ডলারের বিপরীতে আরএমবির মান ১০ শতাংশ বাড়া উচিত ছিল। সেটি তো বাড়েইনি, উল্টো আরএমবির মান কমেছে ১১ শতাংশ। সে হিসেবে ডলারের বিপরীতে আরএমবির প্রকৃত অবমূল্যায়ন হয়েছে ২১ শতাংশ।

২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভের মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় আরএমবির অবমূল্যায়নের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় হলো, চীন সরকার মুদ্রা বিনিময় হারকে নিশানা করে তার অর্থনীতিকে পরিচালনা করছে—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও একমত যে চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ নিয়ে কোনো ধরনের কারসাজি করেনি।

এই ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিকে এক দশক আগের তুলনায় অনেক আলাদা বলে ধরতে হবে। কারণ, সংকটটির মাঝামাঝি সময়ে এসে চীন বেশ সফলভাবে তার মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থা (এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম) সংস্কারের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

আরও পড়ুন

সংস্কারের পরও কেন আরএমবি এখনো অবমূল্যায়িত হচ্ছে, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে।

২০২০ ও ২০২১ সালের বিনিময় ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট, সংক্ষেপে বিওপি) দিকে তাকালে দেখা যাবে, বিদেশ থেকে সরাসরি এবং সিকিউরিটিজ বিনিয়োগ থেকে আসা নিট ক্যাপিটাল ইনফ্লো (এনসিআই) বা অন্তর্মুখী তহবিলের নিট প্রবাহ ৪০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল।

অন্যদিকে ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিদেশে বিনিয়োগ করা তহবিলের নিট প্রবাহ (নিট ক্যাপিটাল আউট ফ্লো বা এনসিও) ৫০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

পুঁজি উচ্চমাত্রায় বাইরে চলে যাওয়ার কারণে চীনের বিশাল বিশাল চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তের পক্ষেও আরএমবির আশানুরূপ মূল্যমান প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

বাণিজ্য ভারসাম্য ঠিক রাখার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনকে অকার্যকর করে তুলেছে। চীনের মূলধন বাইরে যাওয়ার জন্য শুধু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সুদের হারের পরিবর্তনকে দায়ী করা যায় না।

আদতে, চীনা মূলধনের বহিঃপ্রবাহের পেছনে প্রধানত বেশ কিছু অ-অর্থনৈতিক কারণ কাজ করেছে। যেমন চীন বেশ কিছু নীতি নিয়েছে, তা নির্দিষ্ট কিছু শিল্পের ওপর নানা বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীন-আমেরিকান উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র চীনে বিনিয়োগ করার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করে, এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছে।

মার্কিন কংগ্রেস এমন আইন করার বিষয়টিও বিবেচনা করছে, যা চীনে আমেরিকান বিনিয়োগকে আরও সীমিত করে ফেলবে। সব মিলিয়ে এই বিষয়গুলোকে চীনের পুঁজির বহিঃপ্রবাহকে বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে আরএমবির অবমূল্যায়নের মাত্রা বেড়ে গেছে।
আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের এসব নীতির মধ্যে রয়েছে চীনে শিল্পভিত্তিক পুঁজির প্রবাহ সীমিত করা এবং সেখানে ভ্রমণের ঝুঁকিকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো।

মার্কিন কংগ্রেস এমন আইন করার বিষয়টিও বিবেচনা করছে, যা চীনে আমেরিকান বিনিয়োগকে আরও সীমিত করে ফেলবে। সব মিলিয়ে এই বিষয়গুলোকে চীনের পুঁজির বহিঃপ্রবাহকে বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে আরএমবির অবমূল্যায়নের মাত্রা বেড়ে গেছে।

যতক্ষণ চীন-আমেরিকান সম্পর্ক এবড়োখেবড়ো অবস্থায় থাকবে, ততক্ষণ আরএমবির বিনিময় হার সম্ভবত উল্লেখযোগ্যভাবে অবমূল্যায়িত অবস্থায় থাকবে; এর ফলে ইয়েলেনের অভিযোগগুলোর সমাধান করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে মুদ্রার বিনিময় হারকে বিকৃত করা রাজনৈতিক ইস্যুগুলো চীনের পরিষেবা খাতের বিকাশকেও ধীর করে দেবে।

এই সব বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সংকট সমাধানে চীনকে অবশ্যই তার অ-অর্থনৈতিক পদক্ষেপের প্রভাব মূল্যায়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার চীনা স্বার্থবিরোধী নীতিগুলো শিথিল করতে হবে।

● কিয়ুয়ান সু চায়নিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিকসের সিনিয়র ফেলো ও উপপরিচালক

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ