ইউক্রেন যুদ্ধ: জেলেনস্কি চীনের কথা শুনতে বাধ্য হতে পারেন

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো অবস্থান করছেন
এএফপি

রিগ্যান থেকে ট্রাম্পের প্রশাসনে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং প্রতিরক্ষাবিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে একজন বক্তা বলেছেন, ইউক্রেনের প্রশিক্ষিত সেনা ও গোলাবারুদের খামতির কারণে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চীনের দেওয়া শান্তি প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হতে পারেন; বিশেষ করে সৌদি ও ইরানের মধ্যে বেইজিংয়ের সফল মধ্যস্থতা তাঁকে এই সিদ্ধান্তের দিকে ঝোঁকাতে পারে।

কয়েক ডজন সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে বৈঠকটি চ্যাটাম হাউস বিধি মেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিধি অনুযায়ী, বৈঠকে হাজির থাকা কারও নাম–পরিচয় প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু আলোচকেরা চাইলে সেখানকার আলোচ্য বিষয় প্রকাশ করতে পারেন।

বৈঠকে মোটাদাগে আলোচকদের বেশির ভাগই ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সামরিক সহায়তা দিয়ে যুদ্ধকে পরিণতির দিকে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। সেখানে একজন শীর্ষ সারির বিশ্লেষক বলেছেন, ইউক্রেনের প্রশিক্ষিত জনশক্তি ও অস্ত্র-গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে অন্যান্য দেশ থেকে প্রশিক্ষিত সেনা পাঠিয়ে একটি সম্পূরক ‘বিদেশি বাহিনী’ গড়ে তোলা দরকার।

আরও পড়ুন

অংশগ্রহণকারী আলোচকদের বড় অংশের মত হলো, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার, তার সবটাই করতে হবে। তাঁদের প্রায় সবার কণ্ঠেই শুধু এ নিয়ে হতাশা ঝরতে দেখা গেছে যে পশ্চিমারা সর্বোচ্চ সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের জয়ের সম্ভাবনা ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে।

তাঁদের মধ্যে একজন বেশ হতাশ গলায় বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যদি চীনের প্রস্তাব মেনে নেন, তাহলে আমাদের অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কারণ, পশ্চিমের কেউ ধারণাই করতে পারেনি, চীন সফলভাবে সৌদি আরব ও ইরানের দুই হাতকে এক করতে পারবে। কিন্তু তারা সত্যিই সেটা পেরেছে।

ওয়াশিংটন চীনের শান্তি প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিলেও জেলেনস্কি তা করেননি। রাশিয়া তাঁর দখল করা আজভ সাগর ও দনবাসের বেশির ভাগ এলাকা নিজের দখলে রেখেই ইউক্রেনের সঙ্গে একটি মীমাংসায় পৌঁছাতে চায়। যেহেতু ইউক্রেনের প্রশিক্ষিত সেনা ও গোলাবারুদের সংকট চলছে, তাই সমঝোতায় রাজি হতে হলে ইউক্রেনকে ওই এলাকা হাতছাড়া করার বিষয়ে রাজি হয়েই টেবিলে বসতে হবে। ওই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের আধুনিক উন্নত ব্যবস্থাগুলোকে অবমূল্যায়ন করছে এবং চীন সম্পর্কিত তাঁর সাবেকি ধারণায় আটকে আছে।

 চীন সম্প্রতি অস্ত্রবিরতির যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা উড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ মুহূর্তে অস্ত্রবিরতিতে যাওয়ার অর্থ ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার ছিনিয়ে নেওয়া ভূখণ্ডকে রাশিয়ার হাতেই ফেলে আসা।

ইউক্রেন যুদ্ধে কয়েক মাস ধরে সরাসরি লড়াই করে এসেছেন, এমন একজন কর্মকর্তা ওই বৈঠকে বলেছেন, যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার যত সেনা হতাহত হয়েছে, তার তুলনায় ইউক্রেনের সেনাদের হতাহতের সংখ্যা তিন ভাগের দুই ভাগের সমান। কিন্তু রাশিয়ার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেনের পক্ষে প্রশিক্ষিত সেনা ও পর্যাপ্ত অস্ত্র ছাড়া বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। 

ওই বৈঠকে আমি ছিলাম এবং সেখানে আমি ওই গ্রুপকে যা বলেছি, তা প্রকাশ করার বিধিবদ্ধ স্বাধীনতা আমার আছে। আমি সেখানে তাঁদের বলেছি, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক ভূরাজনীতির আদল বদলে দিয়েছে। এটি চীন-সৌদি-ইরানকে এক জায়গায় এনেছে। সৌদি আরব পর্যন্ত বুঝতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্রের বদলে অন্য বন্ধু খুঁজতে হবে। তুরস্কও চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। ভারতও রাশিয়ার বৃহৎ তেল ক্রেতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আমি মনে করি, ইউক্রেনকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিজের মুখ রক্ষা করতে দ্রুত চীনের শান্তি প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত।

বৈঠকে উপস্থিত অন্য বিশ্লেষকেরাও এই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অনেকটা একমত। তাঁরাও মনে করেন, রাশিয়ার লোকবল ও সামরিক সক্ষমতা ইউক্রেনের চেয়ে অনেক বেশি থাকায় শেষ পর্যন্ত রাশিয়ারই জয় হবে। এ অবস্থায় ইউক্রেনকে শুধু অতিরিক্ত অস্ত্র দেওয়াই যথেষ্ট হবে না, তার সঙ্গে প্রশিক্ষিত সেনাও দিতে হবে।

একজন সাবেক পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার জন্য চীনের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পক্ষে মত দেন। তাঁর যুক্তি, রাশিয়ার ওপর অবরোধ দিয়ে মস্কোকে খুব একটা কাবু করা না গেলেও চীনের ক্ষেত্রে তা হবে না। কারণ, চীন রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত।

আরও পড়ুন

ওই বৈঠকে আমি ছিলাম এবং সেখানে আমি ওই গ্রুপকে যা বলেছি, তা প্রকাশ করার বিধিবদ্ধ স্বাধীনতা আমার আছে। আমি সেখানে তাঁদের বলেছি, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক ভূরাজনীতির আদল বদলে দিয়েছে। এটি চীন-সৌদি-ইরানকে এক জায়গায় এনেছে। সৌদি আরব পর্যন্ত বুঝতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্রের বদলে অন্য বন্ধু খুঁজতে হবে। তুরস্কও চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। ভারতও রাশিয়ার বৃহৎ তেল ক্রেতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আমি মনে করি, ইউক্রেনকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিজের মুখ রক্ষা করতে দ্রুত চীনের শান্তি প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • স্পেংলার এশিয়া টাইমস–এর নিয়মিত কলাম লেখক