সব দোষ সার্ভারের

বৃষ্টির দিনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশা তো দূরে থাক, কোথাও একটি রিকশাও নেই। তার ওপর বাসায় কোনো খাবার রান্না করা নেই; এই রাতে বাসায় ফিরে খাবেন কী। সমস্যার শেষ এখানে হলেও হতো; পকেটে দুই টাকার দুটি পুরোনো নোট ছাড়া একটি কড়িও নেই।

এত এত সমস্যার পরও মুখে স্বস্তির হাসি ধরে রেখে আপনি অপেক্ষা করছেন ফুটপাতেই। মুঠোফোন চেপে উবার ডেকেছেন; আর তিন মিনিট পরে গাড়ি এসে পৌঁছাবে। ফুডপান্ডায় রাতের খাবারের অর্ডার করে রেখেছেন। আপনি বাসায় গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে খাবারও পৌঁছে যাবে। ক্যাশ টাকা লাগবে না, বিকাশে মূল্য পরিশোধ করে দিয়েছেন। বাসায় ফিরে গরম-গরম খাবার প্লেটে নিয়ে বসে নেটফ্লিক্স কিংবা চরকিতে দেখতে বসবেন পছন্দের টিভি সিরিজ।

এতটুকু পরিষেবা এসে গেছে আমাদের নগরজীবনে। কিন্তু কত ভাগ মানুষ এই সেবাগুলো নিতে পারছেন? এই সেবাগুলো নেওয়ার জন্য কত ভাগ মানুষের কাছে ইন্টারনেট আছে? স্মার্টফোন আছে? মৌলিক অধিকার যে শিক্ষা, অনলাইনে সে শিক্ষার ব্যবস্থা পাওয়ার জন্য কতজন মা-বাবা তাঁর সন্তানের কাছে ইন্টারনেট সংযোগসহ ট্যাব বা ল্যাপটপ দিতে পারছেন?

ডিজিটাল পরিমণ্ডলের সেবা ও পরিষেবাগুলো শুধু যদি একটি নির্দিষ্ট ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়, তাহলে সেটি সৃষ্টি করবে বিভাজন। অনেক দিন ধরে চলমান পরিষেবা যদি সাধারণের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়, যেমন শুধু শহরে সহজলভ্য (ই-কমার্স), প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত (উবার, মোবাইল ব্যাংকিং), আর্থিকভাবে সচ্ছলদের মধ্যে প্রচলিত (বিভিন্ন সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক পরিষেবা), সেটি ধীরে ধীরে বিভাজনকে স্পষ্ট করে তুলবে। আজ হোক, কাল হোক, সেটির ফল সুখকর কিছু হয় না।

আরও পড়ুন
কারিগরি ত্রুটি থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক; কিন্তু সেটি যদি রুটিনমাফিক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে, তবে সেটি আর ত্রুটির পর্যায়ে থাকে না, সেটি হয়ে যায় খামখেয়ালিপনা।

একটি পরিষেবা শুরু করার সময় সবার কথা বিবেচনা করে হয়তো শুরু করা যায় না। কিন্তু শুরু হয়ে যাওয়ার পর, যত দ্রুত সম্ভব সেটিকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নিয়ে আসাটা জরুরি। তার জন্য পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। জিএসএমএ মোবাইল ইকোনমি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর হার যথাক্রমে ৫৫ শতাংশ, ৪৩ শতাংশ ও ৫৪ শতাংশ। কিন্তু স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৪৭ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ এবং ৭৩ শতাংশ।

অর্থাৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যায় আমরা এগিয়ে থাকলেও স্মার্টফোন ব্যবহারে দুটি দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ তিনটিতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৬৩, ৭৩ ও ৮৪ শতাংশে। আমাদের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ আছে ঠিক এখানটাতেই। যে হারে স্মার্টফোনভিত্তিক ডিজিটাল পরিষেবা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই হারে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি না পেলে বেড়েই চলবে ডিজিটাল বিভাজন।

আরও পড়ুন

আবার কিছু ক্ষেত্রে এই বিভাজন সৃষ্টি হয় পরিষেবা ডিজাইন থেকে শুরু করে সেটি প্রদান করার প্রক্রিয়ায় এবং পরবর্তী সময়ে মানসম্মত গ্রাহকসেবা প্রদানে অনীহায়। ডিজিটাল সিস্টেম বা সলিউশন ডিজাইন করার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন অপশন বা বিকল্প উপায় স্পষ্ট না করে শুধু দায়সারাভাবে অ্যাপ বা সাইটে রেখে দেওয়াও এর জন্য দায়ী। একটি ব্যবহারবান্ধব ডিজিটাল সিস্টেম তৈরি হয় যত বেশি সম্ভব বিস্তারিত বা জটিলতা পরিহার করে, যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু সহজভাবে ব্যবহারকারীর কাছে উপস্থাপন করার মাধ্যমে।

বাংলায় প্রচলিত অন্যতম একটি প্রবাদবাক্য হলো ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’। ডিজিটাল দুনিয়ায় সে জায়গাটা দখল করে নিয়েছে ‘সার্ভার’। প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো একটি সেবা পেতে দেরি হলে বা না পেলে কাউকে দেখিয়ে দেওয়া যেত; কী কারণে হচ্ছে না, সেটি উদ্ঘাটন করা যেত।

এখন জানা-অজানা সব ত্রুটির কারণ কিংবা অজুহাতের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘সার্ভার ডাউন’। সাধারণ মানুষের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম সার্ভার। তাদের সব রোষ গিয়ে পড়ছে এই সার্ভারের ওপর। সিম তুলবেন, সার্ভার ডাউন; ফরম জমা দেবেন, সার্ভার ডাউন; টাকা ওঠাবেন, সার্ভার ডাউন। সাধারণ মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে, এই সার্ভারটা কে!

ডিজিটাল পরিমণ্ডলে পরিষেবা না পাওয়াটা (সার্ভিস আনঅ্যাভেইলেবিলিটি) একধরনের সাইবার আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, হ্যাকারদের টার্গেট থাকে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ডিজিটাল পরিষেবাকে অনুপস্থিত (আনঅ্যাভেইলেবল) করে ফেলা।

আরও পড়ুন

অর্থাৎ যে কাজটি সাইবার আক্রমণ করে সম্পন্ন করতে হয়, সেটি আমাদের জন্য হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কখনো কারিগরি ত্রুটিতে, কখনো অজুহাত হিসেবে। কারিগরি ত্রুটি থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক; কিন্তু সেটি যদি রুটিনমাফিক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে, তবে সেটি আর ত্রুটির পর্যায়ে থাকে না, সেটি হয়ে যায় খামখেয়ালিপনা।

  • ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]