মিসরে তৃতীয়বার ক্ষমতায় বসতে সিসি যে কৌশল নিয়েছেন

এক দশক ধরে লৌহদৃঢ়মুষ্ঠিতে শাসন চালানো আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবার অবধারিতভাবে জয়ী হবেন।এএফপি

মিসরে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চমক ঘটার সম্ভাবনা নেই। এক দশক ধরে লৌহদৃঢ়মুষ্ঠিতে শাসন চালানো ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ছায়াও পিছে মুছে দেওয়া আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিই অবধারিতভাবে জয়ী হবেন।

সিসি এত দিন প্রথাগত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নযন্ত্র (সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা) ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা সংহত করেছিলেন। কিন্তু এবার নতুন একটি অনিয়মিত বাহিনী সিসির তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

অক্টোবর মাসে সিসি তৃতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় আয়োজনে রাজধানী কায়রো ও অন্যান্য শহরগুলোতে এক দশক ধরে শাসন চালানো এই স্বৈরশাসকের সমর্থনে বড় বড় সমাবেশ হয়।

আরও পড়ুন

অন্য যেকোনো প্রার্থীর সমর্থনে একই ধরনের সমাবেশ ও মিছিল করতে গেলে তারা অবধারিতভাবেই দমন–পীড়নের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে সিসির সমর্থনে মিছিল-সমাবেশগুলোতে সমর্থকেরা পুলিশ ও বেসামরিক আধা সামরিক বাহিনী ফ্যালকন গ্রুপের সদস্যদের কড়া প্রহরায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মিসরের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা কোম্পানি ফ্যালকন। গত সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানিটি চুপিসারে অপরাধজগতের বস সাবরি নাকনওকের কাছে ফালকনকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। হোসনি মোবারকের আমলে নাকনওক ‘আর্মি অব থাগস’ (ঠগি বাহিনী) পরিচালনা করতেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সদ্য বিলুপ্ত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে বিরোধীদের ওপর আক্রমণ করে নির্বাচনে কারচুপি করার কাজে ‘ঠগি বাহিনীকে’ ব্যবহার করত।

সিসিসহ প্রভাবশালীদের সঙ্গে দহরমমহরম থাকা একটি কোম্পানি কীভাবে এ রকম আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ল? এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাপূর্ণ। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে নাকনাওক ফ্যালকন কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তার ‘ঠগি বাহিনী’কে আইনি কাঠামোর ঘেরাটোপে আনার মোক্ষম সুযোগ পেলেন। কিন্তু সময় ও উদ্দেশ্য—এই দুই কারণে এ নিয়ে আরও বেশি প্রশ্ন উঠছে।

নাকনওক তার অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছে। তাঁর প্রাসাদসম বাড়িতে মেশিনগান এবং নানা রকম অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলেছেন। সেখানে তিনি খাঁচায় সিংহ ও অন্য প্রাণী পোষেন। তাঁর সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন অংশের সেলিব্রিটি ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের ছবি নিয়মিত ট্যাবলয়েড পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়।

নাকনওক ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কয়েকটি মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক রাখার অভিযোগও ছিল। ২০১৪ সালে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দিয়েছিল। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট সিসির সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে তিনি মুক্ত হন।

বেসামরিক নিরাপত্তা সংস্থা ফ্যালকন গ্রুপের পরিচিতি খুব সামান্যই ছিল। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি খাতের কোম্পানিটি খুব ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে। প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের নয়া-উদারীকরণ নীতি মিসরের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের বিকাশের ধারা সূচিত করেছিল। এর ফলেই ফ্যালকানের মতো কোম্পানি বিকাশের সুযোগ হয়েছিল। সে সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরিতার অবসান হওয়ায় সেনাবাহিনী ছোট করে ফেলা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া বিপুলসংখ্যক সাবেক সেনাসদস্য কাজের সুযোগ খুঁজছিলেন। এ বাস্তবতায় ব্যক্তিমালিকানাধীন নিরাপত্তা সংস্থার বিকাশ হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে মিসরে এ ধরনের বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৪০০-৫০০। সেসব কোম্পানিতে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো লোকবল কাজ করত।

একই বছর ফ্যালকন গ্রুপ সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। সে সময় সিসির নির্বাচনী প্রচারণায় নিরাপত্তা দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল তারা। এরপর মিসরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে তাদের দমনের নিরাপত্তার জন্য ফ্যালকন গ্রুপকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

ফ্যালকনের সে সময়কার প্রধান নির্বাহীকে শরিফ খালেদকে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে সাবেক সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। যাহোক, এ বিষয়ে বারবার তিনি বলেছিলেন এটা ‘গুজব’।

সব ক্ষেত্রেই ফ্যালকন গ্রুপকে মিসরের সেনা গোয়েন্দাদের একটি জায়গা হিসেবে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় সব কটি নিপীড়ক সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কর্মস্থল এই কোম্পানিটি। শুরুতে ২০০ জনবল নিয়ে গড়ে উঠলেও ২০১১ সালের বিদ্রোহের সময় ফ্যালকনের জনবল বেড়ে ছয় হাজারে পৌঁছেছিল। বিদ্রোহের সময় নিম্নস্তরের কর্মকর্তারা কাজের পরিবেশ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

মিসরে ২০১৩ সালের অভ্যুত্থানের পর ফ্যালকনের জনবল বাড়তে শুরু করে। ২০১৭ সাল গ্রুপটির জনবল বেড়ে ২২ হাজার হয়। দেশের ২৮টি প্রদেশে তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদ ও  ‘বেআইনি কর্মকাণ্ড’ দমন করতে পুলিশকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ফ্যালকন ‘র‌্যাপিড ইন্টারভেনশন ফোর্স’ গড়ে তোলে। এ ছাড়া ফ্যালকনই একমাত্র কোম্পানি, যাদের পেলেট রাইফেল ব্যবহারের লাইসেন্স দিয়েছে।

ফ্যালকনের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ কোম্পানিটি মিসরের ১২০০-এর বেশি স্থানে এই গ্রুপটি নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে নয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর, ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল এবং এমনকি তাহরির স্কয়ারও রয়েছে। যদিও পরে ওয়েবসাইট থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়।

দমন–পীড়নের ক্ষেত্রে ফ্যালকনের কর্মীরা কুখ্যাতি অর্জন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য তাদের এই কুখ্যাতি। ব্যাপক দমন–পীড়নের কারণে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি এসে ছাত্র বিক্ষোভ তার তেজ হারাতে শুরু করে। ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্র বিক্ষোভ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়।

২০১৭ সালে খালিদ বলেছিলেন, তার কোম্পানি বেসরকারি নিরাপত্তা বাজারের ৬২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বাজারে এই একক আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও ফ্যালকন গ্রুপ তার ব্যবসার দিশা হারিয়েছে। খবরে জানা যাচ্ছে, নাকনওক মাত্র ৩০ লাখ মিসরীয় পাউন্ডের বিনিময়ে কোম্পানিটি কিনে নিয়েছে। কোম্পানিটির ঋণের বোঝা এখন ১ কোটি ২০ লাখ মিসরীয় পাউন্ড।

সিসিসহ প্রভাবশালীদের সঙ্গে দহরমমহরম থাকা একটি কোম্পানি কীভাবে এ রকম আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ল? এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাপূর্ণ। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে নাকনাওক ফ্যালকন কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তার ‘ঠগি বাহিনী’কে আইনি কাঠামোর ঘেরাটোপে আনার মোক্ষম সুযোগ পেলেন। কিন্তু সময় ও উদ্দেশ্য—এই দুই কারণে এ নিয়ে আরও বেশি প্রশ্ন উঠছে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রকৃতপক্ষে ফ্যালকন নির্বাচনের পরেই সিসির দমনপীড়নের আদর্শ হাতিয়ার হয়ে উঠবে।

  • হোসাম এল-হামালয় সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী। মিসরের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থা বিষয়ে গবেষক
    মিডল-ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত