প্রশ্ন করা শিক্ষার্থী ‘বেয়াদব’ হয় না; ‘কড়া শিক্ষক’ মানেই ভালো শিক্ষক নন

শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়ায় সফল হতে পারেন, তা নিশ্চিত করা শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।
ফাইল ছবি

‘শিশুরাই সব’-এর ফেসবুক পেজে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘স্কুলজীবনে আপনার প্রিয় শিক্ষক কে ছিলেন? কেন তাঁকে পছন্দ করতেন?’ উত্তরে অনেকেই নিজের প্রিয় শিক্ষকের কথা জানিয়েছেন। কেন তাঁরা প্রিয় তার উত্তরে এসেছে—
‘সেই শিক্ষককে আজও কেউ ভুলতে পারেননি কিশোর-কিশোরীদের প্রতি তাঁর গভীর সম্মানবোধ এবং বৃহৎ জীবনের দিকে তাদের মনোযোগ নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য!’
‘তিনি সদালাপী ও শিক্ষার্থীবান্ধব ছিলেন।’
‘তিনি কোনো দিন শিক্ষার্থীদের বকাঝকা করতেন না। তিনি আমাদের পড়াশোনা করতে সাহায্য করতেন, আমাদের অনুভূতি বুঝতেন।’
‘তিনি আমাদের শাস্তি দিতেন না, উৎসাহ দিতেন। অঙ্কের মতো কঠিন বিষয় তাঁর কারণে সহজ মনে হতো।’
বেশির ভাগ মানুষ পরিণত বয়সে পৌঁছে শিক্ষকদের সংবেদনশীল আচরণের বিষয়টি মনে রেখেছেন।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। শিশু নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ হলে তা খবর হয়, আমরা জানতে পারি। কিন্তু প্রতিদিন বিদ্যালয়, বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্রে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক শাস্তির শিকার হয়। শাস্তি শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গবেষণায় জানা যায়, শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব শিক্ষা, কাজসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীভাবে পড়বে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আগামী কয়েক দশকে চাকরির বাজার সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যেতে পারে। কিছু পেশা বিলুপ্ত হবে। আবার নতুন কিছু পেশার উদ্ভব হবে। খুব কম মানুষই হয়তো সারা জীবন এক পেশায় কাজ করবেন। কয়েক বছর পরপর নতুন প্রশিক্ষণ নিয়ে ভিন্ন পেশার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধকরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পরিপত্র জারি করেছে, তার বাস্তবায়ন ও যথাযথ মনিটরিং করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শাস্তি না দিয়ে এবং অবমাননা না করে শিক্ষা দেওয়া নিয়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা ও নিজস্ব চিন্তা প্রকাশের পরিবেশ তৈরি করা।

বর্তমান সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, তখন কী কী ধরনের পেশা থাকবে, সে বিষয়ে আমাদের সঠিক ধারণা নেই। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, অর্থপূর্ণ কাজ করতে হলে, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, যোগাযোগ এবং যেকোনো দলের ভালো সদস্য হওয়ার গুণাবলি। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি এই দক্ষতা অর্জন না করেন, তাহলে জাতি হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।

শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করা, বিতর্ক করাকে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষার্থী প্রশ্ন করলে তাকে ‘বেয়াদব’ বলার যে মানসিকতা আমাদের সমাজে আছে, তা থেকে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে ‘কড়া শিক্ষক’দের সুনাম আছে। কিন্তু শিক্ষককে ভয় পেলে ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করতে পারে না। তাহলে তাদের চিন্তা ও বিশ্লেষণের শক্তি তৈরি হবে কীভাবে?

বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষকসহ সব গুরুজনের সম্মান করতে শেখানো হয়। কিন্তু বিদ্যালয়, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা কি শিক্ষার্থীদের সম্মান করেন? প্রশ্নটি ভাবছিলাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে করা কোর্সগুলোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে। গত এক বছর হার্ভার্ডে পড়ছি। প্রতি সেমিস্টারের শেষে প্রতিটি কোর্সের মূল্যায়ন করেন শিক্ষার্থীরা; এই প্রক্রিয়ায় তাদের নাম উল্লেখ করতে হয় না। একটা অংশে থাকে শিক্ষকের মূল্যায়ন।

শিক্ষার্থীরা ১ থেকে ৫-এর স্কেলে শিক্ষককে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করে একটি নম্বর দিতে পারেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে শিক্ষককে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে হয়। তার মধ্যে আছে শিক্ষকদের নানা বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন বিষয়ে নতুনভাবে ভাবতে সহায়তা করা, পাঠদানের সময় সঠিকভাবে কাজে লাগানো, শ্রেণিকক্ষের আলোচনা দক্ষতার সঙ্গে সঞ্চালনা করা, শিক্ষার্থীদের উপকারী ফিডব্যাক দেওয়া, ভিন্নমত এবং নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, ক্লাসের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সময় দেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের সম্মান করা।

প্রত্যেক শিক্ষক যে বিষয়ে পড়ান, সেই বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু তা ভালো শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কী আচরণ করছেন, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যায়নের ফরম সেই কথাটি মনে করিয়ে দেয়।

আমাদের এক শিক্ষক বললেন যে এর আগের বছরে এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো করেননি। তারপর খুব দুঃখের সঙ্গে যোগ করলেন, ‘নিজেকে প্রশ্ন করলাম-“আমি কি ভুল করেছি যে শিক্ষার্থী শিখতে পারেনি?”’

এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পরস্পরের কাছ থেকে শেখেন। এক বিষয়ে ফাইনাল পেপার জমা দেওয়ার আগে অধ্যাপক ই-মেইল করেছেন, আমাদের লেখা প্রবন্ধ পড়া এবং তা থেকে শেখার জন্য তিনি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

হার্ভার্ডে প্রতি কোর্সেই মূল শিক্ষকের একাধিক সহকারী থাকেন। কোনো বিষয় বুঝতে অসুবিধা হলে পরে তাঁদের কাছে গিয়ে বুঝে নেওয়া যায়। চাইলে শিক্ষকের কাছেও যাওয়া যায়। আমি যে কোর্স করছি, তা মূলত পেশাজীবীদের জন্য। অনেকেই পড়াশোনা থেকে দীর্ঘ বিরতির পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। মূল কোর্স শুরুর আগে আমাদের প্রস্তুতির জন্য প্রায় পাঁচ সপ্তাহ ছিল। তখন গণিত, পরিসংখ্যান এবং অর্থনীতি শেখার সময়। সপ্তাহের বেশ কয়েক দিন ‘স্টুডিও ল্যাব’ হতো। নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীরা একটি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে বাড়ির কাজ করতে পারতেন। সেখানে শিক্ষকেরা থাকতেন, যাতে প্রয়োজনে সহায়তা দিতে পারেন। বেশ লেগেছিল এই শিক্ষার্থী সংবেদনশীল আয়োজন।

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়ায় সফল হতে পারেন, তা নিশ্চিত করা শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। এই বোধ হার্ভার্ডে পড়ার সময় তীব্র ভাবেই হয়েছে। আর আমাদের দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে না পেরে যে গভীর মানসিক যন্ত্রণার শিকার হন, কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন, তাঁদের কথাও মনে পড়েছে।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন হার্ভার্ডের বাজেট অনেক বেশি। মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইতিবাচক আচরণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার সম্পর্ক নেই। মানসিকতাটা গুরুত্বপূর্ণ।

হার্ভার্ডসহ নামকরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ও অনেক দায়িত্ব আছে। প্রতি ক্লাসে পড়াশোনা করে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে আসা, শ্রেণিকক্ষে আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা, সব অ্যাসাইনমেন্ট এবং পরীক্ষা সময়মতো এবং সততার সঙ্গে শেষ করা, শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সম্মান করা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধকরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পরিপত্র জারি করেছে, তার বাস্তবায়ন ও যথাযথ মনিটরিং করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শাস্তি না দিয়ে এবং অবমাননা না করে শিক্ষা দেওয়া নিয়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা ও নিজস্ব চিন্তা প্রকাশের পরিবেশ তৈরি করা।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকলে শেখার অভিজ্ঞতা ছাত্রছাত্রীদের জন্য অর্থপূর্ণ হবে। শিক্ষকেরাও শিখতে পারবেন।

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী; বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।