সাগরে নৌকা ডুবে মানুষ মরছে, দায় কার

ছোট এই নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা
ছবি: এএফপি

ছোট ছোট নৌযানে করে সাগর পার হয়ে আসতে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকিয়ে দেওয়া প্রশ্নে যুক্তরাজ্য সরকারের ‘স্টপ দ্য বোটস উইক’ বা নৌকা ঠেকানো সপ্তাহ পালনকে সমর্থন করে সংবাদমাধ্যমগুলো কয়েক দিন সংবাদ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর মধ্যেই বিশ্বের ব্যস্ততম নৌপথজুড়ে বিপজ্জনক যাত্রার খবর এসেছে এবং সেখানে শনিবার ভোররাতে নৌকাডুবিতে কমপক্ষে ছয়জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

হালকা নৌযানটিতে গাদাগাদি করে প্রায় ৬০ জন লোক চড়ে বসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিশুরাও ছিল। তারা নিরাপদ জীবনের খোঁজে যুক্তরাজ্যে আসার জন্য মরিয়া হয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করেছিলেন। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের সবাই এবং যাঁদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগই আফগানিস্তান থেকে আসা। তালেবানের খপ্পর থেকে পালিয়ে আমাদের দেশে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা আফগান নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে আমরা যে ব্যর্থ হয়েছি, তা এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

রিফিউজি কাউন্সিলের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাজ্য সরকার আফগান নাগরিক পুনর্বাসন প্রকল্পের অধীনে এ বছর ৫ হাজার জন আফগান নাগরিককে পুনর্বাসন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৪ জনকে পুনর্বাসন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সে তুলনায় গত বছর পুনর্বাসন পাওয়া আফগানের সংখ্যা বেশি ছিল। গত বছর এই সংখ্যা ছিল আট হাজার, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌপথে পালিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছিল।

নৌকায় করে শরণার্থীদের ঠেকানোর বিষয়ে কড়া কথা বলার বিষয়ে অনড় থাকা নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিবি স্টকহোম নামের একটি জাহাজের খোলের পানিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধরা পড়ার পর আমাদের মন্ত্রীরা সেটিতে যাত্রী পরিবহন না করে আরও জলযান নামানোর কথা বলছেন। ৫০০ অভিবাসনপ্রত্যাশী নিয়ে আসার কথা থাকলেও রওনা হলেও মাঝপথে বিবি স্টকহোম যাত্রা বাতিল করেছে।

মন্ত্রীরা শরণার্থী ঠেকানো নিয়ে অনেক কথা বলেন। তাঁরা অনানুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া আলাপে বলেছেন, আশ্রয়লাভের জন্য অপেক্ষারত দেড় লাখের বেশি লোকের ঝুলে থাকা দাপ্তরিক কাজ শেষ করলে তা একটি আকর্ষণকারী অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি আশ্রয়প্রার্থী লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে আশ্রয় ব্যবস্থা যত বেশি কড়া প্রতিকূল হবে, ততই সেটি মানুষকে আশ্রয় প্রার্থনা করা থেকে নিবৃত্ত করবে। এই অভিবাসনপদ্ধতিতে শত্রুতা ভাবকে জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো অভিবাসন পদ্ধতিতে প্রতিকূলতা ও বলপ্রয়োগের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দিলে তা শেষ পর্যন্ত অকার্যকর ও ভয়ানক হয়ে ওঠে।

একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে আশ্রয় ব্যবস্থা যত বেশি কড়া প্রতিকূল হবে, ততই সেটি মানুষকে আশ্রয় প্রার্থনা করা থেকে নিবৃত্ত করবে। এই অভিবাসনপদ্ধতিতে শত্রুতা ভাবকে জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো অভিবাসন পদ্ধতিতে প্রতিকূলতা ও বলপ্রয়োগের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দিলে তা শেষ পর্যন্ত অকার্যকর ও ভয়ানক হয়ে ওঠে।

আমি যখন উল্লেখ করেছিলাম, আশ্রয় মামলার তিন-চতুর্থাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রাথমিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আবেদনকারীকে যুক্তরাজ্যে থাকতে দেওয়া হবে কি না, সে রায় দেওয়া হয়। তখন আমাকে বলা হয়েছিল, তাঁরা যদি ‘সত্যিকারের শরণার্থী’ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের দালাল ও মানব পাচারকারীদের হাতে টাকাপয়সা দিয়ে বিপদসংকুল পথে আসার কথা নয়। তাঁদের নিয়মানুযায়ী শরণার্থীশিবিরে ওঠার কথা এবং
জাতিসংঘের মাধ্যমে সেখান থেকে যুক্তরাজ্য বা অন্য দেশে নেওয়ার কথা।

আরও পড়ুন

আমি দেখেছি, যাঁরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকাযোগে চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসেন, তাঁদের প্রথমেই আইন ভঙ্গকারী অপরাধী হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং শরণার্থী মর্যাদা দিতে চায় না।

এই ধারণা আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিকদের মাথায় পর্যন্ত ঢুকে গেছে। কিন্তু এটি মানবতার প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার ঠুনকো অজুহাত মাত্র।

কিন্তু তাঁদের অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, আমরা আসলে তাঁদের জন্য কতটুকু করতে পেরেছি।

 দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  •  এনভার সলোমন রিফিউজি কাউন্সিল-এর প্রধান নির্বাহী