রিকশাচালক সেলিম রাষ্ট্রের কাছে যেভাবে ‘খাবারের লিস্ট’ চাইলেন

‘তাহলে কি প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের কাছে ‘খাবারের লিস্ট’ চাইলেন সেলিম?’

বৃষ্টির দিনে ছাতা হারান যাঁরা, এ লেখক তাঁদের দলে। কিন্তু মানুষে গিজগিজ ও যানে ভরপুর সড়কে রিকশা থেকে ছাতা পড়ে যাওয়ার বিষয়টি কারও চোখে পড়ল না, কেউ আওয়াজ দিল না—এটা মানতে পারলেন না মো. সেলিম। বয়স পঞ্চাশের এই রিকশাওয়ালা আফসোস করে বললেন, যুগটাই বদলে গেছে।

মানুষ নগদ দুই টাকার লাভটাই বড় করে দেখে। আখেরে লোকসান কতটা হবে, সেটা তলিয়ে দেখে না!

১৯ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর ঢাকা যতটা স্থবির হয়ে পড়ে, বৃষ্টি সেই স্থবিরতাকে আরও প্রলম্বিত করেছে। কারওয়ান বাজারের উল্টো দিকে, বসুন্ধরা মার্কেটের পেছন থেকে তাই জিগাতলা পর্যন্ত পথটুকু পাড়ি দিতে বেশি সময় লাগছিল। শুরুতে বৃষ্টি বেশি থাকায় রিকশার হুড তোলা হলো। রিকশাওয়ালা এগিয়ে দিলেন পাঁচ থেকে ছয় ফুট লম্বা পলিথিনের একটা টুকরা। সেটা দিয়ে সামনে কোমর অবধি ঢেকে নেওয়ার পর ছাতাটা গুছিয়ে রিকশার সিটের পাশে রাখা হলো। রিকশাওয়ালা নিজেও পলিথিনের একটা ছোট টুকরা কায়দা করে মাথায় বেঁধে নিলেন, যাতে মাথাটা অন্তত বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়।

আরও পড়ুন

যাত্রা শুরুর মিনিট পনেরো বাদে গ্রিন রোডের মাঝামাঝি পৌঁছানোর পর বৃষ্টি কমে এল, ফলে নামানো হলো হুড, সরানো হলো পলিথিন। রিকশাওয়ালাও তাঁর মাথা থেকে পলিথিনের টুকরাটা খুলে ফেললেন। তবে তিনি সেটি ভাঁজ করে না রেখে রাস্তায় ফেলে দিলেন।

কিছুটা কৌতুক নিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, এমনটা তিনি কেন করলেন? এভাবেই তো রাস্তায় এত জঞ্জাল জমে। ঢাকার বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে, তার পেছনে যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অভাব যতটা দায়ী, মানুষের এমন ছোট ছোট খাসলতের সম্মিলিত ভূমিকাও তেমন কোনো অংশে কম নয়। এ কথায় পেছনে ফিরে রিকশাওয়ালা লজ্জার একটা হাসি দিয়ে বললেন, কাজটা করা তাঁর ঠিক হয়নি।

আরও পড়ুন

আর তখনই আবিষ্কার করা গেল, ছাতাটি কোনো এক ফাঁকে, সম্ভবত ঝাঁকিতে রিকশা থেকে পড়ে গেছে। কথাটা বলতেই রিকশাওয়ালার ওই প্রতিক্রিয়া—যুগটা বদলে গেছে। কতটা বদলে গেছে, তার প্রমাণ দিতে তিনি বললেন, দেখেন, পুরো রাস্তা মানুষে ভরা। কারও না কারও চোখে তো পড়েছে, কিন্তু তিনি তা বলেননি। এক হতে পারে, যিনি দেখেছেন, তিনি হয়তো ভেবেছেন, তাঁর তো জিনিস খোয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয়টা হতে পারে, দেখে ফেলা ব্যক্তি ‘তোফা’ ভেবে ছাতাটা নিজের বগলদাবা করেছেন।

সেলিমের আফসোস এখানেই। বললেন, তাঁর বাবা আগে যখন খোলা লবণ বিক্রি করতেন; প্রতিদিন বিক্রিবাট্টা শেষে লাভের টাকা দিয়ে চাল-ডাল কিনে ঘরে ফিরতেন। এরপর রান্না হতো, তাঁরা দুটো খেতে পারতেন।

সেলিম জানেন না ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিবের ভাইরাল হওয়া পোস্টের খবর। স্ত্রীর চাকরি প্রসঙ্গে বললেন, তা না হলে তো না খেয়ে মরতে হবে! সৎভাবে আয় করলে দোষ কোথায়—উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। এর কোনো জবাব মুখে এল না, কিন্তু মনে ভিড় করল কিছু কথা। বাংলার শ্রমজীবী, সাধারণ পেশাজীবী মানুষের জীবনে কোনো গরিমা নেই, কিন্তু সেখানে মালিন্যও ছায়া ফেলতে পারেনি। সংসারে নারীর জায়গা নির্ধারণ নিয়ে তাঁদের আলাদা চিন্তা নেই, বরং চেতনায় মিশে আছে মিলেমিশে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা।

একদিন এক ব্যবসায়ী লবণ নিতে এসে টাকার থলে ফেলে যান, যাতে ছিল প্রায় ৫০ হাজার টাকা। সেলিমের বাবা ওই টাকা দেখার পর সেই লোকের বাড়ি গিয়ে থলেটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে সেদিন আর বিক্রিবাট্টা হয়নি। খালি হাতে বাড়ি ফিরেছিলেন বাবা। সেলিমের স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন বাড়ির সামনের খেতে আবাদ করা কয়েকটা আখ চেয়ে এনে খেয়ে রাত পার করেছিলেন তাঁরা চার ভাই-বোন ও মা-বাবা।

সেলিমের বাড়ি জামালপুরের এক গ্রামে। ঢাকায় থাকেন ১৯ বছর। তিন বছর ধরে রিকশা চালান। আগে কাপড় রং করার কাজ করতেন। স্ত্রী ও বড় ছেলে পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তাঁরা থাকেন আশুলিয়ায়। তাঁদের সঙ্গে থাকে ছোট আরেক ছেলে ও সবার ছোট একমাত্র মেয়ে। সেলিম থাকেন বসুন্ধরা মার্কেটের পেছনে কাজীপাড়ায়।

আরও পড়ুন

সেলিম জানেন না ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিবের ভাইরাল হওয়া পোস্টের খবর। স্ত্রীর চাকরি প্রসঙ্গে বললেন, তা না হলে তো না খেয়ে মরতে হবে! সৎভাবে আয় করলে দোষ কোথায়—উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। এর কোনো জবাব মুখে এল না, কিন্তু মনে ভিড় করল কিছু কথা। বাংলার শ্রমজীবী, সাধারণ পেশাজীবী মানুষের জীবনে কোনো গরিমা নেই, কিন্তু সেখানে মালিন্যও ছায়া ফেলতে পারেনি। সংসারে নারীর জায়গা নির্ধারণ নিয়ে তাঁদের আলাদা চিন্তা নেই, বরং চেতনায় মিশে আছে মিলেমিশে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা।

তাঁরা ধর্মভীরু, যেমনটা সেলিমও, তিনি নামাজ পড়েন, দাড়ি রেখেছেন, নারীর প্রতি পরিপক্ষ চিন্তাধারা নিয়েই এই ঢাকা শহরে সুখে-দুঃখে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। ‘মায়ের জাতের’ প্রতি আলাদা সম্মান দেখানো বাংলার মানুষের মজ্জাগতই বলতে হয়। ধর্মের জ্ঞান বিতরণের ছলে যাঁরা নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ান, সর্বার্থেই নারীকে ‘ছোট’ প্রমাণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালান যাঁরা, তাঁদের ‘খপ্পরে’ সেলিমদের সবাই এখনো পড়েননি, এটাই যা ভরসার কথা।

আরও পড়ুন

সেলিমদের অবশ্য সেই জ্ঞান লাভের সময়ই–বা কোথায়, যখন প্রতিদিনের খাবার নির্ভর করে প্রতিদিনের শ্রমের ওপর। সেলিম বললেন, চাষের পাঙাশ আর ব্রয়লার না থাকলে গরিব মানুষ খেতে পারত না! আর এখন তো তা–ও খাওয়া কঠিন! ১২০ টাকার পাঙাশ এখন ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। ব্রয়লারও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সারা বছরে এক দিন ইলিশ মাছ কিংবা গরুর মাংস কেনাও তো বিলাসিতা!

তাহলে কি প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের কাছে ‘খাবারের লিস্ট’ চাইলেন সেলিম? যদিও তিনি জানেন না, চিত্রনায়ক ওমর সানীর এমন ‘বিস্ফোরক’ ফেসবুক পোস্টের কথা—‘সাধারণ মানুষ কি খাবে বলে দেন সরকার। খাবারের লিস্ট দিয়ে দেন আমরা কী খাব, আর পারছি না রাষ্ট্র।’

আরও পড়ুন

জানবেনই–বা কীভাবে? সেলিমরা পাঁচজনে এক কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন। ঘুমান মেঝেতে। দুপুর, রাতের খাবারসহ প্রতিদিন ভাড়া দিতে হয় ১৬০ টাকা। প্রতিদিন রিকশার জমা ১৫০ টাকা। সকালের খাবারসহ সারা দিনের চা-নাশতার খরচ তো আছেই; দিনে ৪০০ টাকার কমে হয় না। এই টাকা জোগাড়ের পর যা থাকবে, সেটা সংসারে দিতে পারেন। রিকশা চালানোর ফাঁকে অবসর কোথায় যে দেশ-দশের উন্নয়ন বা অগ্রগতির খবর রাখবেন?

স্ত্রী আর ছেলেও তো আয় করেন, সেই টাকা? সেলিম বললেন, দুই বেলা দুটো ভাত আর পরনের কাপড়েই কি জীবন পার করবেন তাঁরা? মাথার ওপর কি একটা আচ্ছাদন লাগে না, শোয়ার জন্য একটা বিছানার দরকার হয় না? একটা-দুটো আসবাব? ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে পড়াচ্ছেন, তারও তো খরচ আছে। শখ-আহ্লাদের কথা না হয় বাদই দিলেন। সেলিম হেসে হেসেই কথাগুলো বললেন, কিন্তু তাঁর মুখমণ্ডল কেমন কালোয় ছেঁয়ে থাকল!

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

    ই–মেইল: [email protected]