সোশ্যাল মিডিয়ার আয়নায় দেখি যে মুখ

সময়ের সঙ্গে পৃথিবী যতই বদলাক, কিছু জিনিস কখনো বদলায় না। আমরা এখন যারা বয়সে ত্রিশের ঘরে পা দিয়েছি, তাদের অনেকের মনে পড়বে, ছোটবেলায় কম্পিউটার, মুঠোফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি নতুন সংযোজন দেখে পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা রাগ করে বলতেন, ‘আমাদের সময় এগুলো ছিল না। কই, আমরা তো তাও ভালোই ছিলাম।’

চোখের পলকে আজ ১৫-২০ বছর পার হয়ে গেল, বড়রা হয়ে গেলেন বুড়ো আর আমরা ছোটরা হলাম বড়, কিন্তু অতীতকে আরও উত্তম ভাবার স্বভাবটা থেকেই গেল। এখন আমরা যারা বড়, তাদের অনেকেই হিমশিম খাচ্ছি ছোটদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সার-ইনফ্লুয়েন্সড’ জীবন নিয়ে এবং অনেকেই হয়তো ভাবছি, ‘নাহ, আমাদের বড় হওয়ার সময়টাই ভালো ছিল।’

ওয়েলশরা এই অনুভূতিকে একটি শব্দও দিয়েছে—‘হিরায়েথ’, যার মানে হচ্ছে, যত যা–ই হোক, অতীতকেই ভালো লাগা। আমি এখন ছোট থেকে বড় হয়ে যাওয়া এমন মানুষদেরই একজন।

আমি আজ একটু হয়রান। যতই সময় যাচ্ছে, চারদিকের সবকিছু যেন ততই ‘অফলাইন’ থেকে ইন্টারনেটের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, আর চারপাশের চাপে কয়েকবার চেষ্টা করেও আমি মন থেকে ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে পারছি না। আমাদের আজকের জীবনকে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া কল্পনা করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। এটা মেনে নিতেই হবে। এটাই আমাদের বর্তমান সময়ের বাস্তবতা। তবে ভয় লাগে, আমরা অনলাইন জগতের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি না তো? প্রশ্ন আসে, আমরা কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করি নাকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে?

আজ আমাদের বাংলাদেশি সমাজের গণ্ডিতে অন্তত যেকোনো কিছু আমরা শুধু তখনই লক্ষ করি, যখন তা চোখের সামনে ফেসবুকে আসে। আমরা কি মনের অজান্তেই তাহলে এমন অবস্থা করে ফেলছি যে অনলাইন একটা উপস্থিতি থাকতেই হবে? সমতা কিংবা ‘ইনক্লুসিভনেস’–এর ক্ষেত্রে এর পরিণতি কী? এসব নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার।

যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জগতে সরব, সেটা তাঁদের অধিকার। ঠিক যেন টক শোতে যাওয়ার মতো। কেউ কেউ টক শোতে যাবেন, তাঁদেরই হয়তো মানুষ বেশি চিনবে, তা অনেক আগে থেকেই বাস্তবতা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে টক শোর পার্থক্যটা হচ্ছে, টক শোতে হাতে গোনা কয়েকজনই যান, তাই স্বভাবতই সবাই বোঝেন যে টক শোর বাইরেও অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ কিংবা বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে আছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপারটা উল্টা—হাতে গোনা কয়েকজন এখানে অনুপস্থিত। এ জন্যই অনেকে যাঁরা কর্মক্ষেত্রে, গবেষণার জগতে, নতুন নতুন পদচারণ করছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো চাপ অনুভব করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সদা উপস্থিত থাকার।

আমরা বড় হওয়ার সময় বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁদেরই বেশি চিনতাম, যাঁরা খবরের কাগজে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। এই উপলব্ধি হয়তো এখনো আছে। কিন্তু নতুন যোগ হয়েছেন ফেসবুকে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা। তবে দুই দলকেই বুদ্ধিজীবী বলার যে প্রবৃত্তি, এটাতে সমস্যাও হতে পারে যদি আমরা কে কী লিখছেন সেটা ঠিকমতো, ‘ক্রিটিক্যালি’, বুঝতে এবং পরীক্ষা করে নিজেরা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে না শিখি। এটা খবরের কাগজ বা ফেসবুকে লেখা, দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে হয়তো বেশিই প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভালো দিকও অবশ্যই আছে। অনেকে সেখানে তথ্যমূলক কনটেন্ট তৈরি করেন তাঁদের কাজ বা পড়াশোনা থেকে এবং তাতে অনেকের উপকার হয়। যদি তা স্বাস্থ্য বা শিক্ষাবিষয়ক তথ্য হয়, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও যদি আমরা অফলাইন-অনলাইন সামঞ্জস্যের কথা এখন থেকেই না ভাবি, তাহলে কিছু অপকারের কবলে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, অনলাইন ক্লাস কখনো সামনাসামনি শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়ার বিকল্প হতে পারে না—সম্পূরক হতে পারে মাত্র।

তারপর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আরেকটা দারুণ ব্যবহার হচ্ছে বিপদে সাহায্যের জন্য সর্বজনের কাছে আবেদন করতে পারা। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা সম্ভাবনাময় ক্ষমতা আছে; ভালো কথা, ভালো চিন্তা, ভালো গল্প ছড়িয়ে দেওয়ার একটি ক্ষমতা—এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের হাতে।

এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমা যুগে অধিকাংশ মানুষেরা বা অন্তত অনেকেই—কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছি, তা আমরা সমাজ হিসেবে কোন কোন জিনিসকে মূল্য দিচ্ছি—সেটারই নিদর্শন। আমরা হয়তো ছোটদের মনের অজান্তে বলেই ফেলছি—লোকদেখানোই আসল বিজয়, দামি কিছু কিনতে পারলেই তুমি সফল, লেটেস্ট ‘আইফোন’ উপহার দিলেই শুধু তোমাকে তোমার প্রিয় মানুষ ভালোবাসে।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো এক অঞ্চলের দাদুর গল্প, যিনি সারা জীবন গাছ লাগিয়েছেন; হাওরের মাঝখানে দাঁড়ানো হাজার বছর পুরোনো এক গাছের গল্প; অভাবে স্কুল ছেড়ে কৃষক বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করা এক মেধাবী বালককে তার শিক্ষিকা বিনা বেতনে হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেওয়ার উদ্যমের গল্প।

এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে সাহস জোগাতে পারে, আশার আলো দেখাতে পারে। তবে এটা কতটুকু অর্জিত হবে, তা নির্ভর করে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারের ওপর। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপস্থিতি আমাদের জীবনে বাড়তেই থাকবে এবং আমরা আসলে এটা ঠেকাতেও আর পারব না, তাহলে এখন মনোযোগ দেওয়া উচিত আমরা কীভাবে এটা ব্যবহার করছি, তার ওপর। একটা সমাজ হিসেবে আমাদের বুঝেশুনে যে যার জায়গা থেকে চিন্তা করতে হবে—এই চিন্তাটুকুর উদ্রেক করানোর চেষ্টাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন

দিন শেষে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা কী নিয়ে কথা বলি, কী আলাপ করি—এর একটা গুরুত্ব আছে। আজ কেন জানি মনে হয় যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোক দেখানোর বাড়াবাড়িটাই বেশি। ভালো কথা, ভালো কাজের কথা, যে কথায় আশা জাগে, যে জিনিস দেখে শান্তি লাগে—এ রকম কিছু আজকাল কমই দেখি যোগাযোগমাধ্যমে। বিভেদ আর বিষবাষ্পের পাল্লাটাই সেখানে ভারী। আর আছে অনেক বেশি অদৃশ্য এক অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। আমরা এখানে দামি গাড়ি কিনে তার ছবি দেখাই, দামি ‘ডিজাইনার’ কাপড়ের ‘ভ্লগ’ করি, নানাভাবে আমাদের অর্থ-বিত্তের জানান দিই। আমার চিন্তা হয় ছোটদের নিয়ে। ওদের আমরা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছি? কী শেখাচ্ছি? ওদের কি সেই মানসিক পরিপক্বতা এসেছে অন্যের লোকদেখানোয় প্রভাবিত না হওয়ার?

যারা এখন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনেকেই এই দামি জিনিস কিনতে, ঘোরাঘুরি করতে পারছে না। আমরা কি আশা করতে পারি যে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতার দানা বাঁধছে না? ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে এসব ব্যাপার কি নজরে রাখা উচিত নয়?

এই যে লোকদেখানোর নতুন সংস্কৃতি, এই যে প্রতিযোগিতা—এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ওপর জীবনের সুখ–শান্তি যে নির্ভর করে না, সেটা তো ছোটদের, এমনকি নিজেদেরও অনেক সময় আমরা বলি না। যাঁরা এই লোকদেখানোর প্রতিযোগিতা দিয়ে সয়লাভ করছে প্রতিনিয়ত, তাঁদেরই বা মানসিক স্বাস্থ্যর কী অবস্থা? এ ছাড়া আজকাল গ্রাম-গঞ্জেও শিশুরা যে বাইরে খেলার মাঠে দৌড়াদৌড়ি না করে, বরফপানি বা ফুটবল না খেলে ফেসবুকে সময় কাটায় বা গেমস খেলে ইন্টারনেটে—এটা কি একধরনের জাতীয় বিপদের নিশানা নয়?

এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমা যুগে অধিকাংশ মানুষেরা বা অন্তত অনেকেই—কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছি, তা আমরা সমাজ হিসেবে কোন কোন জিনিসকে মূল্য দিচ্ছি—সেটারই নিদর্শন। আমরা হয়তো ছোটদের মনের অজান্তে বলেই ফেলছি—লোকদেখানোই আসল বিজয়, দামি কিছু কিনতে পারলেই তুমি সফল, লেটেস্ট ‘আইফোন’ উপহার দিলেই শুধু তোমাকে তোমার প্রিয় মানুষ ভালোবাসে। এমনকি অন্যদের সেবা করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা একরকম বড়াই-ই করি। দান করে যেন আজ তা যথার্থতা পায় না যতক্ষণ না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছবি দেওয়া হয়। কীভাবে এলাম আমরা এই পর্যায়ে?

আরও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, আমরা এটা পর্যন্ত বলছি না যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভন্ডামি’ করে টিকে যাওয়া, নামধাম করা অনেক সহজ এবং এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এও সত্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাছাই করে নিজের ভালোটা উপস্থাপন করার মতো সহজ কিছু নেই আজকের দুনিয়ায়।

আমার ভয় যে নতুন প্রজন্মকে আমরা ভুল জিনিসকে আর ভুল প্রবৃত্তিকে মূল্য দিতে শেখাচ্ছি। আজকাল আমরা শুধু টাকা–পয়সারই জয়গান দেখি—কে কী কিনলেন, কয়টা জামা কিনলেন, কত দাম দিয়ে কিনলেন। কেন আমরা জয়গান গাই না এমন কারও, যাঁর মনটা অনেক বড়, যিনি অন্যদের সাহায্য করেন, দয়া করেন, মায়া করেন। ছোট ছোট জিনিস যেমন কে কী শেয়ার করছেন, তা থেকে যেন আজ এটাই বড় হয়ে উঠেছে যে কার কত টাকা, কে কত দেশে ঘুরতে গেলেন ইত্যাদি। যাঁর যত টাকা ও পরিচিতি, তিনি তত সফল। সফলতার এই সংজ্ঞা জাতিগতভাবে মনে গেঁথে যেতে দিলে সামনে আমাদের নৈতিক বিপদ আছে—উন্নয়ন হবে বাইরে শুধু, মনের ভেতর নয়।

আরও পড়ুন

হ্যাঁ, যাঁর যা ইচ্ছা করার অধিকার আছে, সেটাতে কেউ বাধা দিচ্ছেন না। সমস্যাটা হচ্ছে যে আমরা যারা বাছাই করছি ‘অফলাইন’ পথ, তারা খুব বেশি সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছি এবং এ জন্যই অদৃশ্য যে চাপের কথা বলেছিলাম, তা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত লেখো না? তুমি লেখকই নও। তোমার প্রোফাইলে ‘ব্লু-টিক’ নেই, তোমাকে অনেক মানুষ চেনে না, তুমি তাহলে কিসের বুদ্ধিজীবী বা সেলিব্রিটি? সবকিছুর ছবি দেওয়া, চেক-ইন দেওয়া তোমার ভালো লাগে না? তুমি অস্বাভাবিক। তা ছাড়া, সবকিছু ঢালাওভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমরা কদাচিৎ ভাবি গোপনীয়তার কথা, অন্যদের এবং নিজেদেরও। হুটহাট ছবি তোলার ক্ষেত্রে আমরা অন্যের সম্মতি নিই না, সেটা প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও তো না-ই।

সময় এসেছে উপকারের সঙ্গে অপকারের কথাও বলার। একে অপরকে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করার, অনুপ্রেরণা দেওয়ার। ছোটদেরকে বলার যে, ‘শোনো, এই লোকদেখানো প্রতিযোগিতায় নাম না লেখালেও হবে। শোনো, ইন্টারনেটের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয় জীবনটা, আরও অনেক কিছু আছে ভাবার। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে পায়ের পাতাকে পানি ছুঁতে দাও, ফোনে ছবি তুলতে হবে না। নতুন রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে খাওয়ার ছবি না দিলেও খাওয়া হজম হবে। তোমার প্রিয় মানুষ তোমাকে নিয়ে ফেসবুকে ছবি দিয়ে ভালোবাসার জয়গান না গাইলেও সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে।’

সময় এসেছে কথাগুলো বলার, সতর্ক হওয়ার, চিন্তা করার, চিন্তিত হওয়ার। তাতে আর যা–ই হোক, ক্ষতি-তো নেই। তা–ই না?

  • রুবাইয়া মোরশেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক (শিক্ষা ছুটিতে), বর্তমানে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক