পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসন দেখাল গণতন্ত্রের ‘সংকট’

রাশিয়ার হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কিয়েভের একটি এলাকা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বাধীন জোট ইতালির নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, এটা স্পষ্ট হওয়ার পর সর্বপ্রথম কে মেলোনিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন? ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থার সাম্প্রতিক খোঁজখবর রাখা মানুষ অনুমান করেই দিব্যি বলে দেবেন, মেলোনিকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান আর পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেই ডুদা। ইউরোপের এই দুই কট্টর ডানপন্থী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণবিরোধীরই সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা মেলোনির জয়ে।

মেলোনি হতে যাচ্ছেন ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, এটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখন এটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ইতালিতে ফ্যাসিস্ট যোগসূত্র থাকা একটি চরম ডানপন্থী দলের ক্ষমতায় আসা। এখানে লক্ষণীয় বিষয়, মেলোনির দল ব্রাদার্স অব ইতালির সঙ্গে যেসব দল জোট বেঁধে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা কিছুদিন আগেও মারিও দ্রাঘি নেতৃত্বাধীন সরকারের অংশ ছিল।

মারিও দ্রাঘি সরকারের পতন

পতনের আগের সময়গুলোয় মারিও দ্রাঘি অনেকগুলো সংকট মোকাবিলা করছিলেন। করোনার সময় ইউরোপের সবচেয়ে বিধ্বস্ত দেশগুলোর একটা ছিল ইতালি, ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর খরাজনিত সমস্যা। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয় পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের পর জ্বালানির দাম বৃদ্ধিজনিত তীব্র সংকট। এতগুলো সংকটে পড়া একটি সরকারকে তার কোয়ালিশনে থাকা দলগুলো ওই সময়ের জন্য সমর্থন করা দূরে থাকুক, বরং সেই ‘মোক্ষম’ সময়ে তারা নানা রকম দাবিদাওয়া তুলতে থাকে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত দ্রাঘির পতন নিশ্চিত করে।

ইতালির বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘিকে উচ্চ দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানে পারদর্শিতার জন্য ‘সুপার মারিও’ উপনামে ডাকা হয়। বলা হতো, করোনা আর তার ঠিক পরে পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের সময় ইতালি ছিল তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দুটো হাতে। কিন্তু তাঁকে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হলো না।

যা-ই হোক, দ্রাঘির এই পতনকে অনেক বিশ্লেষকই দেখেছেন রাশিয়ার জয় হিসেবে। যে দল তিনটির (ফোরজা ইতালি, ফাইভ স্টার মুভমেন্ট, লীগ) সমর্থন প্রত্যাহারে দ্রাঘির পতন হলো, তার প্রতিটির প্রধান কমবেশি পুতিনের সমর্থক। এটাকে আরও এই কারণে পুতিনের জয় হিসেবে দেখা যায় যে পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং ইউরোপে পুতিনের প্রভাব কমানোর জন্য ইউরোপের যেসব নেতা অত্যন্ত অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন, দ্রাঘি তাঁদের একজন।

পুতিনের আগ্রাসনের কারণে বিভিন্ন দেশের জনগণ যে সংকটে পড়েছে, তা প্রাথমিকভাবে অনেকে সহ্য করে নিলেও সেটা কত দিন করবেন, এটাই বড় প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে সেসব দেশের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে জনগণের চিন্তাকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এই প্রশ্ন এখন বড় হয়েছে যে আসন্ন শীতে জ্বালানির অভাব ইউরোপকে ইউক্রেনের পেছনে কতটা ঐক্যবদ্ধ রাখবে।

জো বাইডেন এবং ওলাফ শলৎজের সৌদি ভ্রমণ

কিছুদিন আগে ‘জেনেশুনেই বিষ পান’ করতে হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন, সৌদি আরবের যুবরাজ (যিনি আসলে ডি ফ্যাক্টো শাসক) মোহাম্মদ বিন সালমানের মুষ্ঠিতে মৃদু ধাক্কা দেওয়ার (ফিস্ট বাম্প) মানে কী। কিন্তু তিনি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন, মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বসেছিলেন।
আগামী নভেম্বরের শুরুতে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন। এই নির্বাচনে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ নতুন সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর নিম্নকক্ষ, প্রতিনিধি পরিষদের (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ) সব সদস্য নির্বাচিত হবেন। এই নির্বাচনে কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া না পাওয়া আগামী দিনগুলোয় প্রেসিডেন্টের শাসন কতটা মসৃণ হবে, সেটা যেমন নির্ধারণ করে, তেমনি এই নির্বাচনকে প্রেসিডেন্টের পারফরম্যান্সের একধরনের পরোক্ষ ভোট হিসেবেই দেখা হয়।

পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে যেহেতু জ্বালানির দাম অনেক বেশি বেড়ে গেছে, তাই আমেরিকায় আগে থেকেই থাকা মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে অনেক বেশি। সুতরাং মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে বাইডেন চেষ্টা করেছিলেন বৈশ্বিক তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক করার মাধ্যমে নিজের দেশের ভেতরে মানুষের সমালোচনা দূর করতে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক পর্যায়েও যেন এই সংকট কমিয়ে আনা যায়। বাইডেনের নিশ্চয়ই মনে পড়ে থাকবে, রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিমি কার্টারের পরাজয়ের সময়কার প্রেক্ষাপট, যেখানে সে সময়ের অন্য কিছু সমস্যার সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত চরম মূল্যস্ফীতি এবং বেকারত্বের মাশুল দিয়েছিলেন জিমি কার্টার।

একই রকম সমালোচনায় পড়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। তিনিও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সঙ্গে সৌদি আরবও সফর করেছেন। শীতকালকে সামনে রেখে রাশিয়ার গ্যাস এবং জ্বালানি তেল সরবরাহের সংকট মোকাবিলায় তাঁকে এই সফর করতে হলো। যথারীতি মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তাঁকে বসতে হয়েছে। মুখে তিনি যতই বলুন না কেন, সৌদি যুবরাজের সঙ্গে মানবাধিকার নিয়েও কথা বলেছেন। তাঁকেও সমালোচনার তেতো বড়ি গিলতেই হয়েছে।

আরও পড়ুন

রাশিয়ার ওপর ইউরোপের জ্বালানিনির্ভরতা: ফিডিং দ্য বিস্ট

চীন-তাইওয়ান সংকট নিয়ে আমার কিছুদিন আগের একটি কলামে ‘ফিডিং দ্য বিস্ট’ কথাটি নিয়ে লিখেছিলাম। চীন-আমেরিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কথাটি খুব ব্যবহার করেন ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের ঘাড়ে সব দোষ ফেলা জন মার্শেইমার। চীন সম্পর্কে তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও বছরের পর বছর আমেরিকা তার কারখানা, প্রযুক্তি অনেক কিছু চীনে স্থানান্তর করেছে বেশি লাভের আশায়। এ ছাড়া বিশ্বায়নকে অতি গুরুত্ব দিয়ে চীন থেকে সস্তায় নানা পণ্য পেয়ে নিজের অনেক পণ্য উৎপাদন থেকে সরে গিয়ে চীনকে বৈশ্বিক ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’-এ পরিণত করে অকল্পনীয় অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে। ‌ মার্শেইমার বিশ্বাস করেন, চীনই হচ্ছে আমেরিকার প্রধান শত্রু এবং আমেরিকার কৌশলগত এই ভুলকে তিনি বলেছেন ‘ফিডিং দ্য বিস্ট’।

মূলত ইউরোপে জ্বালানি বিক্রির টাকাতেই ফুলে-ফেঁপে উঠছিল রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। সেই টাকায়ই পুতিন আর তাঁর অলিগার্করা অকল্পনীয় পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পদ বানিয়েছেন। সে টাকায়ই রাশিয়ার সামরিক শক্তি বেড়েছে এবং আধুনিক হয়ে উঠেছে। সেই টাকাই পুতিনকে সাহস দিয়েছে যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলেও তিনি টিকে থাকতে পারবেন। ভ্লাদিমির পুতিন এটাও জানতেন, ইউরোপ যতটা জ্বালানিনির্ভর হয়ে আছে তাঁর ওপর, তাতে পশ্চিম ইউরোপের পক্ষে রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অন্তত সম্ভব হবে না। এভাবেই ইউরোপ বছরের পর বছর ধরে ‘ফেড দ্য বিস্ট’।

ইউরোপের কি বিকল্প ছিল না?

পুতিনের আগ্রাসী চরিত্র খুব ভালোভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালেই জর্জিয়ায় আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। তখন থেকেই কি ইউরোপের উচিত ছিল না, রাশিয়ার ওপর জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা? অথচ কমানো দূরে থাকুক, বাড়িয়েছে সবাই। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানি ২০১১ সালে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি দ্বিগুণ করার জন্য বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে (ইউক্রেনকে বাইপাস করার উদ্দেশ্যে) নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়, যা শেষ হয় ২০২১ সালে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের সময় এই পাইপলাইনের নানা সমীক্ষাই হচ্ছিল। মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়নি, তাই সেটা বন্ধ করলে তার অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো সামান্যই। ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসন শুরুর পর সেই তৈরি পাইপলাইন স্থগিত করা হয়েছে, কিন্তু কেন সেটা ২০১৪ সালেই বন্ধ করে দেওয়া হয়নি?
২০০৮ সালের কথা বাদই দিই, ২০১৪ সালের পর থেকে ইউরোপ যদি বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি গ্যাসের সংস্থান শুরু করত, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য, নরওয়ে কিংবা আমেরিকা থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এনে সেটাকে গ্যাসে পরিণত করে সরবরাহ করার মতো পর্যাপ্ত টার্মিনাল এবং অন্যান্য অবকাঠামো ইউরোপেই তৈরি হয়ে যেত। উৎপাদক দেশগুলোও তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে পারত। যেহেতু কার্বন কমানো নিয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর একধরনের চাপ আছে, তাই তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের ওপর জোর দিতে পারত। তাহলে ২০১৪ সালের পর ৮ বছরে রাশিয়া ওপর জ্বালানিনির্ভরতা নেমে আসতে পারত অনেক নিচুতে।

আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দায়

এসব কিছুর পেছনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানি এবং এর দীর্ঘ সময়ের সরকারপ্রধান আঙ্গেলা ম্যার্কেলের তীব্র সমালোচনা আছে। ২০০৮ সালে রোমানিয়ার বুখারেস্টে ন্যাটো সম্মেলনে জর্জিয়া আর ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করার প্রস্তাবের পথে ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে ম্যার্কেলই সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি করেন। ন্যাটোতে যোগদান করতে ব্যর্থ হয়েও জর্জিয়া কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পারেনি এবং রাশিয়ার কাছে ভূমি হারিয়েছে (দ. ওসেটিয়া আর আবখাজিয়া)।

ইউক্রেনে এবারের সর্বাত্মক আগ্রাসনের আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করেছিলেন পুতিন। এরপর রুশ ভাষাভাষীদের মদদ দিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাসে একটি প্রক্সি যুদ্ধ চাপিয়ে দেন পুতিন। রাশিয়ার ওপর তখনকার নিষেধাজ্ঞা অবশ্য খুব কঠোর হতে পারেনি মূলত ম্যার্কেলের কারণে। অপর দিকে অবিশ্বাস্যভাবে সেই যুদ্ধ থামানোর নামে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে মিনস্ক চুক্তি (যা ইউক্রেনের স্বার্থের ঘোর বিরোধী) স্বাক্ষরের জন্য মধ্যস্থতা করে ফ্রান্স ও জার্মানি। এই চুক্তির পেছনেও প্রধান ভূমিকা ম্যার্কেলের।

এভাবে নানা পদক্ষেপ নিয়ে নিজের সময়টা অন্তত ম্যার্কেল যেভাবে পার করেছেন, সেটা আপাতদৃষ্টে অসাধারণ। কিন্তু তিনি তৈরি করে গেছেন এক ভয়ংকর সংকট, যেটা তাঁর উত্তরসূরিকে তো চরম বিপদে ফেলেছেই, ফেলেছে গোটা উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বকেই।

আরও পড়ুন

ইউক্রেন আগ্রাসন গণতন্ত্রের যে সংকট প্রকাশ করল

গণতন্ত্রের সমালোচনা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রশংসা এই যে এই ব্যবস্থায় জনগণ মোটাদাগে ক্ষমতায়িত থাকে। তাই জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তা করতে পারে না সরকারগুলো। যেহেতু উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, যেহেতু সেখানে কার্যকর সংসদ, বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভূমিকা পালন করে, তাই জনগণের স্বার্থরক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, ইউক্রেন সংকটের পেছনে গণতন্ত্রের এই দিকের একটা প্রভাব আছে।

সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় থেকে চেষ্টা করে, জনগণকে যতটা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়। তার মাথায় থাকে পরবর্তী নির্বাচনেও জিতে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষমতাসীনরা ভেবেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কিনে যদি সস্তায় সরবরাহ করা যায়, সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা তাতেই খুশি থাকবেন। আর কোনো সরকার যদি রাশিয়ার ওপর জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প জ্বালানি কিনতে যেত, সেটার বাড়তি ব্যয় মানুষকে অসন্তুষ্ট করত এবং সেই অসন্তুষ্টি বিরোধী দলগুলোর অস্ত্রে পরিণত হতো।
এমনকি উন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে জানেন না। তাই আজ ইউরোপে যখন একটা যুদ্ধ লেগে গেছে, তখন পশ্চিম ইউরোপের সব দেশের বেশির ভাগ মানুষের মতামত, রাশিয়ার জ্বালানি বন্ধ করার পক্ষে হলেও এমন যুদ্ধ লেগে না গেলে তাঁরা সেটা চাইতেন না। সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ক্ষমতাসীন সরকারকে চরম বিপদে ফেলে দিত। প্রাথমিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হওয়া মানে, প্রতিটা জিনিসের মূল্য বেড়ে যাওয়া। এমন পদক্ষেপ নিয়ে সেই সরকার পুনর্নির্বাচিত হতে পারার কথা নয়। তাই জ্বালানিনির্ভরতা কমানো দূরে থাকুক, ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানি নিয়ে রাশিয়ার ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হতে শুরু করেছিল।

সমস্যা হচ্ছে, পুতিনের আগ্রাসনের কারণে বিভিন্ন দেশের জনগণ যে সংকটে পড়েছে, তা প্রাথমিকভাবে অনেকে সহ্য করে নিলেও সেটা কত দিন করবেন, এটাই বড় প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে সেসব দেশের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে জনগণের চিন্তাকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এই প্রশ্ন এখন বড় হয়েছে যে আসন্ন শীতে জ্বালানির অভাব ইউরোপকে ইউক্রেনের পেছনে কতটা ঐক্যবদ্ধ রাখবে। বহু ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের নির্বাচিত হওয়া বা ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে হয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকারগুলোকে। কারণ, কোনো পরিস্থিতিতেই সেসব দেশের বিরোধী দল সরকারকে ছাড় তো দেয়ই না, বরং প্রতিটি সংকটকে পুঁজি করে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
ইতালির দ্রাঘি সরকারের পতন এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে চরম ডানপন্থীদের উত্থান আমাদের সেই বার্তা দেয়। একই কারণে বিরোধীদের তীব্র প্রচারণা থেকে বাঁচতে বাইডেন কিংবা শলৎজকে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ-অপছন্দ সরিয়ে রেখে মুহাম্মদ বিন সালমানের মতো একজন মানুষের সঙ্গে বসে জ্বালানি পাওয়ার রফা করার চেষ্টা করতে হয়।

পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসন উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই সংকটকে আমাদের সামনে এনেছে। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো সংকট থাকার মানে এই নয় যে তার বিপরীতে একতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে হবে, যদিও অনেক দেশে সেটা মাথাচাড়া দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত হবে, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে, তার মধ্য থেকেই এর সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, সেই আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।

  • জাহেদ উর রহমান শিক্ষক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ