যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের চাপ যেভাবে সামলাচ্ছে মিসর

গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে কায়রোতে বিক্ষোভ
ছবি: এএফপি

একই আরব জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের কারণে ফিলিস্তিন বিষয়ে মিসরীয়দের সমর্থন দেওয়ার ইতিহাসটা দীর্ঘ। ত্রিশের দশকে মিসরের জনগণ প্রথম জায়নবাদী ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধিতা করেছিল। মিসরের সেনাবাহিনী ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন যুদ্ধে লড়াই করেছিল।

পঞ্চাশের দশকে মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন দিয়েছিলেন। ইসরায়েলের আক্রমণের পর ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন।

নাসেরের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের প্রথম দিকে বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। মিসরীয় সেনারা সুয়েজ খাল পেরিয়ে সিনাই মুক্ত করেছিলেন। সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বিমান থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করার পরই কেবল ইসরায়েলি বাহিনী ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।

পরবর্তীকালে সাদাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করার পথ নেন। ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের জনগণকে সাহায্য-সহযোগিতা দেয়।

এরপর ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মিসরের ক্ষমতায় যাঁরা থেকেছেন, তাঁরা ইসরায়েলের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার জন্য এমনভাবে কাজ করেছেন, যেন ইসরায়েল দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ।

আরও পড়ুন

নিজের কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা দিতে গিয়ে সাদাত দাবি করেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের ৯৯ শতাংশ কার্ড যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।’ এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল, বছরের পর বছর ধরে মিসরীয় ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলে আসা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতাকে মুছে ফেলা।

কিন্তু এটা কখনোই সফল প্রকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হোসনি মোবারক ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হতে দিয়েছিলেন, যাতে করে দেশের ভেতরকার দুর্দশা থেকে জনসাধারণের মন ভিন্ন দিকে সরে থাকে। কিন্তু ঘটনাচক্রে, এই সব প্রতিবাদ-বিক্ষোভই ২০১১ সালে মোবারকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের জমিন তৈরি করে দিয়েছিল।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির আমলে যেকোনো গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি মিসরীয়দের সমবেদনা জানানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ২০২১ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহের সময় মিসরীয়রা কোনো সংহতি দেখায়নি।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনায় ব্যাপারটা আর তেমন থাকেনি। গাজায় বোমা হামলা শুরু হলে মিসরীয়দের মধ্যে একধরনের অক্ষমতাবোধ জন্ম হয়। মিসরের সীমানাবর্তী রাফায় অব্যাহতভাবে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। গাজায় ত্রাণবাহী গাড়ি প্রবেশে বাধা দেয়।

আরও পড়ুন

গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র যতই সামনে আসতে থাকে, মিসরীয়দের দুঃখ ও ক্রোধ ততই বাড়তে থাকে। সমমর্মিতার জোরালো এই প্রকাশ নিশ্চিতভাবেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সক্রিয় সমর্থনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে। মিসরের দম বন্ধ করা রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যেই অনেকে এখন ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর পণ্য ও সেবা বর্জনের ডাক দিচ্ছেন। 

মিসরের তরুণ প্রজন্ম মনে করছেন, ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা ও তাতে পশ্চিমের অন্ধ সমর্থন, তাদের জন্য জেগে ওঠার সতর্কবার্তা।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর মিসরের অনেক তরুণ পশ্চিমা জনপ্রিয় ও ভোগবাদী সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের রাজনৈতিক ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। প্রায় এক রাতের মধ্যে লাখ লাখ মিসরীয়র সেই মিথ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কেননা, তাঁরা দেখতে পান যে ইসরায়েল যখন গাজায় গণহত্যা করে চলেছে, তখন ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস ও লন্ডন তার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের দুষ্কর্মের সহযোগী অনেক আঞ্চলিক দেশের ক্ষেত্রেও মিসরীয়দের একই মনোভাব। সম্প্রতি রিয়াদে অনুষ্ঠিত একটি চিত্র প্রদর্শনীর উৎসব বর্জন করেন মিসরীয় শিল্পীরা।

আরও পড়ুন

মিসর সরকারের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ হলো, ইসরায়েল চাইছে মিসরে সংঘাত ‘রপ্তানি’ করতে। ১৩ অক্টোবর ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যাচ্ছে, গাজার ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপত্যকায় ‘স্থানান্তর’ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ইসরায়েল মিসরের ওপর চাপ তৈরি করে ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু আরব সম্মেলনে বক্তৃতাকালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বারবার করে সিসি না বলে দিয়েছেন।

সিসি সরকার এখন মিসরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের যাতে সিনাই উপত্যকায় পাঠিয়ে দিতে না পারে, সেটা প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। ১৮ অক্টোবর সিসি বলেছেন, লাখ লাখ জনতাকে নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের চাপ প্রতিরোধ করবেন।

রিম আবু-এল-ফাদল সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের মধ্যপ্রাচ্যের তুলনামূলক রাজনীতির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক 

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত